ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

চকরিয়ায় সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় করে জ্বালানি সংগ্রহ, যাচ্ছে তামাক চুল্লিতে

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::  কক্সবাজারের চকরিয়ায় প্রতিবছরের মতোই এবারও ফসলি জমি দখল করে নিয়েছে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাকের আগ্রাসন। তামাক আবাদ বন্ধে ইতোপূর্বে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উপরন্তু দিন দিন এখানে বেড়েছে তামাকের আগ্রাসন। আবার মাতামুহুরী নদীর দুই তীরের সরকারী খাস জমিতেও ব্যাপকভাবে চাষ হয়েছে তামাকের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত কোন অবস্থাতেই তামাক চাষ বন্ধ করা যাবে না। কেননা তামাক চাষে পরিবেশ, চাষিসহ পরিবার এবং আশপাশের মানুষের শারিরিক ক্ষতি হলেও কোম্পানীগুলোর লোভ দেখানো ফাঁদে পড়ে তামাক আবাদের দিকেই ঝুঁকছে চাষিরা। এতে প্রতিবছরই বাড়ছে তামাকের পরিধি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চকরিয়ায় কম করে হলেও প্রায় ৮ হাজার একর জমিতে এবারও চাষ হয়েছে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাকের। আর এসব তামাক শোধন করতে গিয়ে হাজারো চুল্লিতে জ্বলছে বনের কাঠ। এতে আরো বেশি উজাড় হয়ে যাচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগান। ব্যক্তি মালিকানাধীন কৃষি জমির পাশাপাশি তামাক আবাদের ভয়াবহ আগ্রাসন চলছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও মাতামুহুরী নদীর দুই তীরে জেগে উঠা খাস জমিতে। সরকারী নির্দেশ উপেক্ষা করে চকরিয়া উপজেলার বমুবিলছড়ি ইউনিয়নের বমু বনবিট ও সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়নের মানিকপুর বনবিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এবং উপজেলার মাতামুহুরী নদী তীরের বমু বিলছড়ি, সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, কৈয়ারবিল, বরইতলী ও চিরিঙ্গা ইউনিয়নের বিপুল পরিমাণ খাস জমিতে তামাক চাষ চলছে।
জানা গেছে, সরকারি হিসেবে উপজেলায় আগের চেয়ে কম পরিমাণ জমিতে তামাক চাষ করা হচ্ছে বলে কৃষি বিভাগ দাবি করলেও বাস্তবে দেখা গেছে তামাক চাষের পরিধি অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার বেড়ে গেছে।
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর মতে, চকরিয়ায় উপজেলায় প্রায় ৮ হাজার একর জমিতে তামাক চাষ করা হচ্ছে। একই সাথে বনাঞ্চলের আশপাশে ও লোকালয়ে কয়েক হাজার তামাক চুল্লি নির্মাণ করা হয়েছে। বৃটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ঢাকা টোব্যাকো, আবুল খায়ের টোব্যাকো ও রাঙ্গুনিয়া সমিতিসহ অসংখ্য তামাক কোম্পানী চাষিদের প্রলোভনে ফেলে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষে মাঠে নামিয়েছে।
সংগঠনগুলোর গবেষণা কর্মকর্তাদের ধারণা, টোবাক্যো কোম্পানীগুলোর লোভনীয় ফাঁদে পড়ে কৃষকরা প্রায় ৮ হাজার একর জমিতে এ বছর তামাকের চাষ করেছে। প্রতিবছর তামাক চাষের পরিধি বাড়তে থাকায় উপজেলার আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এতে করে চরমভাবে হুমকির মুখে পড়েছে উপজেলার খাদ্য নিরাপত্তা। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামীতে খাদ্য উদ্বৃত্ত এ উপজেলায় চরম খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে বলে দাবি করেছেন কৃষি সচেতন মহল।
জানতে চাইলে পরিবেশবাদী সংগঠনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এ বছর চকরিয়া উপজেলার অন্তত ১০টি ইউনিয়নে প্রায় আট হাজার একর জমিতে তামাকের আগ্রাসন চলছে। তন্মধ্যে সংরক্ষিত বনের কিছু অংশ এবং মাতামুহুরী নদীর দুই তীরের খাস জমি মিলিয়ে আরো এক হাজার একর জমিতে তামাকের আবাদ শুরু হয়েছে। তামাক কোম্পানীগুলোর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা চাষিদেরকে প্রলোভনে ফেলে দীর্ঘদিন ধরে এখানে তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করে আসছেন। এমনকি বিনাসুদে ঋণ দেওয়া ছাড়াও তামাক ক্রয়ের সময় ভাল দাম দেওয়ার কথা বলায় প্রতিবছর পরিবেশ বিধ্বংসী এ চাষে সম্পৃক্ত করছেন চাষিদেরকে।’
তিনি আরো বলেন, ‘তামাক চাষের কারণে জমিতে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক প্রয়োগের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। একই সাথে তামাক শোধন কাজে জ্বালানি কাঠ ব্যবহার হওয়ায় প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে সরকারি সংরক্ষিত বনাঞ্চল, সামাজিক বনায়ন ও ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগানের মুল্যবান বৃক্ষরাজি। তামাক চাষের পরিধি বেড়ে যাওয়ায় এ উপজেলায় প্রতিবছর কমছে আবাদি জমির পরিমাণ। এ কারণে রবি শষ্য ও ধান চাষাবাদে চরম ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে নিরাপদ খাদ্য নিরাপত্তা।
জানা গেছে, উপজেলার সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, বমুবিলছড়ি, লক্ষ্যারচর, ফাসিয়াখালী, কৈয়ারবিল ও বরইতলী ইউনিয়নে এবং পৌরসভার আংশিক এলাকায় গত এক দশক ধরে ফসলি জমিতে ভয়াবহ তামাকের আগ্রাসন ছড়িয়ে পড়েছে। বরইতলী ও হারবাং ইউনিয়নে যেখানে গোলাপসহ রকমারী ফুলের চাষ হতো, সেখানেও তামাকের বিস্তৃতি পরিলক্ষিত হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের নীরবতার সুযোগে প্রতিবছর এখানে বেড়ে চলছে তামাক চাষের পরিধি। প্রতিবছর তামাক চাষের ভয়াবহ বিস্তারের কারণে উপজেলার এসব ইউনিয়নে হ্রাস পাচ্ছে আবাদি জমির পরিমাণ। এতে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে আগামীতে এ অবস্থা বিদ্যমান থাকলে উপজেলায় চরম খাদ্য ঘাটতি হবে।
বিগত সময়ের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, তামাক চাষ অধ্যুষিত এলাকার লোকজনের মাঝে দেখা দিয়েছে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব। এতে করে এলাকার পরিবেশও চরমভাবে বিষিয়ে উঠেছে। দাবি উঠেছে, লোকালয় থেকে তামাক শোধনের চুল্লিগুলো নির্জন এলাকায় সরিয়ে নিয়ে মানুষকে স্বাভাবিক জীবন-যাপন তথা শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার।
চকরিয়া পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম সভাপতি মাহমুদুর রহমান মাহমুদ চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘তামাক চাষকে নিরুৎসাহিত করতে প্রশাসনের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও মাঠ পর্যায়ের চাষিদের নিয়ে সচেতনতামূলক র‌্যালি, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন।
কিন্তু প্রশাসনের এই কার্যক্রম এখন তামাক কোম্পানীর দাপটে মুখ থুবড়ে পড়েছে। ফলে অতীতের মতো এবছরও উপজেলায় বেড়েছে তামাকের আগ্রাসন। পাশাপাশি তামাক শোধনের জন্য চলছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় ও ব্যক্তি মালিকানাধীন গাছ নিধন করছেন।

পাঠকের মতামত: