ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

আত্মসমর্পণ-ক্রসফায়ারেও ধুন্ধুমার ইয়াবা কারবার

অনলাইন ডেস্ক ::  মাদকবিরোধী কঠোর অভিযানের মধ্যেও সারা দেশে ইয়াবার ব্যাপক কারবার চলছে। গ্রেপ্তারকৃত কারবারি ও পুুলিশের তথ্য, কক্সবাজারের মিয়ানমার সীমান্ত দিয়েই দেশে ছড়িয়ে পড়ছে ইয়াবা। এখনো বছরে প্রায় ৩০ কোটি ইয়াবা পাচার হচ্ছে এই রুট দিয়ে। গত এক বছরে দেশে জব্দ হয়েছে তিন কোটি ১০ লাখ পিস ইয়াবা। মাদকবিরোধী অভিযানে কক্সবাজারসহ সারা দেশে দেড় বছরে ৪৮২ জন ইয়াবা কারবারি নিহত হয়েছে। পুলিশের উদ্যোগে গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০২ জন এবং গত ৩ ফেব্রুয়ারি ২১ জন কারবারি আত্মসমর্পণও করেছে। এত কিছুর পরও সারা দেশে হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা।

স্থানীয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, পুরনো কারবারিদের সঙ্গে নতুন সিন্ডিকেট মিলে নতুন রুটে পাচার এবং কৌশল বদলে কারবার করায় ইয়াবার প্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না। উল্টো আত্মসমর্পণসহ প্রশাসনের উদ্যোগের সুযোগ নিচ্ছে ইয়াবার গডফাদাররা। দুই দফায় আহ্বান জানানো হলেও শীর্ষ ৭৩ গডফাদারের ৪০ জনই আত্মসমর্পণ করেনি। তাদের অনেকেই আড়ালে থেকে নতুন সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। আত্মসমর্পণ করা অনেকের সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয়। অনেক ক্ষেত্রে কারবারিরা রোহিঙ্গাদেরও ব্যবহার করছে, নানা নতুন কৌশলও কাজে লাগাচ্ছে।

কারবারিদের নিত্যনতুন কৌশলের কারণে প্রশাসনের ‘আত্মসমর্পণ’ ও ‘ক্রসফায়ার’ কৌশল পেরে উঠছে না। কারবারিদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা হওয়ার কথা, গত এক বছরে তা হয়নি। এ দীর্ঘ সময়ে কারবারিরা অবৈধ লেনদেন ও কারবার আড়াল করার ‘সুযোগ’ পেয়েছে। কারবারিরা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হলেও তাদের গডফাদাররা বহাল তবিয়তে। এ নিয়ে টেকনাফে রয়েছে নানা গুঞ্জন। তবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, তারা ইয়াবার গডফাদারদের বিরুদ্ধে প্রথম দফায় ২০টি মানি লন্ডারিং মামলার প্রস্তুত নিচ্ছে। যাচাই শেষে চলতি মাসের শেষ দিকে একই দিন এই মামলাগুলো দায়ের করা হবে। পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, আত্মসমর্পণ করা এবং পলাতক থাকা কারবারিদের ব্যাপারে নজরদারি আছে। দেশ থেকে ইয়াবা দূর করার কৌশল হিসেবে কারবারিদের আত্মসমর্পণ করানো হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তাঁরা।

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, ‘মিয়ানমার থেকে বছরে ৫০ হাজার কোটি পিস ইয়াবা পাচার হয়ে আসছে। মাদক, দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্স বাস্তবায়নে আমরা মাঠে কাজ করছি। আত্মসমর্পণ তারই অংশ।’

কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন বলেন, ‘আত্মসমর্পণের শর্ত অনুয়ায়ী হেফাজতে নেওয়ার পর আইনগতভাবে কারবারিদের নজরদারিতে রাখা হয়। পরবর্তীতে মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। তাদের ব্যাপারে পরবর্তী তদন্তও হয়েছে, হচ্ছে।’

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ইকোনমিক ক্রাইম) ফারুক হোসেন বলেন, ‘প্রথম দফায় আত্মসমর্পণ করা ইয়াবা কারবারির কয়েকজনের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়ে আমরা নথিপত্র তৈরি করছি। শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলা করা হবে। একইভাবে পরবর্তীতে মামলা হবে।’ আত্মসমর্পণের পরই সবার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার কথা ছিল, সেখানে এক বছর? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘মানি লন্ডারিংয়ের মামলা করতে আগেই তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়। আমাদের লোকবল সংকট আছে। এ কারণেই দেরি।’ সিআইডির আরেকটি সূত্র জানায়, ১০২ জনের মধ্যে বড় কারবারি বলে শনাক্ত করে ২০ জনের ব্যাপারে প্রাথমিক অনুসন্ধান করা হয়েছে। ১০ জন কর্মকর্তা অনুসন্ধান করে এরই মধ্যে নথিপত্র তৈরি করেছেন।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা সমন্বিত তালিকায় কক্সবাজারের ৭৩ শীর্ষ ইয়াবা গডফাদারকে চিহ্নিত করা হয়। তাদের মধ্যে ২৪ জন প্রথম দফায় আত্মসমর্পণ করেছে। সেখানে টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির চার ভাই আবদুল আমিন, আবদুর শুক্কুর, মোহাম্মদ সফিক ও মোহাম্মদ ফয়সাল, ভাগ্নে সাহেদুর রহমান নিপু ও বেয়াই শাহেদ কামাল ছিলেন। তালিকায় ২ নম্বরে থাকা গডফাদার টেকনাফের হাজি সাইফুল করিমসহ ৯ জন পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। গত সোমবার দ্বিতীয় দফায় আত্মসমর্পণ করে ২১ জন, যার মধ্যে ওই শীর্ষ তালিকার কেউ ছিল না। বাকি ৪০ গডফাদার আত্মসমর্পণও করেনি। তবে কক্সবাজার জেলার এক হাজার ১৫৪ জন ইয়াবা কারবারির তালিকায় এখন পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করা সবার নামই রয়েছে।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, কয়েকজন তালিকাভুক্ত ইয়াবা গডফাদার এখনো প্রকাশ্যে চলাফেরা করছে। ওই তালিকায় ১ নম্বরে নাম ছিল সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদির। তাঁর ভাই টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর মৌলভি মুজিবুর রহমান, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ, তাঁর ছেলে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহজাহান মিয়া, টেকনাফ জালিয়াপাড়ার জাফর আলম ওরফে টিটি জাফর, সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা রফিক উদ্দীন, তাঁর ভাই বাহারছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাওলানা আজিজ উদ্দীন ও টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নাজিরপাড়ার নুরুল হক ভুট্টো এখনো আত্মসমর্পণ তালিকার বাইরে। তাঁদের মধ্যে শাহজাহান মিয়া গত বছর বেনাপোলে এবং নুরুল হক ভুট্টো সম্প্রতি কক্সবাজার পুলিশের হাতে আটক হন বলে জানা গেছে। জাফর আলম ওরফে টিটি জাফর দীর্ঘদিন ধরে থাইল্যান্ডে। ছোট সারির বিক্রেতারা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হলেও চিহ্নিত গডফাদাররা ‘নিরাপদে’ থাকায় স্থানীয় লোকজনের মধ্যে বিভিন্ন গুঞ্জন চলছে। কেউ কেউ বলছে, প্রশাসনের সঙ্গে ‘সমঝোতায়’ আত্মসমর্পণ করেছে এক দল এবং আরেক দল ‘বেশি সমঝোতা’ করে আত্মসমর্পণ ছাড়াই বহাল হচ্ছে।

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, শীর্ষ ইয়াবা কারবারিদের তৈরি করা সিন্ডিকেটের সঙ্গে নতুন কিছু কারবারি যুক্ত হয়েছে। কৌশল, রুট ও বহনকারী পরিবর্তন হয়েছে। কারাগারে বসে এবং আত্মগোপনে থেকে শীর্ষ কারবারিরাই নিয়ন্ত্রণ করছে ইয়াবা কারবার। এখন সাগরপথে টেকনাফের লোকালয় এড়িয়ে এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের দিয়ে কারবার চালানো হচ্ছে বলে জানায় একাধিক সূত্র। আত্মসমর্পণকারী কারবারি আবু তাহেরের কক্সবাজারের তারাবুনিয়ার বাড়িতে গত বছরের ২ মে অভিযান চালিয়ে ৬০ হাজার পিস ইয়াবাসহ পরিবারের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তাহের সিন্ডিকেটের সদস্য টেকনাফের হ্নীলার বাসিন্দা হাসান মুরাদ, পারভেজ ও কাইসার। তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি হ্নীলা রঙ্গিখালী লামাপাড়ার সরওয়ার কামাল ওরফে সরওয়ার শাহীন, নুর আহমদ ওরফে আবছার ও হেলাল টেকনাফের হ্নীলা বাসস্টেশনে ভিশন শোরুমের গাড়িতে করে ইয়াবা পাচার করেন। নতুন গডফাদারদের মধ্যে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের তানজিমারখোলার জয়নাল আবেদীন, সুলতান আহমেদ, ফজল কাদের ও রমজানুর রহমান অন্যতম বলে জানায় সূত্র।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হলে ২০১৮ সালের ১৫ মে থেকে গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে ৪৮২ জন কারবারি। এর মধ্যে র‌্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ ১৩৪ জন, পুলিশের ‘ক্রসফায়ারে’ ২৩১ জন এবং বিজিবির ‘ক্রসফায়ারে’ ৫৮ জন নিহত হয়েছে। আরো ৩৭ জনের লাশ পাওয়া যায়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে এসব তথ্য জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাটি। কক্সবাজার জেলা পুলিশ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ২০১৮ সালে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হলে কক্সবাজারেই ‘বন্দুকযুদ্ধ’ এবং ‘নিজেদের গোলাগুলিতে’ ২১৮ জন নিহত হয়েছে। এর পরও ঘৃণ্য কারবার বন্ধ করা যায়নি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশে তিন কোটি ১০ লাখ দুই হাজার ৮২৯ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ২০১৮ সালে ইয়াবা উদ্ধার হয় পাঁচ কোটি ৩০ লাখ ৪৮ হাজার ৫৪৮ পিস। জাতিসংঘের মাদকবিষয়ক দপ্তর ইউএনওডিসির তথ্য মতে, যে পরিমাণ মাদকদ্রব্য জব্দ হয় তার কমপক্ষে ৯ গুণ পাচার হয়ে থাকে। গত বছর ডিএনসির বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের মধ্যে ৪২.৩ শতাংশই ইয়াবায় আসক্ত ছিল। ২০১৭ সালে ছিল ৩৫.৫৪ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৩১.৬১ শতাংশ এবং ২০১৫ সালে ২০.৬৪ শতাংশ।তথ্য সুত্র: কালের কন্ঠ

পাঠকের মতামত: