ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

বৃহত্তর চট্টগ্রামে ২০ হাজার চীনা নাগরিক নিয়ে শঙ্কা সর্বাত্মক প্রস্তুতি, তিন হাসপাতালে আলাদা ওয়ার্ড

নিউজ ডেস্ক :: সারা দেশে প্রায় লক্ষাধিক চীনা নাগরিক বাস করেন।  বৃহত্তর চট্টগ্রামে বাস করেন প্রায় ২০ হাজার। তবে সঠিক সংখ্যা কত তা কারো জানা নেই। এর মধ্যে বৈধর পাশাপাশি অবৈধও অনেক। করোনা ভাইরাস নিয়ে হুমকি এসব নাগরিক। সম্প্রতি শুরু হওয়া চাইনিজ নিউ ইয়ার উপলক্ষে বিপুল সংখ্যক চীনা দেশে বেড়াতে গেছে। এরা ফিরে আসতে শুরু করলে পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেয় তা নিয়ে শংকা প্রকাশ করা হয়েছে।
তবে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে পৃথক ওয়ার্ড তৈরির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, কক্সবাজার, মাতারবাড়ি, পদ্মা সেতু প্রকল্প, পায়রা বন্দর, চীনা ইকোনমিক জোন, মীরসরাই ইকোনমিক জোন, কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্পে অনেক চীনা নাগরিক কাজ করছেন। এছাড়া চীনা বিনিয়োগে গড়ে ওঠা গার্মেন্টসে বিপুল সংখ্যক চীনা নাগরিক আছে। তৈরি পোশাক খাত, কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল, ওভেন ও নিটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি, সোয়েটার ফ্যাক্টরি, বায়িং হাউস, মার্চেন্ডাইজিং এবং ফ্যাশন ডিজাইনে আছে অনেক চীনা নাগরিক। সারা দেশে চীনা নাগরিকের সংখ্যা কত, তার হিসাব কারো কাছে নেই। তবে ধারণা করা হয়েছে, লক্ষাধিক চীনা নাগরিক বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছেন। বৃহত্তর চট্টগ্রামে এই সংখ্যা বিশ হাজারের বেশি হতে পারে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশে বসবাসকারী চীনা নাগরিকদের অধিকাংশ অবৈধভাবে শ্রম সেক্টরে জড়িত। এরা ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে দেশে প্রবেশ করে দিনের পর দিন কাজ করে। দিনকয়েকের জন্য চীন গিয়ে আবার ফিরে আসে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে হাজার হাজার চীনা শ্রমিক-কর্মচারী অবৈধভাবে শ্রম দিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীনের করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে নিয়ে আসার ব্যাপারে বিপুল সংখ্যক চীনা হুমকি। গত ১৯ জানুয়ারি থেকে চীনে নিউ ইয়ার শুরু হয়েছে। আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত চীনে সরকারি ছুটি চলছে। এর বাইরে স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছুটি এক মাস পর্যন্ত থাকে। এটা চীনা নাগরিকদের বড় একটি উৎসব। নিউ ইয়ারকে সামনে রেখে গত ১০ জানুয়ারি থেকে বিপুল সংখ্যক চীনা নাগরিক দেশে বেড়াতে গেছেন। বাংলাদেশে বসবাসকারী চীনাদের অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ দেশে বেড়াতে গেছেন। আগামী ৩১ তারিখের পর ফিরতে শুরু করবেন। সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, এরা ফিরলে পরিস্থিতি কী হবে? এছাড়া বাংলাদেশে একেকটি বাসায় ১৫/২০ জন পর্যন্ত চীনা নাগরিক বসবাস করেন। এতে করে এদের কেউ করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হলে তা দ্রুত সংক্রমিত হবে।
চট্টগ্রাম রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড) ও কর্ণফুলী রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের বিভিন্ন কারখানায় প্রায় দুই হাজার চীনা নাগরিক কাজ করেন জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলেন, এদের অনেকেই ইপিজেডের ভেতরে থাকেন। কেউ কেউ বাইরে বাড়িভাড়া নিয়ে বাস করেন। নগরীর খুলশীতে বসবাসকারী বিদেশিদের সিংহভাগই চীনা নাগরিক। কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পে চারশ চীনা নাগরিক কাজ করছেন। আনোয়ারা উপজেলায় চীনা ইকোনমিক জোন, মীরসরাই উপজেলায় বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর এবং কঙবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প, পদ্মা সেতু প্রকল্প, পায়রা বন্দর প্রকল্পসহ বিভিন্ন স্থানে কাজ করছেন অনেক চীনা নাগরিক।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিকে গুরুত্বের সাথে দেখছে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের চীনা নাগরিকদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ শুরু করা হয়েছে। সিভিল সার্জন শেখ ফজলে রাব্বি দৈনিক আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামে ঠিক কতজন চীনা নাগরিক আছেন তার তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে চীনা নাগরিক কোথায় কোথায় কাজ করেন তার কিছু তথ্য আমরা পেয়েছি। তাদেরকে দেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করছি। সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং কোম্পানি গুলোর কাছে আমরা প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়েছি। আবার যারা চীনে গেছেন তাদের ফেরার সময় যথাযথভাবে স্ক্যানিং করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে গত দুই সপ্তাহের মধ্যে যারা চীন থেকে এসেছেন তাদের ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছি।
আতংকিত না হয়ে সচেতন হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে সিভিল সার্জন বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা গুরুত্বের সাথে বিষয়টি দেখছি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি হাসপাতালে প্রতিটি পাঁচ শষ্যার করে পৃথক তিনটি বিশেষায়িত ওয়ার্ড চালুর নির্দেশ দিয়েছি। চট্টগ্রামের প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালকেও করোনা ভাইরাস নিয়ে সতর্ক থাকতে বলেছি।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির বলেন, আমাদের প্রস্তুতি চলছে। এটা নিয়ে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। আবার উদাসীন থাকারও সুযোগ নেই। প্রতিটি এন্ট্রি পয়েন্টে আমাদের চিকিৎসক টিম কাজ করছে। আমরা চীন থেকে আসা যাত্রীদের শরীরের টেম্পারেচার নিচ্ছি। চট্টগ্রাম বন্দর, বিমানবন্দর, নৌবন্দর, স্থলবন্দরসহ যেসব প্রবেশপথ আছে সবগুলোতেই স্ক্যানিংয়ের ব্যবস্থা থাকছে। দূর থেকে কিংবা সরাসরি শরীর থেকে তাপমাত্রা নেয়া, সর্দি-কাশি, হাঁচিসহ অন্য কোনো উপসর্গ আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করা হবে। যাদের শরীরে জ্বর পাওয়া যাবে তাদের বিশেষ ব্যবস্থায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। প্রতিটি হাসপাতালে কমপক্ষে পাঁচটি বেড বিশেষায়িতভাবে রাখা হচ্ছে। তবে গত রাত পর্যন্ত জ্বরাক্রান্ত কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি।
চট্টগ্রামের সাথে চীনের সরাসরি ফ্লাইট যোগাযোগ নেই বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ম্যানেজার উইং কমান্ডার এবিএম সারোয়ার ই জামান। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতি রয়েছে। গত ২০ জানুয়ারি থেকে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ সতর্ক অবস্থানে থেকে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিমানবন্দরে একটি চিকিৎসক টিম অবস্থান করছে।
চট্টগ্রাম বন্দরেও একটি মেডিকেল টিম কাজ করছে বলে জানিয়েছেন বন্দর সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক। চীনের যেসব জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসছে, সেসব জাহাজের নাবিকদের বিশেষ ব্যবস্থায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনও নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন গত রাতে বলেন, বিষয়টির ওপর জেলা প্রশাসন নিবিড়ভাবে নজর রাখছে। তবে চট্টগ্রামে কী পরিমাণ চীনা নাগরিক বাস করেন সেই তথ্য জেলা প্রশাসনের কাছে নেই বলে স্বীকার করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা একশ ছাড়িয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। চীনের বাইরে অন্তত ১৬টি দেশে এ ভাইরাসের বিস্তার ঘটেছে।

পাঠকের মতামত: