ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

বৈধ পথে আসছে অবৈধ সিগারেট

indexঅনলাইন ডেস্ক :::

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গত তিন বছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বৈধভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার ইজি ও মনড ব্র্যান্ডের এক শলাকা সিগারেটও আমদানি হয়নি। অথচ খুচরা বাজারে এসব ব্র্যান্ডের সিগারেটের ছড়াছড়ি। একইভাবে আরও একটি িবদেশি ব্র্যান্ডের সিগারেট পাইনও এখন সহজলভ্য।
বন্দর ও বিমানবন্দরের মতো বৈধ পথ ব্যবহার করেই এসব অবৈধ সিগারেট আনছে চোরাকারবারিরা। এসব সিগারেট থেকে সরকার রাজস্বও পাচ্ছে না। গত এক বছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনা অন্তত তিনটি বড় চালান জব্দ করেছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। কাস্টমসের হিসাবে, এই তিন চালানে থাকা সিগারেটের বাজারমূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। এসব সিগারেট চোরাচালানের ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও মূল চোরাকারবারিদের হদিস পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া বিমানবন্দর দিয়ে আনা সিগারেটের চালানও জব্দ করা হচ্ছে।
কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদেশি সিগারেট দুইভাবে আমদানি করার সুযোগ আছে; সাধারণ আমদানি ও বন্ডেড ওয়্যার হাউসের মাধ্যমে। সাধারণ আমদানির মাধ্যমে সিগারেট আনতে হলে উচ্চ শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হয়। শুল্কমুক্ত সুবিধায় নির্দিষ্ট পরিমাণে বন্ডেড ওয়্যার হাউসের মাধ্যমে আমদানি করা যায়।
জানতে চাইলে কাস্টমসের সহকারী কমিশনার মুকিতুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বৈধভাবে সিগারেট আমদানিতে ৬০২ শতাংশ শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু এই শুল্ক-কর পরিশোধ করে বন্দর দিয়ে সিগারেট আমদানির নজির নেই। তবে বন্ডেড ওয়্যার হাউসগুলো শুল্কমুক্ত সুবিধায় সামান্য পরিমাণে সিগারেট আমদানি করছে। তিনি আরও বলেন, বন্দর দিয়ে যাতে অবৈধভাবে সিগারেটের চালান খালাস না হয়, সে জন্য নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ইতিমধ্যে সিগারেটের দুটি বড় চালান জব্দ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্যে দেখা যায়, গত তিন বছরে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোনো সিগারেট আমদানি হয়নি। তবে বন্ডেড ওয়্যার হাউসগুলো সিগারেট আমদানি করছে। শুল্কমুক্ত সুবিধা ব্যবহার করে এসব ওয়্যার হাউস সিগারেট আনছে। কাস্টম হাউসের হিসাবে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে শুল্কমুক্ত সুবিধা ব্যবহার করে সাতটি বন্ডেড প্রতিষ্ঠান প্রায় সাত কোটি টাকার সিগারেট আমদানি করেছে। আমদানি করা এসব সিগারেটের ওজন ছিল ২১ হাজার ৮১৪ কেজি। মোট ৫৮টি চালানে এসব সিগারেট আনা হয়।
বন্ডেড ওয়্যার হাউস হলো কূটনৈতিক বা বিশেষ সুবিধাভোগী বিদেশি নাগরিকদের কাছে বন্ড সুবিধায় আমদানি করা পণ্য বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বন্ডেড ওয়্যার হাউস লাইসেন্সিং বিধিমালার আওতায় শর্ত সাপেক্ষে এ লাইসেন্স দিয়ে থাকে। আবার নিয়মানুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণে সিগারেট, মদসহ শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা পণ্য কিনতে পারেন বিশেষ সুবিধাভোগী বিদেশি নাগরিকেরা। সিগারেট ও মদ কেনার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধাভোগী বিদেশি নাগরিকদের প্রতি মাসে ১০০ ডলার মূল্যের সমপরিমাণ পণ্য কেনার সুযোগ আছে বন্ডেড ওয়্যার হাউস থেকে। বিশেষ সুবিধাভোগী বিদেশি নাগরিক বলতে বিশ্বব্যাংক, জাইকাসহ বিভিন্ন নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তারা।
আমদানি নীতি আদেশ (২০১৫-২০১৮) অনুযায়ী, ‘আমদানিযোগ্য সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে বাংলায় সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ “ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর” স্পষ্টভাবে মুদ্রিত থাকতে হবে। তবে বন্ডেড ওয়্যার হাউস কর্তৃক সিগারেট আমদানির ক্ষেত্রে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে উক্ত রূপ সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ বাংলা ব্যতীত অন্য যেকোনো ভাষায় মুদ্রিত থাকতে হবে।’
খুচরা বাজারে বিক্রি হওয়া সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে বাংলায় সতর্কীকরণ লেখা দেখা যায়নি। বন্ডেড ওয়্যার হাউসের আমদানি করা সিগারেট খোলা বাজারে বিক্রির সুযোগ নেই। অর্থাৎ খুচরা বাজারে বিক্রি হওয়া এসব বিদেশি ব্র্যান্ডের সিগারেট অবৈধভাবে আনা হচ্ছে। খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ার ইজি ও মনড ব্র্যান্ডের সিগারেট প্রতি প্যাকেট দোকানভেদে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বছর দু-এক আগেও গুটি কয়েক দোকানে মিললেও এখন নগরের অনেক এলাকায় এসব সিগারেট পাওয়া যাচ্ছে। জিইসি মোড়ের একজন খুচরা দোকানদার প্রথম আলোকে জানান, রিয়াজ উদ্দিন বাজার থেকে তাঁরা এসব সিগারেট পাইকারি দরে কিনে আনেন।
বন্দর দিয়ে সিগারেটের চালান জব্দ করা হলেও মূল আমদানিকারক বা চোরাকারবারিকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। যেমন গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দরে ৪০ ফুট লম্বা একটি কনটেইনার থেকে বেনসন অ্যান্ড হেজেস, ইজি ও পাইন ব্র্যান্ডের ৫৫ হাজার ২০০ কার্টন সিগারেট জব্দ করেছিল কাস্টমস। এই পণ্য আনা হয় প্রসাধনপণ্য আনার নথিপত্র ব্যবহার করে। এরপর এ বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি ৪৭০ কার্টন বেনসন অ্যান্ড হেজেস ব্র্যান্ডের সিগারেট জব্দ করা হয়। এক সপ্তাহের মাথায় গত ২ মার্চ ২৮৮টি বড় কার্টনে মনড ও ইজি ব্র্যান্ডের সিগারেট জব্দ করা হয়। শুল্কমুক্ত সুবিধায় সুতা আনার নথি ব্যবহার করে এই সিগারেট আনা হচ্ছিল। এসব ঘটনায় বন্দর থানায় মামলাও হয়েছে। এসব ঘটনায় আমদানি–প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হলেও মূল আমদানিকারককে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ।
সিগারেট চোরাচালানের সর্বশেষ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বন্দর থানার উপপরিদর্শক সাজেদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘২ মার্চ সিগারেট জব্দের ঘটনায় পণ্য খালাসকারী প্রতিষ্ঠানের তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এই সিগারেট কারা আনছে, তা খুঁজে বের করতে অনুসন্ধান শুরু করেছি।’
অন্যদিকে, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আনা সিগারেটও জব্দ হচ্ছে। বিমানবন্দরে নিয়োজিত কাস্টমসের সহকারী কমিশনার রেজভী আহম্মেদ প্রথম আলোকে জানান, গত ছয় মাসে বিমানবন্দরে বিভিন্ন চালানে ১ হাজার ৮৫৪ কার্টন বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট জব্দ করা হয়েছে।

পাঠকের মতামত: