ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

বিরল খনিজ উৎপাদনে বিশ্বশীর্ষ চীন, চতুর্থ মিয়ানমার আমাদের খনিজ বালিতেও আছে পৃথিবীর বিরল পদার্থ!

আহমদ গিয়াস ::  ইউরেনিয়াম পৃথিবীর কোন বিরল পদার্থ নয়। কিন্তু বিরল পদার্থ হিসাবে চিহ্নিত পৃথিবীর ১৭টি পদার্থের সবগুলোরই অস্তিত্ব কক্সবাজার সৈকতসহ ব্রহ্মপুত্র নদের তীরের বালিতে রয়েছে বলে ধারণা গবেষকদের। নবায়নযোগ্য জ্বালানী ও পরমাণু চুল্লীর নিরাপত্তা রক্ষাসহ উচ্চ প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত ‘পৃথিবীর বিরল ধাতু’র (আরইএম বা আরইই নামে পরিচিত) উৎপাদন বিশ্বব্যাাপী বাড়ছে। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার মাত্র ২ বছর আগে বিরল ধাতু উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় যোগ দিয়েই রাশিয়া-ভারতকে পেছনে ফেলে বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ স্থানটি দখল করে নিয়েছে।
পৃথিবীর বিরল ধাতুসমূহের মোট মজুদের এক তৃতীয়াংশই ভারতীয় উপমহাদেশে রয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সমুদ্র ও নদ-নদীর তীরের বালিতে পাওয়া মোনাজাইটে যে ল্যান্থানাইড সিরিজ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেখানেই পৃথিবীর বিরল ধাতুগুলোর উপস্থিতি রয়েছে বলে ধারণা করছেন গবেষকরা।
পৃথিবীর ১৭টি বিরল খনিজ পদার্থকে একযোগে ‘রেয়ার আর্থ মেটেরিয়াল/এলিমেন্ট’ বা আরইএম/আরইই বলা হয়। পদার্থগুলো হল-সেরিয়াম (সাংকেতিক নাম সিই), ডিসপ্রোজিয়াম (ডিওয়াই), এরবিয়ামি (ইআর), ইউরোপিয়াম (ইইউ), গ্যাডুলিনিয়াম (জিডি), হলমিয়াম (এইচও), ল্যান্থানাম (এলএ), লুটেটিয়াম (এলইউ), নিউডাইমিয়াম (এনডি), প্র্যাস্যুডিয়াম (পিআর), প্রোমেথিয়াম (পিএম), সামারিয়াম (এসএম), স্ক্যান্ডিয়াম (এসসি), টারবিয়াম (টিবি), থুলিয়াম (টিএম), ইত্তেরবিয়াম (ওয়াইবি) ও ইত্তিরিয়াম (ওয়াই)।
পৃথিবীর বিরল উপাদানসমূহের সবগুলোরই অস্তিত্ব দেশে রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক ভূ-তত্ত্ববিদ ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা ও প্রকৌশল বিভাগের প্রধান, প্রফেসর ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকী। তিনি বলেন, কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে পাওয়া খনিজ বালিতে মিশে আছে পৃথিবীর বিরল পদার্থগুলো। ইতোমধ্যে সৈকতের খনিজ বালিতে পাওয়া মোনাজাইটে যে ল্যান্থানাইড (এলএন) সিরিজ এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, সে সিরিজেই ল্যান্থানাম (এলএ)সহ ১৫টি বিরল উপাদান থাকে। সুতরাং আমাদের দেশেও যে আরইএম রয়েছে, তা এক প্রকার নিশ্চিত।
দেশের এ বিশিষ্ট ভূ-রসায়নবিদ বলেন, সাধারণত: মোনাজাইটে ৫০% ল্যান্থানাইড থাকে। তবে আমাদের দেশে এসব বিরল পদার্থের মজুদ বা মান নিয়ে তেমন কোন গবেষণা হয়নি।
বিজ্ঞানীরা জানান, পৃথিবীর বিরল পদার্থগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্রযুক্তিখাতে ব্যবহৃত হয়। এরমধ্যে এরবিয়াম দিয়ে তরঙ্গ বর্ধক হিসাবে লেজার অপটিক্যাল, লেজার অস্ত্র, অপটিক্যাল ফাইবারসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ যৌগিক পদার্থ তৈরি হয়। ইটার্বিয়াম ব্যবহৃত হয় গামা রশ্মির উৎ্স হিসাবে এবং স্টেইনলেস স্টিল বা সক্রিয় লেজার মিডিয়াগুলির ডোপান হিসাবে। সাধারণত: মোনাজাইট, ইউসেনাইট এবং জেনোটাইমে মিশে থাকে ইটার্বিয়াম। লুটেটিয়াম (লুটেটিয়াম-১৭৬) পারমানবিক চিকিৎসা পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নিউরোএন্ডোক্রাইন টিউমারগুলিতে রেডিওনিউকিয়¬াইড থেরাপির কাজে ব্যবহৃত হয় উপাদানটি।
গ্যাডোলিনিয়াম ধাতু লবণ হিসাবে নিউট্রন শোষণ করে। তাই পারমাণবিক চুল্লিগুলোকে রক্ষা করার জন্য নিউট্রন রেডিওগ্রাফি হিসাবে ব্যবহৃত হয় ধাতুটি।
ডিসপ্রোসিয়াম উচ্চ তাপীয় নিউট্রন শোষণ ক্রস-বিভাগের জন্য পারমাণবিক চুল্লিগুলিতে নিয়ন্ত্রণ রড তৈরির কাজে, ডেটা স্টোরেজ অ্যাপ্লিকেশনগুলিতে উচ্চ চৌম্বকীয় সংবেদনশীলতার জন্য এবং টেরেফেনল-ডি (একটি চৌম্বকীয় উপাদান) এর উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের মত ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয়তা শোষনের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য রক্ষা করে স্যামারিয়াম। স্যামারিয়াম-১৫৩ ক্যান্সার চিকিৎসায় এবং স্যামারিয়াম-১৪৯ নিউট্রন শোষক হিসাবে পারমানবিক চুল্লী নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া কোন পদার্থের তেজস্ক্রিয়তা নির্ণয়েও ব্যবহৃত হয় পদার্থটি। হেডফোন বা সাউন্ড ডিভাইস তৈরীতে ব্যবহৃত হয় স্যামারিয়াম কোবাল্ট।
ইত্তিরিয়ামের ব্যবহার ইলেক্ট্রোড, ইলেক্ট্রোলাইটস, ইলেকট্রনিক ফিল্টারস, লেজারস, সুপারকন্ডাক্টর ও বিভিন্ন চিকিৎসা অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহৃত হয়। তবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হয় এলইডি বা ফসফরাস হিসাবে, বিশেষত টেলিভিশন সেটের ক্যাথোড রে টিউব ডিসপ্লেতে।
নিওডাইমিয়াম এবং প্রসোডিয়ামিয়াম এর ব্যবহার নবায়নযোগ্য জ্বালানী হিসাবে। উচ্চ প্রযুক্তির শিল্পে এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার রয়েছে, বিশেষত বৈদ্যুতিক যানবাহন ও হাইব্রিড গাড়িতে। পৃথিবীতে নবায়নযোগ্য জ্বালানী দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় এসব পদার্থের গুরুত্বও দিনদিন বাড়ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৮ সালে সারা বিশ্বে বিরল ধাতব উৎপাদন হয় ১ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন। অথচ এর আগের বছর উৎপাদিত হয় ১ লাখ ৩২ হাজার মে.টন। ২০১৮ সালে বিরল ধাতব উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় নতুন যুক্ত হয় আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমার। আর প্রথম বছরেই তারা বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ স্থানটি দখল করে নেয়। বর্তমানে প্রতি বছর তারা ৫ হাজার মেট্রিক বিরল ধাতু উৎপাদন করছে। বিরল ধাতু উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষস্থানটি চীনের। চীন বছরে ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন বিরল ধাতু উৎপাদন করছে। আর মাত্র ১৫ হাজার মেট্রিক টন বিরল ধাতু উৎপাদন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে তালিকার তৃতীয় অবস্থানে আর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। তারা বছরে প্রায় ২০ হাজার মে. টন বিরল ধাতু উৎপাদন করে।
পৃথিবীর বিরল ধাতুসমূহের মোট মজুদের এক তৃতীয়াংশই ভারতীয় উপমহাদেশে রয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। অথচ ভারতে বছরে বিরল ধাতু উৎপাদন হয় মাত্র ১ হাজার ৮শ মেট্রিক টন, যা মিয়ানমারের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। আর বাংলাদেশ এখনও বিরল ধাতু উৎপাদন ক্লাবে যোগ দিতে পারেনি।
বিরল ধাতু উৎপাদনকারী শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় রাশিয়ার অবস্থানও মিয়ানমারের নীচে। বছরের ২ হাজার ৬শ মে. টন বিরল ধাতু উৎপাদন করে রাশিয়ার অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। আর ভারতের অবস্থান রাশিয়ার পরের, অর্থাৎ ষষ্ট। আর তালিকার নীচের দিকের অবস্থানে রয়েছে ব্রাজিল, থাইল্যান্ড ও বুরুন্ডি। এসব দেশ বছরে প্রায় ১ হাজার মেট্রিক টন বিরল ধাতু উৎপাদন করে। মিয়ানমারের মতোই বুরুন্ডিও বিরল ধাতু উৎপাদনকারী ক্লাবের নতুন সদস্য। অথচ দেশ দুটিই স্বল্পোন্নত।
বিরল ধাতু উৎপাদনকারী টপটেন ১০ দেশের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে মিয়ানমারের প্রতিবেশী ভিয়েতনামও। তারা বছরে ৪শ মেট্রিক টন বিরল ধাতু উৎপাদন করছে।
সম্প্রতি দেশের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরের বালিতে চালানো ভূ-তাত্ত্বিক জরীপে অন্যান্য মূল্যবান পদার্থের সাথে মোনাজাইটের অস্তিত্বও পাওয়া গেছে। যার অন্যতম প্রধান উপাদান ল্যান্থানাইড। এরআগে ১৯৬৮ সালে ‘দেশের দক্ষিণ-পূব উপকূলীয় অঞ্চলের বালিতে ভারি খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, জরীপ, বালির নমুনা বিশ্লেষণ, খনিজের পরিমাণ নির্ধারণ’ বিষয়ে ৫৫০ কি.মি ব্যাপী সৈকতে দুইজন অস্ট্রেলীয় বিশেষজ্ঞের সহায়তা চালানো ভূ-তাত্ত্বিক জরীপেও মোনাজাইটের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। জরীপে কক্সবাজার, মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও কুয়াকাটা সৈকতের বালিতে মোট ১৭,৩৫২ মেট্রিক টন মোনাজাইটের মজুদ পাওয়া যায়। যার অর্ধেকই বিরল পদার্থে ভরপুর।
সম্প্রতি কক্সবাজারের ভূ-গর্ভস্থ বালিতে থাকা মোনাজাইটে উচ্চমাত্রায় (১৬%) ইউরোনিয়ামের অস্তিত্ব ধরা পড়ে জাপান, সুইডেন ও ত্রিশালস্থ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের গবেষণায়। ইউরেনিয়াম পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহৃত হয়। জ্বালানী হিসাবে ইউরেনিয়ামের শক্তি তেল অথবা কয়লা তুলনায় ২০ লাখ থেকে ৩০ লাখ গুণ বেশি।
দেশের সমুদ্র উপকূলীয় ও নদীবাহিত বালিতে অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণসম্পন্ন খনিজ, বিশেষ করে সিলিকা সমৃদ্ধ বালি নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে ভূ-তাত্ত্বিক জরীপ অধিদপ্তরও।
এবিষয়ে ভূ-তাত্ত্বিক জরীপ অধিদপ্তর এর পরিচালক (ভূতত্ব) ড. সাইদুল হোসেন বলেন, আমাদের খনিজ বালিতেও পৃথিবীর বিরল পদার্থ থাকতে পারে। এনিয়ে এখন জরীপ চলছে।
তিনি বলেন, আমরা জরীপ করে খনিজ সম্পদের সন্ধান করি, আর তাকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব পরমাণু শক্তি কমিশনের।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কক্সবাজারস্থ পরমাণু শক্তি কমিশনের খনিজ বালি আহরণ কেন্দ্রের পরিচালক ড. মো. রাজিব বলেন, পৃথিবীর অল্প সংখ্যক জাতিই পরমাণু প্রযুক্তি অর্জন করতে পেরেছে। তাদের অবস্থানে পৌঁছাতে আমাদের ১শ থেকে ২শ বছর সময়ের দরকার।
প্রসঙ্গত বাংলাদেশে পারমাণবিক শক্তির উন্নয়নে পাবনার রূপপুরে রাশিয়ার সহযোগিতায় ২টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করছে সরকার। ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্র দুটি ২০২৩ ও ২০২৪ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে এ দুটি কেন্দ্রে জ্বালানী হিসাবে বিদেশী উপকরণই কেবল ব্যবহৃত হবে।
অন্যদিকে ২০১৩ সালের ২৯ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ কোন দ্বীপে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন।
আমাদের দেশের মাটিতে ও সমুদ্রের পানিতে থাকা মূল্যবান খনিজ পদার্থগুলো প্রযুক্তিগতজ্ঞানের উন্নয়নের মাধ্যমে জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার নিশ্চিত করার উপর জোর দেন দেশের প্রবীণ পরমাণু বিজ্ঞানী ও পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক পরিচালক ড. মোহাম্মদ মীর কাশিম। পরমাণু বিজ্ঞানী মরহুম ড. ওয়াজেদ মিয়ার এই সহপাঠী বলেন, তাহলেই জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সফল হবে। পরমাণু বিজ্ঞানী মরহুম ওয়াজেদ মিয়ার স্বপ্নও সফল হবে।
এবিষয়ে জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও ব্লু-ইকনোমি সেলের প্রধান ড. গোলাম শফিউদ্দিন বলেন- দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য গবেষণার উপর জোর দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। আশা করি, দেশের খনিজ বালিতে পাওয়া মূল্যবান পদার্থ নিয়েও দেশে গবেষণা হবে।

পাঠকের মতামত: