ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

দাম নেই লবণের, রক্তচোষাদের ফাঁদে চাষিরা

#ক্যামিকেল আইটেমের আড়ালে সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি
#৮ সিন্ডিকেটের কবলে দেশীয় লবণশিল্প
#উৎপাদন খরচের অর্ধেক বিক্রয় মূল্য

ইমাম খাইর, কক্সবাজার ::
লবণ চাষি, ব্যবসায়ী ও মিলারদের অপত্তিতেও থামছে না লবণ আমদানি। পর্যাপ্ত লবণ মজুদের মাঝেও ৮ জনের শক্তিশালী সিন্ডিকেট সর্বদা তৎপর। বন্ডেড ওয়্যার হাউজ এর আওতায় ব্যাক টু ব্যাক এলসি এবং ট্যাক্স ফাঁকির মাধ্যমে ক্যামিকেল আইটেমের আড়ালে সোডিয়াম সালফেটের নামে সোডিয়াম ক্লোরাইড (খাবার লবণ) আমদানী করছে। চাহিদার তুলনায় লবণের সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়ে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। ফলে দেশীয় লবণ চাষীরা ন্যায্য মূল্য বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্থ। অন্যদিকে বিভিন্ন পন্থায় অবৈধভাবে লবণ আমদানী করায় সরকারও হারাচ্ছে রাজস্ব। শুধু একটি আমদানিচক্রের কারণে লবণ শিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হচ্ছে।
চাষিদের ১ কেজি লবণ উৎপাদনে খরচ পড়ে প্রায় সাড়ে ৬ টাকায়। অথচ সেই লবণের বাজার মূল্য ৪ টাকা। আবার একই লবণ সিন্ডিকেটের হাত বদলে ‘প্যাকেটজাত আয়োডিনযুক্ত’ ব্রান্ড লাগিয়ে ঘুরেফিরে বাজারে বিক্রি করা হয় কেজি প্রতি ৪০ টাকা। কেন এত তফাৎ?
লবণমিল মালিকদের দাবী, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বিসিকের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজসে দেশীয় লবণ শিল্পকে ধ্বংস ও দেশকে আমদানি নির্ভর করে তোলার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে চিহ্নিত একটি চক্র।
বড় মিল নামধারী কিছু লবণ মিল মালিক সিন্ডিকেট করে নানা অজুহাতে সরকারকে ভুল তথ্য দিয়ে কেজিপ্রতি প্রায় ৪০টাকায় বিক্রয় করছে। অথচ মাঠ পর্যায়ে ১ কেজি লবণের দাম ৪ টাকার মতো। সিন্ডিকেটের পকেটে ঠিকই লাভ ঢুকলেও বঞ্চিত চাষিরা। উৎপাদন খরচের অর্ধেকও দাম পাচ্ছে না তারা।
সাধারণ মানুষের প্রশ্ন- দেশীয় লবণশিল্পকে ধ্বংস করে কার স্বার্থে আমদানি? একটি চিহ্নিত গোষ্ঠীকে নাকি একটি শিল্পকে বাঁচানো গুরুত্বপূর্ণ?
যে লবণ শিল্প সারা দেশের চাহিদা মেঠাচ্ছে, সে লবণ শিল্প হুমকির সম্মুুখিন। চাষের প্রতি আগ্রহ কমে গেছে চাষিদের। মিলারেরা হতাশ ও দিশেহারা। এখন পর্যন্ত অনেক লবণ মাঠ খালি পড়ে আছে। এক কথায় পুরো শিল্পটা আজ হুমকির সম্মুখীন।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কক্সবাজারের লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প কার্যালয়ের সুত্র মতে, -২০১৯-২০ মৌসুমে বিসিকের চাহিদা ১৮ লাখ ৪৯ হাজার মে.টন। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৫০ হাজার মে.টন।
কক্সবাজার জেলায় উৎপাদনযোগ্য লবণ জমির পরিমাণ ছিল ৬০ হাজার ৫৯৬ একর। চাষির সংখ্যা ২৯ হাজার ২৮৭ জন। জেলায় লবণমিলের সংখ্যা প্রায় ৮০টি।
৩১ জানুয়ারী পর্যন্ত জেলায় লবণ উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার মে. টন। গত মৌসুমে (২০১৮-১৯) ঠিক এই সময়ে মাঠ পর্যায়ে লবণ উৎপাদন কয় ১ লাখ ৫৯ হাজার মে. টন। ওই বছরের লক্ষ্যমাত্রা ১৮ লাখ ৫০ হাজার মে. টনের বিপরীতে উৎপাদন হয়েছিল ১৮ লাখ ২৪ হাজার মে.টন। যা বিগত ৫৮ বছরের লবণ উৎপাদনের রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
লবণ মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশীয় লবণশিল্প বিরোধী একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। ৮ সিন্ডিকেটে রয়েছে -মোল্লা, এসিআই, ফ্রেশ, তীর, খ্রিস্টাল, পুবালী, কনফিডেন্স ও মধুমতি। এই বড় শিল্পগ্রুপগুলোর সাথে পেরে উঠছে না দেশী লবণশিল্প। ফ্রি ট্যাক্সে ‘ফিনিশ লবণ’ আমদানি করে তারা কম দামে বাজারে ছাড়ছে। যে কারণে মার খাচ্ছে স্থানীয় লবণ। এক সময় যারা জেলার একমাত্র লবণশিল্প নগরী ইসলামপুর থেকে লবণ ক্রয় করতো তারাও আজ বিমুখ। এখন আমদানি করতে বাইর থেকে। ইসলামপুরকেন্দ্রিক বৃহৎ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ঢিমেতালে ছোটখাটো প্রতিষ্ঠানসমূহ।
এ বিষয়ে কথা হয় কক্সবাজার লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি রইচ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি ক্ষোভ ও হতাশা নিয়ে দেশীয় লবণশিল্পের চিত্র তুলে ধরেন। অনেক অন্যায়, দুর্নীতি ও অসঙ্গতির কথাও জানান।
কক্সবাজার নিউজ ডটকম (সিবিএন) এর মাধ্যমে স্থানীয় লবণচাষি ও ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে কিছু প্রস্তাবনাও পেশ করেন লবণ মিল মালিক সমিতির এই নেতা।
রইচ উদ্দিনের মতে, জনস্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর সোডিয়াম সালফেট আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে। যদি নেহাতই অন্য শিল্পের জন্য প্রয়োজন হয়, তাহলে তার উপর ২০০% করারোপ করা দরকার। সোডিয়াম সালফেটের নামে সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি যেন না হয়।
কক্সবাজার কেন্দ্রীক ‘লবণ বোর্ড’ গঠন দীর্ঘদিনের দাবী।
সরাসরি মাঠ থেকে ন্যায্যমূল্যে অন্তত ২ লাখ মেট্রিকটন লবণ ক্রয় করে সরকারীভাবে আপদকালীন মজুদ গড়ে তুলতে হবে।
চাষিদের বাঁচাতে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের একটি নিয়মে আনা দরকার। মন্ত্রণালয় বা অন্য কোন সরকারী সংস্থার আওতায় নিবন্ধিত করতঃ তাদের কমিশন নির্দিষ্ট করে দেয়া যেতে পারে।
উৎপাদন মৌসুমের শুরুতে লবণ চাষীদেরকে সরকারীভাবে পলিথিন সরবরাহ করা হোক। লবণ মৌসুম চলাকালীন বিশেষ উৎসাহ-সহায়তা হিসেবে চাউল বরাদ্দ করতে হবে, যাতে করে তারা অভাবের তাড়নায় মধ্যসত্বভোগী বা মহাজনের কবলে না পড়ে।
বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের প্রয়োজনে প্রচুর জমি অধিগ্রহণ করায় লবণ চাষের মূল জমির পরিমাণ কমে এসেছে। বেকার হয়ে গেছে চাষিরা। বিভিন্ন উপকূল সংলগ্ন নতুন করে জেগে ওঠা চরের জমি সত্যিকার লবণ মিলার ও লবণ চাষীদেরকে সহজ শর্তে বন্দোবস্তীর ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে করে উক্ত জমিগুলো লবণ চাষের উপযোগী করে লবণ চাষের আওতা বৃদ্ধি করা যায়।
এ প্রসঙ্গে বিসিক কক্সবাজারের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মোঃ হাফিজুর রহমান বলেন, লবণশিল্প বাঁচাতে অনেক পরিকল্পনা নিয়েছি। চৌফলদন্ডিতে পাইলট প্রকল্প চলছে। চাষিদের মাঠে নামানোর ব্যাপারে ব্যাপাক মোটিভেশনাল প্রেগ্রাম অব্যাহত আছে। ভূমিমূল্য কমানোর পদ্ধতির কথাও ভাবা হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রান্তিক চাষিদের প্রণোদনামূলক ক্ষুদ্র দিতে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। শীগ্রীই একটা ভাল ফলাফল আসবে বলে মনে করছেন বিসিকের এই কর্মকর্তা।
সিন্ডিকেটের প্রতারণার ধরণ:
সোডিয়াম সালফেট আমদানী করে তা ভোজ্য লবণের সাথে মিশিয়ে বিক্রয় হচ্ছে, যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। লবণ শিল্পের জন্য সোডিয়াম সালফেট এর কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। অন্য শিল্পের নাম করে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সোডিয়াম সালফেট আমদানি করে সরকারী রাজস্ব ফাঁকি দেবার পাশপাশি, অতি মুনাফার লোভে ভোজ্য লবণ হিসেবে বিক্রয় করে জনস্বাস্থের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে।
লবণ চাষীদের নিকট হতে লবণ ক্রয় করে লবণ মিল ও ট্রলারের মালিকেরা যারা বিভিন্ন মোকামে এবং পাইকারী ও খুচরা বাজারে বিক্রয় করে। এখানে লবণচাষী এবং লবণ মিল ও ট্রলারের মালিকদের মাঝখানে কিছু ব্যক্তি মধ্যস্থতাকারী তথা মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে আবির্ভূত হয়, যারা চাষীদের নিকট হতে স্বল্পদামে লবণ ক্রয় করে লবণ মিল ও ট্রলারের মালিকদেরকে বিক্রয় করে এবং চাষীদেরকে মূল্য প্রদানের সময় তাদের মনগড়াভাবে মার্জিন/কমিশন কেটে নেয়। এসব মধ্যস্বত্বভোগীদের নিকট অনেকটা জিম্মি হয়ে থাকার কারণে, চাষীদের কিছুই করণীয় থাকেনা। দীর্ঘদিন ধরে নিরীহ লবণ চাষীরা এদের কারণেই লবণের ন্যায্য মূল্য হতে বঞ্চিত ও হয়রানির শিকার হয়ে আসছে।
চাষীদের লবণের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ ও সংশ্লিষ্ট সকলের ব্যবসায়িক সুবিধার্থে লবণ ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ঠ মধ্যস্বত্ত্বভোগিদের মন্ত্রণালয় বা অন্যকোন সরকারী সংস্থার নিবন্ধনের আওতায় এনে তাদের কমিশন-নির্ধারণ করে দিয়ে প্রয়োজনীয় মনিটরিং এর ব্যবস্থা করা বাঞ্চনীয়। এতে করে চাষীদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের স্বার্থ -উভয়ই রক্ষা হবে।
২০১৭ সালে ‘বাফার স্টক’ গড়ে তোলার জন্য সরকার জাতীয় লবণনীতি-২০১৬ এর আলোকে পদক্ষেপ নেবার ঘোষণা দেয়।

পাঠকের মতামত: