ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

মাতামুহুরী নদী থেকে অবৈধ ভাবে বালি উত্তোলনে হুমকিতে মূখে হাজার কোটি টাকার সম্পদ

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :: কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত মাতামুহুরী নদী ও ছড়া খালের অর্ধশত পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ ঘনফুট বালি উত্তোলন করছে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাকর্মীরা। এ ভাবে বালি উত্তোলনের কারণে গ্রামীণ জনপথ, গুরুত্বপূর্ণ বেঁড়িবাঁধ,জনবসতীসহ হাজার কোটি টাকার সম্পদ মারাত্মক হুমকির সম্পূখিন হয়ে পড়েছে।

এ ব্যাপারে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, থানা, ফাঁড়ি পুলিশ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজার (পওর) বিভাগকে স্ব-স্ব এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত জনগন বহুবার অভিযোগ দেয়ার পরও বালি উত্তোলন এখনো বন্ধ হয়নি। প্রতি ঘনফুট বালি উত্তোলনের সময় সরকারি কোষাগারে একটি নির্দিষ্ট পরিমান রাজস্ব প্রদানের নিয়ম থাকলেও তাও মানা হচ্ছেনা এ ক্ষেত্রে। সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা- কর্মচারীরা অবৈধ বালি উত্তোলনকারীদের কাছ থেকে মোটা অংকের উৎকোচ গ্রহণ করে ফ্রি স্টাইলে বালি উত্তোলনে সহায়তা করে যাচ্ছে বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন।

কক্সবাজারের বৃহত্তম উপজেলা চকরিয়া ও পার্শ¦বর্তী পেকুয়া উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহমান মাতামুহুরী নদী। এ দু’ উপজেলার ২৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় রয়েছে অসংখ্য ছড়াখাল। মাতামুুহুরী নদী ও ছড়া খালের মিঠা পানি দিয়ে নদীর দুই তীরে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন কয়েক লাখো মানুষ।

প্রতি মৌসুমে এখানকার চাষিরা জোগান দেন প্রায় ১০ কোটি টাকার বেশি শীতকালীন সবজি ও খাদ্যশস্য। নদীর পাশে আছে শতকোটি টাকার চিংড়ি ও মৎস্য খামার। একটা সময় মাতামুহুরী চাষিদের কাছে আশীর্বাদ হলেও এখন ভর করছে আতঙ্ক। কারণ, নদীতে যত্রতত্র মেশিন বসিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে বালি। এতে নদীর দুই তীরের প্রতিরক্ষা বেড়িবাঁধ ভেঙে যাচ্ছে, বিলীন হচ্ছে বসতি।

বালি উত্তোলনের ফলে নদীর ওপর তৈরি চারটি সেতু ও একটি রাবার ড্যাম ঝুঁকিতে পড়েছে। বালি উত্তোলন বন্ধ করে যোগাযোগ স্থাপনা রক্ষার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা উপজেলা প্রশাসনকে তাগাদা দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না। যাঁরা নদী থেকে বালু তুলছেন, তাঁরা কমবেশি সবাই স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।

সম্প্রতি এ দু’ উপজেলার নদী ও ছড়া খালে সরেজমিনে পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এ ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা গেছে।

বান্দরবানের লামার মাইভার পর্বত (মিয়ানমার সীমান্ত) থেকে উৎপত্তি মাতামুহুরীর। এরপর সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথে নদীটি বান্দরবানের লামা, আলীকদম ও কক্সবাজারের চকরিয়া, পেকুয়া হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। নদীটির দৈর্ঘ্য ১৭০ কিলোমিটার। এর মধ্যে চকরিয়া উপজেলায় পড়েছে ৪০ কিলোমিটার। তবে পেকুয়া, লামা ও আলীকদমের ১৩০ কিলোমিটার।

চকরিয়া ও পেকুয়ার ৫০ টি পয়েন্টে চলছে বালি উত্তোলনের কাজ। এলাকা গুলো হচ্ছে, চকরিয়া উপজেলার বমু বিলছড়ি, সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, ফাঁসিয়াখালী, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, বরইতলী, হারবাং, সাহারবিল, পূর্ব বড়ভেওলা, পশ্চিম বড়ভেওলা, কোনাখালী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী, চিরিঙ্গা, পশ্চিম বড়ভেওলা, বদরখালী,ঢেমুশিয়া ও চকরিয়া পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে মাতামুহুরী নদী ও ছড়া খালে এবং পেকুয়া উপজেলার পেকুয়া সদর ইউনিয়ন, মগনামা, টৈটং, বারবাকিয়া, শিলখালী, রাজাখালী ও উজানটিয়া ইউনিয়নে অবৈধ ভাবে বালি উত্তোলনের মহোৎসব চলছে। এসব বালি রেল লাইনসহ বিভিন্ন কাজে সরবরাহ দেয়া হচ্ছে। অবৈধ ভাবে বালি সরবরাহ দিয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করছে স্ব-স্ব এলাকার ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা।

গোবিন্দপুর পশ্চিমপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, উত্তোলন করা বালির স্তূপ পড়ছে পাশের ফসলি জমিতেই। স্থানীয় লোকজন জানান, পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মেহের আলী কয়েক মাস ধরে বালিবাণিজ্য চালিয়ে আসছেন। জানতে চাইলে মেহের আলী বলেন, এই বালি তিনি নির্মাণাধীন রেললাইনে সরবরাহ করছেন। চকরিয়ার ইউএনওর কাছ থেকে তিনি অনুমতি নিয়েছেন। তবে এর বিপরীতে কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।

গোবিন্দপুর পশ্চিমপাড়ায় বালি তুলছেন বরইতলী ইউপি সদস্য নিয়াজুল ইসলাম ওরফে বাদল। তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

মাতামুহুরী সেতুর নিচে ভরাট চর কেটে প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে ২০-৩০ ট্রাক বালি। চকরিয়া পৌরসভার তরছপাড়ায় তিনটি পয়েন্টে ড্রেজার বসিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে বালি । এখান থেকে দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে বেতুয়া বাজার এলাকার নির্মাণাধীন রেললাইন সেতুর দুপাশ থেকেও বালি তোলা হচ্ছে।

সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করে স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নদীর দিগরপানখালী ১নং বাঁধ, বাটাখালী, কাজীরপাড়া, কোনাখালী ইউনিয়নের মরংঘোনা সেতুর পশ্চিম পাশে, বাঘগুজারা রাবার ড্যামের পাশসহ অন্তত ১৪টি পয়েন্টে মেশিন বসিয়ে তোলা হচ্ছে বালি।

উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১২৬ কিলোমিটারের রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প শুরু হয়। স্থানীয় লোকজন বলেন, রেললাইনের কাজ শুরুর পর থেকে মাতামুহুরীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে বালি উত্তোলনের হিড়িক পড়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে ৫০টি পয়েন্টে অন্তত এক কোটি ঘনফুট বালি মজুত আছে। প্রতি ট্রাক বালি বিক্রি হচ্ছে ৩৩০ থেকে ৭০০ টাকায়। সরকারি হিসাবে প্রতি ঘনফুট বালুতে রাজস্ব দিতে হয় ৩৫ পয়সা। এ হিসাবে এক কোটি ঘনফুট বালিতে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার কথা।

অবৈধ ভাবে বালি উত্তোলনের কারণে ঝুঁকিতে আছে ৪টি সেতু। এ ব্যাপারে এলাকার জনগন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

 

পাঠকের মতামত: