ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

চট্টগ্রাম জিপিও সঞ্চয় শাখায় হয়রানির শিকার হচ্ছে আমানতকারীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক ::  চট্টগ্রাম জিপিও’র সঞ্চয় শাখায় সঞ্চয়পত্র সহ নানা সঞ্চয় প্রকল্পে বিনিয়োগকারীরা প্রতি মুহুর্তে নানা হয়রানীর শিকার হচ্ছে। এ ব্যাপারে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে প্রতিকার চেয়েও কোন প্রতিকার পায় না বলে অভিযোগ উঠেছে।

সঞ্চয়পত্র আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত অনেকের কাছেই একটি আকর্ষণীয় বিনিয়োগ মাধ্যম। কারণ, অনেকেই জানে না তাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয় কোথায় খাটাবেন? যে কারণে নির্দিষ্ট পরিমাণ এবং নির্ধারিত সময়ে প্রাপ্য মুনাফার আশায় তারা সঞ্চয়পত্র কিনে থাকেন। বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করে থাকেন– পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্র,পরিবার সঞ্চয়পত্র, পেনশনার সঞ্চয়পত্র,বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র এবং তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র (তিন বছর মেয়াদি)।

অনেক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা/কর্মচারীরা তাদের অবসরোত্তর প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে পেনশনার সঞ্চয়পত্র কিনেন। এর ফলে তিন মাস অন্তর তারা নির্দিষ্ট অংকের মুনাফা পেয়ে থাকেন। এই মুনাফার টাকা দিয়ে শেষ বয়সে তারা অন্যের গলগ্রহ থেকে কিছুটা রক্ষা পেতে চান। অন্যদিকে, অনেক মহিলা ক্ষুদ্র সঞ্চয় জমা করে সঞ্চয়পত্র কিনে প্রতি মাসে প্রাপ্ত মুনাফার টাকা তারা তাদের পরিবারে প্রয়োজনে ব্যবহার করেন। আবার কেউ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকায় ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া,কেউ বা মাসিক ঘর ভাড়া দিয়ে থাকেন।

এ সঞ্চয়পত্র ও সঞ্চয় প্রকল্প খাতে চট্টগ্রাম জিপিও’র সঞ্চয় শাখায় দৈনিক প্রায় নগদ ও চেকের মাধ্যমে ৪/৫ কৌটি টাকা লেনদেন হয়ে থাকে বলে সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু,গত জুলাই মাস থেকে এ খাতে সরকারী এক প্রজ্ঞাপণ জারির মাধ্যমে সকল সমঞ্চয়পত্রের মুনাফার উপর ৫% ট্যাক্স কর্তনের জায়গায় এখন ১০% ট্যাক্স কর্তন করা হচ্ছে। যার কারণে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার উপর নির্ভরশীল মানুষগুলো অনেকটা বেকায়দায় পড়েছেন।

পাশাপাশি সরকার গত ১ জুলাই থেকে সকল সঞ্চয়পত্রে নতুন পরিবর্তনও এনেছে। এ ক্ষেত্রে নতুন বিনিয়োগকারীদের ইলেকট্রনিক ফান্ডস ট্রান্সফার (ইএফটি) সেবার মাধ্যমে অনলাইনে দ্রুত এক হিসাব থেকে অন্য হিসাবে গ্রাহকের ব্যাংক একাউন্টে টাকা/মুনাফা সরাসরি চলে যাবে। এছাড়া পূর্বের সঞ্চয়পত্রগুলো পূর্বের নিয়মেই সংশ্লিষ্ট ডাকঘর সঞ্চয় শাখায় গিয়ে মুনাফা উত্তোলন বলবৎ রয়েছে।

কিন্তু,চট্টগ্রাম জিপিও’র ডাকঘর সঞ্চয় শাখায় পূর্বের সঞ্চয়পত্রগুলোর আমানতের মুনাফা বা আমানত উত্তোলনে গ্রাহকদের সবচেয়ে বেশি হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে। এই শাখায় সঞ্চয় পত্র নতুন ইস্যুর জন্যে ৭ নং কাউন্টার, সঞ্চয় পত্র ডেলিভারি নেওয়ার জন্যে ১১ নং কাউন্টার, সঞ্চয়পত্র/মুনাফা উত্তোলনে পুরুষদের জন্যে ৯নং ও ১০ নং কাউন্টার এবং মহিলাদের জন্যে ৮নং ও ৬ নং কাউন্টার ভাগ করে দেয়া হয়।

এসব কাউন্টার হতে মুনাফা প্রদানের দায়িত্বে থাকা পিও অপারেটর শংকর প্রসাদ দাশ,পিও অপারেটর অসীম ধর,পিও অপারেটর মোঃ আকতার হোসেন ও পিও অপারেটর মোঃ নুরুল হক গ্রাহকদের প্রতিনিয়ত হয়রাণী করছে। পুরুষ কাউন্টার লাইনে দাঁড়ানো পরিবার সঞ্চয়পত্রের গ্রাহক প্রতিনিধি যারা উৎকোচ দেয় কেবল তাদের মুনাফা প্রদান করা হয় এবং এসব গ্রাহকদের তারা চিহ্নিত করে রেখেছে।

এছাড়া অন্যরা উৎকোচ দিতে অস্বীকৃতি জানালে আমানতকারীর অনুপস্থিতিসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে মুনাফার টাকা দেয় না। এসব প্রতিনিধিদের সাথে তারা মারমুখো হয়ে বাড়াবাড়িসহ ঝগড়া করে এবং এমনকি প্রয়োজনে খারাপ ব্যবহার পর্যন্ত করতে দ্বিধাবোধ করে না। অথচ,প্রতিটি সঞ্চয়পত্রের সুদ উত্তোলনের জন্য যদিও সঞ্চয়পত্রের সাথে টোকেন ব্যবস্থা চালু আছে।

সঞ্চয়পত্র সমেত সে টোকেন নিয়ে গ্রাহক বা প্রতিনিধি তার প্রাপ্য মুনাফা সহজে উত্তোলন করার কথা। অথচ চট্টগ্রাম জিপিও’র সঞ্চয় ব্যাংকে সঞ্চয়পত্র সমেত সেই টোকেন নিয়ে গেলে উৎকোচ ছাড়া মিলে না প্রাপ্য মুনাফা। তারা প্রায় গ্রাহকের মুনাফা হতে ৩০/৫০/১০০/২০০ টাকা রেখে দেয়। মহিলা কাউন্টারে আমানতকারী মহিলারা উপস্থিত থাকা সত্বেও সেখানেও নিরীহ কিছু মহিলাদের মুনাফা থেকে তারা একই কায়দায় উৎকোচ কেটে রেখে দেয় বলে জানা গেছে।

মেয়াদ পূর্তিতে বা মেয়াদ পূর্তির পূর্বে সঞ্চয়পত্র নগদায়নের ক্ষেত্রে সিনিয়র পোস্ট মাস্টার জেনারেল কর্তৃক ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত নগদ এবং ১০ লক্ষ টাকার উপরে হলে চেকের মাধ্যমে প্রদানের আদেশ রয়েছে। তারা এই ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত নগদ প্রদানের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নগদ আমানত উত্তোলনের সময় ৫০০/১০০০/২০০০/৫০০০ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ নেয় বলে একটি সূত্র জানায়।

এসব কাজে তাদের সাথে পিও অপারেটর মোঃ জামাল,অভ্যর্থনা কক্ষের পিও অপারেটর নুরুল হক,অর্ডারলী মোঃ ইউনুচও জড়িত বলে জানা গেছে। এছাড়া এফডি শাখায় পিও অপারেটর সুরঞ্জন দাশ,সাধারণ সঞ্চয় শাখায় পিও অপারেটর মোঃ হাসান,নৈশ ডাকঘর সঞ্চয় শাখায় সহকারী পোষ্টমাষ্টার নজরুল ইসলাম,পিও অপারেটর মোঃ মহসীন খানও গ্রাহকদের হয়রানী করে বলে সূত্রটি জানায়। সঞ্চয়পত্র কিনতে আসাসহ প্রতিটি কাজের জন্যে এখানে গ্রাহকদের পড়তে হয় এরকম নানা হয়রানিতে। আর এ হয়রানি এখানে নিত্য দিনের। এখানে সব কাজ উৎকোচের বিনিময়ে সহজে হয়।

এ ব্যাপারে পোষ্ট মাষ্টার সঞ্চয় নিপুল তাপস বড়ুয়া’র সাথে আলাপকালে তিনি অভিযোগ সমুহ অস্বীকার করে বলেন,পুরুষ লাইনে পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফা প্রদানের ক্ষেত্রে আমানতকারীর পুরুষ প্রতিনিধির সাথে অবশ্যই আমানতকারী মহিলাকে উপস্থিত রাখার জন্যে নাকি তিনি কাউন্টার সমুহে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সেখানে তার এ নির্দেশ কার্যকর হতে দেখা গেল না। বরং পরিবার সঞ্চয়পত্রের আমানতকারি বিহীন আমানতকারীর প্রতিনিধিকে মুনাফা দেওয়া হয়েছে এরকম একজনকে ধরে তার সামনে হাজির করতে বলেন অভিযোগকারীকে।যা হাস্যকর ব্যাপার বটে।

এ ব্যাপারে সহকারী মাষ্টার সঞ্চয় মোঃ মাঈনুদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনিও উৎকোচের ব্যাপারটি অস্বীকার করে বলেন,এখানে স্ত্রীর টাকা স্বামী কিংবা একজনের টাকা অন্যজনে নিয়ে যাওয়ার অনেক অভিযোগ রয়েছে।এসব অভিযোগের কারণে আমানতকারীর উপস্থিতি ছাড়া প্রতিনিধিকে টাকা দেওয়া হয় না। এছাড়া কিছুদিন আগে একজনের সঞ্চয়পত্র অন্যজন ভেঙ্গে নিজের নামে পর্যন্ত করে ফেলেছে। একারণে এখানে এরকম অনেক মামলাও চলছে।

কিন্তু যেখানে আমানতকারীর উপস্থিতি ছাড়া আমানতকারীর প্রতিনিধিকে মুনাফা দেওয়া হয় না,সেখানে কিভাবে একজনের আমানতের টাকা অন্যজন ভেঙ্গে নিজের নামে আবার সঞ্চয়পত্র ক্রয় করলো এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি এর কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। আবার আমানতকারীর উপস্থিতি ছাড়া অনেক প্রতিনিধিদের মুনাফা প্রদান করা হচ্ছে কিভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,ওদেরকে অপারেটররা চেনেন বিধায় অপারেটরদের নিজ জিম্মায় মুনাফা প্রদান করা হয়।

সঞ্চয় শাখায় গ্রাহক হয়রানি বিষয়ে কথা হলে সিনিয়র পোস্ট মাস্টার জেনারেল মো. আবদুল্লাহ বলেন,আমরা লিখিত অভিযোগ পেলে এসব অনিয়মের ব্যাপারে গুরুত্বসহকারে সাথে সাথে ব্যবস্থা নিচ্ছি। কেউ হয়রানীর শিকার হয়ে সঞ্চয়পত্রের নাম-নাম্বার সহ অভিযোগ করলে সাথে সাথেই ব্যবস্থা নেব। ইতিপূর্বে এরকম অভিযোগ যারা করেছেন আমারা ব্যবস্থা নিয়েছি। এ ছাড়া সঞ্চয় শাখার অনিয়ম দূর করতে আমরা সঞ্চয় শাখাকে সহসা সিসি ক্যামেরার আওয়াতায় নিয়ে আসবো।

বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দেশের একটি পুরনো প্রতিষ্ঠান।শুরু থেকেই ডাক বিভাগ যেসব কাজ করে আসছেঃ, সেগুলো হচ্ছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ডাক দ্রব্যাদি গ্রহণ, পরিবহন ও বিলি, ভ্যালু পে-এবল বা ভিপি সার্ভিস, বীমা সার্ভিস, পার্সেল সার্ভিস, বুক পোস্ট, মানি অর্ডার সার্ভিস, এক্সপ্রেস সার্ভিস, ই-পোস্ট ইত্যাদি। দেশে তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি এবং বিভিন্ন কূরিয়ার সার্ভিসের কারণে ডাক বিভাগ অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছিল।কিন্তু,দেশে ব্যাংক খাতে নানা অস্থিরতা ও অরাজকতার কারণে ইদানিং মানুষ নিরাপদ বিনিয়োগ এবং নিরাপদ সঞ্চয়ের আশায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরোর পাশাপাশি ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের প্রতি বেশী প্রাধান্য দিচ্ছে।

ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে স্বল্প অর্থে যেমন বিনিয়োগ করা যায়, তেমনি মুনাফাও ব্যাংকের চেয়ে বেশি। এছাড়া এখানে সব সঞ্চয়ী প্রকল্প রাষ্ট্রীয় ‘গ্যারান্টি’ যুক্ত। যার কারণে নানা ধরণের সঞ্চয়পত্র সহ নানা প্রকল্পে এখানে মানুষের বিনিয়োগ বেড়েছে। কিন্তু মৃতপ্রায় ডাক বিভাগের মধ্যে বেঁচে থাকা এ সেবাকে গলাটিপে ধরার মতো অবস্থা করে রেখেছে প্রতিষ্ঠানের গুটি কয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। চাকুরি বিধি মোতাবেক বিশেষ করে সঞ্চয়পত্রের কাউন্টার সমুহে ৬ মাস পর পর প্রত্যেকের বদলির নিয়ম থাকলেও এখানে অনেকের ক্ষেত্রে তা কার্যকর না হওয়ায় তারা এহেন দূর্ণীতির সুযোগ নিচ্ছে। তাই অবিলম্বে যাচাই-বাছাই পূর্বক এখানে পর্যাপ্ত দক্ষ ও সৎ লোক পদায়ন করা উচিত বলে বিজ্ঞ মহলের অভিমত।

পাঠকের মতামত: