ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

চট্টগ্রামে অর্ধলক্ষ যানবাহনে ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার বোমা, মানা হচ্ছে না আইন, বাড়ছে দুর্ঘটনা

অনলাইন ডেস্ক :: চট্টগ্রামে সিএনজি চালিত যানবাহনের সিলিন্ডারগুলো একেকটি চলন্ত বোমা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে নগরীসহ জেলার সড়ক-মহাসড়কে গাড়ির সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেয়াদ উত্তীর্ণ ও নিম্নমানের সিলিন্ডার ব্যবহারের কারণে গ্যাস লিকেজজনিত অগ্নিকাণ্ড ও সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো ঘটছে। সরকারিভাবে গাড়িতে ব্যবহৃত সিলিন্ডার পরীক্ষার পদক্ষেপ নেয়া না হলে এসব দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়। তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মহানগরীসহ চট্টগ্রাম জেলায় প্রায় ৭৫ হাজার যানবাহন সিএনজি ব্যবহার করছে। এর মধ্যে ৫০ হাজারের অধিক অটোরিকশা, অর্থাৎ সিএনজি টেঙি।

চুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলছেন, ‘দেশে বৈধ গাড়ির পাশাপাশি অবৈধভাবেও ফিটনেসবিহীন গাড়িতেও সিএনজি ব্যবহার হয়ে থাকে। এতে বিআরটিএ’র কোন পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ না থাকলেও গ্যাস রিফুলিং স্টেশনগুলোতে বৈধ ও টেস্টকৃত সিলিন্ডারের বাইরে গ্যাস না দেয়ার জন্য সরকারিভাবে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা গেলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। এতে অবৈধ ও মেয়াদ উত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহারের প্রবণতা কমে আসতে পারে।’

বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে বিআরটিএ থেকে নিবন্ধনকৃত ১৩ হাজার বাণিজ্যিক সিএনজি অটোরিকশা রয়েছে। এক হাজারের অধিক রয়েছে প্রাইভেট অটোরিকশা। একইভাবে জেলাতেও ৩৮ হাজারের কাছাকাছি নিবন্ধিত অটোরিকশা রয়েছে। অনিবন্ধিত অটোরিকশা রয়েছে ১০ হাজারের উপরে। সিএনজি চালিত প্রাইভেট কার ও পাজেরো রয়েছে প্রায় ১০ হাজারের কাছাকাছি। তাছাড়া নগরী ও জেলায় প্রায় দুই হাজারের বেশি বাস, হিউম্যান হলার ও ট্রাক অবৈধভাবে সিএনজি ব্যবহার করছে। চট্টগ্রামে সরকারিভাবে নিবন্ধিত তিনটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সিএনজি কনভারসন ও টেস্টিং করা হয়।

এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে সিএনজি চালিত যানবাহনগুলোতে বিস্ফোরণ ও গ্যাস লিকেজজনিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। গত ১৬ অক্টোবর চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার চাতরি চৌমুহনী এলাকায় একটি সিএনজিচালিত অ্যাম্বুলেন্সে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে চারজন নিহত হয়। এতে আরো তিনজন আহত হয়। ওইসময় চট্টগ্রামের বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে অ্যাম্বুলেন্সটিতে স্থানীয় ওয়ার্কশপের মাধ্যমে অবৈধভাবে পুরোনো ও বাতিল গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়েছে। সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা শিল্প থেকে ওই সিলিন্ডার সংগ্রহ করা হয়েছিল বলে জানানো হয়।

অন্যদিকে গত ১৭ নভেম্বর চকবাজার মোড়ে সিলিণ্ডারে গ্যাস লিকেজের কারণে একটি সিএনজি চালিত অটোরিকশায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গত ২০ জুন পটিয়া বাসস্টেশন এলাকায় মাইক্রোবাসে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নারী শিশুসহ ২০ যাত্রী আহত হয়। ২০১৬ সালে খুলশী রিফুয়েলিং স্টেশনে একটি প্রাইভেট কার গ্যাস নেয়ার সময় বিস্ফোরিত হয়। এতে গাড়ির বাইরে থাকায় দুইজন আহত হয়। ওই ঘটনার মধ্যদিয়ে সিএনজিচালিত গাড়িতে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা সামনে আসে।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নগরীতে চলাচলকারী ১৩ হাজার সিএনজি অটোরিকশার মধ্যে নতুন নিবন্ধিত ৬ হাজার অটোরিকশায় নতুন সিলিন্ডার থাকলেও অন্যগুলোতে ১০-১৫ বছরের পুরোনো সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে। অবৈধভাবে সিএনজি ব্যবহারকারী বাস, হিউম্যান হলার ও ট্রাকগুলোতে লাগানো সিলিন্ডারগুলো মেয়াদ উত্তীর্ণ ও পুরোনো।

বিশেষত চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কে চলাচলকারী প্রায় ৩ শতাধিত মাইক্রো, তিন শতাধিক লেগুনা (হিউম্যান হলার), চট্টগ্রাম-সীতাকুণ্ড রুটে চলাচলকারী দুই শতাধিক হিউম্যান হলার, বন্দরের পণ্য পরিবহনকারী প্রায় শতাধিক ট্রাকে অবৈধভাবে সিলিন্ডার যুক্ত করা হয়েছে। এসব গাড়ির প্রায় সিলিন্ডারই ঝুঁকিপূর্ণ। নগরীতে চলমান বেশিরভাগ হিউম্যান হলার, এইচ পাওয়ার, প্রায় দুই শত ফিটনেসবিহীন বাসে অবৈধভাবে সিএনজি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
বিস্ফোরক অধিদপ্তর চট্টগ্রামের বিস্ফোরক পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘সিএনজি বিধিমালা রয়েছে। আমরা আইন অনুযায়ী শুধুমাত্র সিলিন্ডার আমদানির বিষয়ে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রত্যয়ন দিয়ে থাকি। যানবাহনের সিলিন্ডার পরিদর্শনের বিষয়টি আমাদের আওতায় নেই। তবে মেয়াদ উত্তীর্ণ ও নিম্নমানের সিলিন্ডার ব্যবহারের কারণেই বর্তমানে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটছে।’

সিএনজি বিধিমালা-২০০৫ এর ২৪ বায়ুচলাচল ব্যবস্থা ধারার এক উপধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, “গাড়ীর প্রকোষ্টের ভিতরে সিএনজি ধারণপাত্র স্থাপিত হইলে উক্ত কক্ষে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখিতে হইবে।” ২ উপধারায় উল্লেখ রয়েছে, “নির্গত কোন গ্যাস যাহাতে নিরাপদে বাহিরে নির্গমিত হইতে পারে সেইজন্য সেফটি ব্যাগ স্থাপনের ব্যবস্থা করিতে হইবে।” কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া অ্যাম্বুলেন্স ও মাইক্রোবাসে সিটের নিচেই সংযোজিত ছিল সিলিন্ডার। যেখানে বায়ু চলাচলের তেমন কোন সুযোগ রাখা হয়নি।

এবিষয়ে বিআরটিএ চট্টগ্রামের ফিটনেস পরিদর্শক মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘সিলিন্ডার পরীক্ষা ও কনভারসনের জন্য সরকারিভাবে অনুমোদিত ডিলার রয়েছে। আমরা ফিটনেস দেয়ার সময় ওইসব প্রতিষ্ঠানের দেয়া সিলিন্ডার পরীক্ষার রিপোর্টগুলো দেখি। বিআরটিএতে সরাসরি সিলিন্ডার পরীক্ষা হয় না।’

ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপ-সহকারি পরিচালক পূর্ণচন্দ্র মুৎসুদ্দী বলেন, ‘চট্টগ্রামসহ সারাদেশে কি পরিমাণ সিএনজি চালিত যানবাহন চলাচল করছে এ তথ্য কারো কাছে নেই। বর্তমানে মেয়াদ উত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহারের কারণে সম্প্রতি গাড়ির সিএনজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও গ্যাস লিকেজের কারণে অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে প্রাণ ও সম্পদহানি হচ্ছে। এজন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় সিএনজি চালিত সবগুলো যানবাহনের সিলিন্ডার পরীক্ষা করা প্রয়োজন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ গাড়ির সিলিন্ডারগুলো স্টিকারযুক্ত করে দিতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহারে গাড়ির মালিক ছাড়াও যাদের সহযোগিতা রয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত পদক্ষেপ নিতে হবে।’

পাঠকের মতামত: