ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

জেলায় ‘লাইসেন্স’ ছাড়াই চলছে চার শতাধিক হোটেল

আজিম নিহাদ, কক্সবাজার ::  বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ আইনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে না কোন হোটেল। অথচ কক্সবাজারে হচ্ছে সম্পূর্ণ উল্টো। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই প্রায় ৮৫ শতাংশ হোটেলই ব্যবসা করছে লাইসেন্সবিহীন সম্পূর্ণ অবৈধভাবে। বিপুল সংখ্যক হোটেল লাইসেন্সের বাইরে থাকায় সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। আইন প্রয়োগে প্রশাসনের উদাসীনতায় বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বেহাত হচ্ছে বলে দাবী সংশ্লিষ্টদের।
তথ্যমতে, সারাদেশে হোটেলের শহর হিসেবে পরিচিত কক্সবাজার। হোটেল মালিক সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, পর্যটননগরীতে প্রায় ৪০০ হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউজ, কটেজ, রিসোর্ট রয়েছে। এর বাইরে টেকনাফ এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপে রয়েছে আরও শতাধিক হোটেল-কটেজ। বেশির ভাগ হোটেলের ব্যবসা করার লাইন্সেস নেই। এমনকি অনেক হোটেল লাইসেন্স পাওয়ারই উপযুক্ত নয়। কিন্তু তবুও দিব্যি ব্যবসা করে যাচ্ছে প্রশাসনের নাকের ডগায়।
আবাসিক হোটেল ব্যবসা পরিচালনার জন্য অন্তত ৭ টি লাইসেন্স থাকতে হয়। এরমধ্যে অন্যতম জেলা প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বাণিজ্যিক লাইসেন্স। নির্দিষ্ট আইন থাকায় হোটেল ব্যবসার ক্ষেত্রে এ লাইসেন্স বাধ্যতামূলক। কিন্তু এই বাধ্যবাধকতাকে বছরের পর বছর ধরে তোয়াক্কাই করছেনা এখানকার হোটেল মালিকেরা।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ব্যবসা-বাণিজ্য শাখা দেখাশুনা করে হোটেলের লাইসেন্সের বিষয়টি। জেলা প্রশাসনের ভারপ্রাপ্ত নাজির স্বপন কান্তি পাল জানান, কক্সবাজারে শত শত হোটেল থাকলেও লাইসেন্স নিয়েছে মাত্র ৭৮ টি হোটেল। প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি হোটেল লাইসেন্স ছাড়া অবৈধভাবে ব্যবসা করছে।
তিনি আরও জানান, এক ও দুই তারকা হোটেলগুলো লাইসেন্স দেয় জেলা প্রশাসন। তিন তারকা থেকে পাঁচ তারকা হোটেলগুলো লাইসেন্স দেয় মন্ত্রণালয়। ১ থেকে ৫০ কক্ষের হোটেলগুলোকে এক তারকা এবং ৫১ থেকে ১০০ কক্ষের হোটেলগুলোকে দুই তারকা হোটেল হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। লাইসেন্সও দেওয়া হয় সেই বিবেচনায়। কক্সবাজারে অধিকাংশ হোটেলই এক ও দুই তারকা বলে দাবী করেন তিনি।
সূত্রমতে, এক তারকা হোটেলের লাইসেন্স পেতে সরকারের কোষাগারে জমা দিতে হয় ৩০ হাজার টাকা। আর দুই তারকা হোটেলের জন্য ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া নবায়নের ক্ষেত্রে এক তারকা হোটেল ৫ হাজার ও দুই তারকা ১০ হাজার টাকা। এখানকার চার শতাধিক হোটেল লাইসেন্সের বাইরে থেকে যাওয়ায় কোটি কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
লাইসেন্স রয়েছে এমন কয়েকটি হোটেল মালিকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, লাইসেন্স ছাড়া হোটেল ব্যবসা চালাতে পারার কথা নয়। হোটেল ব্যবসা করতে হলে জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু জেলা প্রশাসন আইন প্রয়োগে উদাসীন হওয়ায় লাইসেন্স না নিয়েও পার পেয়ে যাচ্ছে বেশির ভাগ হোটেল ব্যবসায়ী। লাইসেন্সের আওতায় না আসায় হোটেলগুলো শৃঙ্খলার মধ্যেও আসছে না। ব্যবসা করার ক্ষেত্রে কোন নিয়মই মানছে না। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত গ্রাহক (পর্যটক) ঠকানো হলেও জবাবদিহিতার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
কলাতলীর প্রধান সড়কে অবস্থিত হোটেল শামস প্লাজা, এসপ্ল্যানেড, ইকরা বীচ হোটেল, গ্যালাক্সী রিসোর্ট, এ ব্লকে অবস্থিত গ্রান্ড বীচ রিসোর্ট, স্বপ্ন বিলাস, টাইড ওয়াটার, সী ওয়েলকাম, সী পয়েন্ট রিসোর্ট, সী ভিউ রিসোর্ট, আমারী রিসোর্ট, সুগন্ধা পয়েন্টের বি ব্লকে অবস্থিত ইউনিটি ইন হোটেল, বে-কুইন রিসোর্ট, ব্লু-ওশান গেস্ট হাউস, হাইপেরিয়ান বে-কুইন, হোটেল এবি গার্ডেন, সাকিরা বে, সোহাগ গেস্ট হাউস, হাউপেরিয়ান সী ওয়ার্ল্ড, রীগাল প্যালেস, হোটেল এসকে কামাল সহ বেশকিছু হোটেলে লাইসেন্সের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
হোটেল এসকে কামালের জেনারেল ম্যানেজার মাইন উদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, হোটেল ব্যবসার জন্য লাইসেন্স নেওয়ার বিষয়ে তারা অবগতই নয়। এ বিষয়ে কোন সময় ডিসি অফিস বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠান থেকেও তাগাদা দেওয়া হয়নি। তাই বিষয়টি নজরে আসেনি তাদের।
সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সামনে গণপূর্তের প্লটে শতাধিক কটেজ রয়েছে। এসব কটেজের একটিতেও লাইসেন্স নেই। বেশির ভাগ কটেজ মালিক লাইসেন্স সম্পর্কে অবগতই নন। ভবন নির্মাণ করেই হোটেল ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
একইভাবে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রায় ১০০ টি হোটেল-রিসোর্ট থাকলেও লাইসেন্স আছে মাত্র দুটিতে। এগুলো হলো- ব্লু-মেরিন রিসোর্ট ও সেন্ট মার্টিন রিসোর্ট। বাকি সব হোটেলই চলছে অবৈধভাবে। এছাড়া টেকনাফেও লাইসেন্স রয়েছে মাত্র দুটি হোটেলে।
একাধিক হোটেল মালিকদের দাবী, জেলা প্রশাসন কোন সময় লাইসেন্সের বিষয়ে তাগাদা বা নোটিশ দেয়নি। চাপ না আসায় লাইসেন্স নিয়ে কারও মাথাব্যথাও নেই।
আবার কেউ কেউ দাবি করছেন, অনেকে ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করে কোন নিয়ম-কানুন না মেনেই হোটেল ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা ‘লাইসেন্স’ নেওয়ার বিষয়টি তোয়াক্কাই করছে না। এছাড়া জেলা প্রশাসনের আইন প্রয়োগে উদাসীনতার সুযোগকেও কাজে লাগাচ্ছে তারা। যারা লাইসেন্সের আওতায় রয়েছে তাদের কেবল সব নিয়ম-কানুন মানতে হচ্ছে। আর যাদের লাইসেন্স নেই তারা কোন নিয়ম-কানুনতো মানছেই না, বরং সবকিছুতেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। আইন প্রয়োগে উদাসীন মনোভাব পরিহারের দাবী জানান তারা।
তবে জেলা প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) জয়নাল আবেদিন বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি দাবী করেন, লাইসেন্সের বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করার জন্য বিভিন্ন সময় মোবাইল কোর্ট চালানো হয়। মোবাইল কোর্টে অনেক হোটেল মালিক জরিমানা আদায় করে কিন্তু লাইসেন্স গ্রহণ করে না। হোটেল মালিকদের এই মানসিকতা পরিবর্তন করা দরকার। লাইসেন্স গ্রহণ করার জন্য হোটেল মালিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সম্প্রতি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি পর্যন্ত প্রকাশ করা হয় বলেও দাবী করেন তিনি।
লাইসেন্সের বিষয়ে হোটেল মালিকেরা সচেতন নয় বলে দাবী করেন হোটেল মোটেল গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার। তিনি বলেন, বেশিরভাগ হোটেল মালিক লাইসেন্স বিষয়ে অবগত নন। তাদেরকে সচেতন করতে হবে। প্রয়োজনে প্রত্যেক হোটেলকে লাইসেন্স গ্রহণের জন্য সময় নির্ধারণ করে নোটিশ দিতে হবে। তবে কোন হয়রানি করা যাবে না। যিনি কোটি টাকা ব্যয়ে হোটেল নির্মাণ বা ব্যবসা করতে পারেন, তিনি হোটেলে ব্যবসা পরিচালনার জন্য লাইসেন্স কেন নিতে পারবেন না?
২০১৪ সালের ১৯ নভেম্বর জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ বিল-২০১৪ সংশোধিত আকারে পাস হয়। এতে জেলা প্রশাসক বা সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা হোটেল নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করবেন বলে উল্লেখ করা হয়। এ বিলে হোটেলে লাইসেন্স গ্রহণ, নবায়ন, খাদ্যমান বজায় রাখা ও ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করার বিধান রাখা হয়েছে। শর্ত লঙ্ঘনকারীকে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা জরিমানার বিধানও রাখা হয়েছে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, আইন প্রয়োগের অভাবে সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের উচিত সবাইকে আইনের আওতায় এনে লাইসেন্স নিশ্চিত করা। এজন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ওয়ান স্টপ সেবা চালু করার দাবি জানান তিনি।
পর্যটনের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার বলেন, এতগুলো হোটেলের মধ্যে মাত্র ৭৮টি হোটেলে লাইসেন্স থাকা দুঃখজনক। হোটেল মালিকদের লাইসেন্স গ্রহণে উদাসীন মনোভাব পরিহার করতে হবে। হোটেল ব্যবসা করতে হলে নিয়ম-কানুন মেনেই করতে হবে।
তিনি বলেন, যেহেতু আইন অনুযায়ী লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক। তাই হোটেল ব্যবসায়ী বা মালিকেরা দ্রুত সাড়া না দিলে তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আইনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পাঠকের মতামত: