ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

সড়কে ১ হাজার অবৈধ ডাম্পার যেন মৃত্যুদূত

এম. বেদারুল আলম ::  শীতের সকালে ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর সদরের পিএমখালীর পরানিয়াপাড়ার দিন মজুর আবদুর রহিমের ৬ বছরের শিশুকন্যা সাদিয়া পাশের নুরানী মাদ্রাসায় যেতে রাস্তা পার হওয়ার সময় লাইসেন্সবিহীন ডাম্পার চাপা দিলে ঘটনাস্থলে প্রাণ হারায় অবুঝ শিশু সাদিয়া। ডাম্পারের মালিক মোটা টাকায় পরিবারকে ম্যানেজ করে লাশ দাফন করে। ফলে মামলা করেনি পরিবার। কতিপয় পাতি নেতাদের আশ্রয়ে থাকার কারণে মামলা না করে দাফনের খরচ নিয়ে চুপসে যায় সাদিয়ার পরিবার। বেঁচে যায় প্রভাবশালী ডাম্পার মালিক।
গত ২৩ নভেম্বর চেরাংঘর বাজারে বিকাল ৪টায় ডাম্পার চাপায় প্রান হারান জুমছড়ির গিয়াস উদ্দিন। নাম্বারবিহীন ডাম্পার হওয়ায় মালিক মোটা

টাকায় গিয়াস উদ্দিনের পরিবারকে ম্যানেজ করার কারণে সেটিও মামলা হয়নি। হয়নি হত্যার বিচার।
গত ২৭ নভেম্বর বাংলাবাজারের পূর্ব মুক্তারকুলের খরুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ফাহাদ ও একই এলাকার বৃদ্ধ আবুল বাসারকে অবৈধ ডাম্পার চাপা দিলে ২ জনই নির্মম প্রাণঘাতের শিকার হন। ঝরে যায় সম্ভাবনাময়ী প্রাণ। সেটির ও মামলা হয়নি। তবে বিচার হওয়া নিয়ে স্বোচ্ছার সহপাঠিরা।

এভাবে প্রতিদিনই কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ জেলার বিভিন্ন উপ সড়কে ডাম্পার কেড়ে নিচ্ছে তাজা প্রাণ। চালক এবং মালিকদের অবহেলার কারণে মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে প্রাণহানির সারি।

প্রতিদিনই নাম্বারবিহীন অবৈধ ডাম্পারের কারণে ঘটছে সড়ক দূর্ঘটনা। সড়কে কোন ধরনের শৃংখলা না থাকায় এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের গাফেলতির কারনে বাড়ছে সড়ক দূর্ঘটনা। কক্সবাজার চট্টগ্রাম মহাসড়কের কক্সবাজার অংশে কতটি নিবন্ধিত ডাম্পার (মিনি ট্রাক) আছে ,কতজন চালককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান বিআরটিএ’র কক্সবাজার কার্যালয়ে আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে কক্সবাজার কার্যালয়ের মোটরযান পরির্দশক মোঃ আরিফুর রহমান বলেন- পুরো কক্সবাজার জেলায় সাড়ে ৯শ ডাম্পার চলাচল করলেও লাইসেন্স আছে মাত্র ১১০টির । তবে তাদের বেশিরভাগই লাইসেন্স নবায়ন না করার কারণে সড়কে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। লাইসেন্স করার জন্য বিভিন্ন উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তার মাধ্যমে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হলেও কয়েকদিন বন্ধ থাকার পর পুণরায় সড়কে চলাচল করে। লাইসেন্সবিহীন এ সব ডাম্পার বেপরোয়া গতিতে সড়কে চলাচল করলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় প্রতিদিনই সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

প্রায় ১ হাজার অবৈধ ডাম্পার কিভাবে সড়কে চলাচল করছে এবং বিআরটিএ তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছেনা কেন এমন প্রশ্নের জবাবে বিআরটিএ’র কক্সবাজারের সহকারি পরিচালক ওথোয়াই নু চৌধুরী বলেন আমরা তাদের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করি কিন্তু সেটি পর্যাপ্ত নয়। কক্সবাজারের ৭০ শতাংশ ডাম্পারের রেজিষ্ট্রেশন মেয়াদোত্তীর্ণ। তাদের নিয়মিত করার জন্য বেশ কয়েকবার চিঠি দিয়েছি কিন্তু তারা তথা শুনেনা। তিনি ট্রাফিক পুলিশের নমনীয়তার কারণে গাড়ি নিয়ন্ত্রন করা যাচেছনা বলে ও অভিযোগ করেন। প্রায় ১ হাজার ডাম্পার বিনা কাগজে কোন ধরণের নিবন্ধণ না নিয়ে সড়কে চলাচল করার কথা স্বীকার করেন।

জানা যায়, কক্সবাজার সদরে ২০০টি, রামুতে ২৫০টি, উখিয়ায় ১৪০টি, টেকনাফে ৯০টি ,চকরিয়া-পেকুয়ায় ৩০০টির মত অবৈধ ডাম্পার হরদম চলাচল করছে যার কোনটির নিবন্ধন নেই। গাড়ির পাশাপাশি সহ¯্রাধিক চালকের নেই কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স, নেই ফিটনেস সার্টিফিকেট। বিআরটিএ সবকিছু জানার পরও তাদের করার কিছু নেই বলে জানান সহকারি পরিচালক। তারা উল্টো কক্সবাজার ট্রাফিক পুলিশের নমনীয়তা এবং অবহেলাকে দায়ি করছেন।

অবৈধ ডাম্পার সড়কে চলাচল এবং তাদের বিরুদ্ধে ট্রাফিক পুলিশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিষয়ে কক্সবাজার ট্রাফিক পুলিশের সহকারি পুলিশ সুপার বাবুল চন্দ্র বণিক বলেন, শুধু অবৈধ ডাম্পার নয় সকল অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান নিয়মিত চালাচ্ছি। সম্প্রতি অবৈধ যানবাহনের কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকা জরিমানা আদায় ও করেছি। আমরা যেহেতু কক্সবাজার পৌরসভা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ সেহেতু শহরের বাইরে লিংকরোড, বাংলাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ ডাম্পার চলাচলের বিষয়টি হাইওয়ে পুলিশ বলতে পারবে। তবে তিনি বিআরটিএ’র নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা না হওয়াকে অবৈধ গাড়ি চলাচলের জন্য অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করেন। বিআরটিএ অনেক যানবাহনকে (এএফআর) রেজিষ্ট্রেশনের জন্য আবেদন করেছে বলে অনুমতি দিয়ে বছর শেষ করছে কিন্তু সেই অনুমতি নিয়েই তারা চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন। অবৈধ যান বৃদ্ধির এটাও একটা কারণ বলে মনে করেন তিনি। তবে তিনি অবৈধ যানবাহন চলাচলের বিরুদ্ধে শীগ্রই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করবেন বলে জানান।

সড়ক আইন হলেও মাঠে কার্যত এখনো অকার্যকর। পাশাপাশি বিআরটিএর আইন প্রয়োগে দূর্বলতা, ট্রাফিক পুলিশের সীমাবদ্ধতার কারণে দিন দিন যে কেউ ইচ্ছেমত ডাম্পার নামাচ্ছে সড়কে। ফলে অদক্ষ, অনিবন্ধিত ডাম্পারের কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে সড়ক দূর্ঘটনা, বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। এক হাজারের অধিক অবৈধ ডাম্পারের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল রোধ করতে না পারলে অনেক সম্ভাবনাময়ী প্রাণ ঝরে যাবে পাশাপাশি সড়ক আইন অকার্যকর হবে যার সুফল বঞ্চিত হবে সর্বসাধারণ।

পাঠকের মতামত: