ঢাকা,বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

পিয়ন থেকে ১২শ’ কোটি টাকার মালিক আনিস

যুগান্তর :: গার্মেন্টকর্মী কাজী আনিসুর রহমান আনিসের পিয়ন পদে চাকরি হয় যুবলীগ অফিসে। ২০০৫ সালের ঘটনা। তখন বেতন ছিল ৩ হাজার টাকা। এ পদে যোগ দেয়ার পর থেকে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে। প্রভাবশালীদের ছায়ায় থেকে ধীরে ধীরে রাজনীতিতে আসেন।

মাত্র ৭ বছরের ব্যবধানে ২০১২ সালে যুবলীগের উপ-দফতর সম্পাদক হন। এর ৬ মাসের মাথায় দফতর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন শুরু করেন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। চাঁদাবাজি, দরপত্র থেকে কমিশন ও যুবলীগের বিভিন্ন কমিটিতে পদবাণিজ্য করেই গড়েছেন বিপুল সম্পদ।

জুয়া, ক্যাসিনো ব্যবসার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বহিরাগতরা তার হাত ধরেই পদ-পদবি নিয়েছেন যুবলীগের বিভিন্ন কমিটিতে। তাদের প্রতিজনের কাছ থেকে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। এসব অবৈধ উপার্জনের টাকায় গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। ঢাকায় রয়েছে তার ২৩টি ফ্ল্যাট ও তিনটি বহুতল বাড়ি।

বিভিন্ন মার্কেটে ২৩টি দোকান, শেয়ার বাজারে আছে ১৫০ কোটি টাকার বিনিয়োগ। নারায়ণগঞ্জে আছে একটি চটকল। ঢাকার বাইরে ৩২৫ বিঘা জমি। শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর অভিযোগগুলো সামনে আসায় তাকে যুবলীগের কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

তবে সংগঠনের নেতাকর্মীরা বলছেন, পিয়ন থেকে ফুলেফেঁপে উঠা আনিসকে যারা নেতা বানিয়েছেন তারা এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।

গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার ভাবড়াসুর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান কাজী আনিসুর রহমান আনিস। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত আনিস ঢাকায় এসে গার্মেন্টে চাকরি নেন। কিন্তু এতে তার অভাব দূর হয়নি।

কাজেই চেষ্টা চলতে থাকে নিরন্তর। যোগ দেন যুবলীগ অফিসে পিয়ন হিসেবে। এরপর থেকে তার গল্প রূপকথার মতো। দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। সম্প্রতি ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকেই আত্মগোপনে আছেন তিনি।

কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাহজাহান ভূঁইয়া মাখন যুগান্তরকে বলেন, আনিসের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, টাকার বিনিময়ে কমিটি দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়েছে। এরপরই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

ময়মনসিংহের এক যুবলীগ নেতা যুগান্তরকে বলেন, একটি থানার সাধারণ সম্পাদক পদ পাইয়ে দেয়ার আশ্বাসে তার কাছ থেকে হাতিয়েছেন ৮ লাখ টাকা। এখন তিনি তার কোনো খোঁজই পাচ্ছেন না।

যুবলীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য যুগান্তরকে বলেন, শুধু একজনই নন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার অধিকাংশ থানায় আহ্বায়ক কমিটি ও পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে পদ পাইয়ে দেয়ার নামে একেকজনের কাছ থেকে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। ইউনিয়ন কমিটি পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়েছে তার হাত দিয়ে।

আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য যুগান্তরকে বলেন, জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং মির্জা আজম যখন যুবলীগের চেয়ারম্যান এবং সেক্রেটারি ছিলেন তাদের সময় তিনি অফিস পিয়ন হিসেবে চাকরিতে ঢুকেছিলেন। পরে তিনি কম্পিউটারে কাজ করতেন। দলের প্রেস রিলিজ কম্পোজ করে বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে পৌঁছে দিতেন। তার হাত দিয়ে বিভিন্ন থানা, পৌর ও জেলা কমিটির নেতাদের নাম কম্পোজ করানো হতো। এ কারণে অনেকের নাম তার মুখস্থ ছিল। সে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নানাভাবে ফায়দা নিত। পরে যুবলীগের বর্তমান কমিটির শীর্ষ পর্যায়ের পদে আছেন এমন নেতারা তাকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। ২০১২ সালে উপ-দফতর সম্পাদক পদ এবং এর ৬ মাস পর দফতর সম্পাদক পদে পেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেন। অবৈধ উপার্জন শুরু করেন সিন্ডিকেট করে। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত তার দাপটে তটস্থ থাকতেন অনেকেই।

আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য যুগান্তরকে বলেন, দফতরের ফাইলপত্র রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে দাফতরিক সবকিছু ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। ফলে সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা নেতারাও ছিলেন তার ওপর নির্ভরশীল।

যুবলীগের এক নির্বাহী সদস্য যুগান্তরকে জানান, কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতাদের নানাভাবে ‘ম্যানেজ’ করে পদ বিক্রি করতেন তিনি। সারা দেশের যুবলীগ কমিটির তালিকা তৈরি থেকে সাইন করানো সব হতো তার হাত দিয়ে। সংগঠনের সব তথ্য তারই কাছে থাকত।

এসব কারণে তিনি যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুস সাত্তার মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, তার অনিয়ম-দুর্নীতিতে রীতিমতো দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল। এ অবস্থায় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

এদিকে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে বিপুল বিত্তভৈববের মালিক হয়েছেন তিনি। শান্তিনগরে পাঁচটি ফ্ল্যাট, ধানমণ্ডির রায়ের বাজারে একটি বাড়ি, ল্যাবএইডের বিপরীতে ধানমণ্ডি ৪ নম্বর সড়কে ১৫ নম্বর ভবনে একটি ফ্ল্যাট, ৯/এ সড়কে ৫০ নম্বর বাড়িতে তিন হাজার স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার।

এছাড়া ১০ নম্বর সড়কে ২২ নম্বর বাড়িতে আরেকটি (বি/১৩ নম্বর) ফ্ল্যাট আছে। এ ফ্ল্যাটে তিনি বসবাস করেন। এছাড়া স্বামীবাগে মিতালী স্কুলের গলিতে ৫৪ নম্বর বাড়িতে একটি, রামকৃষ্ণ মিশন রোড়ে ৭/২ হোল্ডিংয়ের বাড়িতে চারটি, একই সড়কে ৭/১/সি হোল্ডিংয়ের বাড়িতে তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার।

গুলশান-২-এ নাভানা টাওয়ারে তিনটি দোকান, উত্তরার রাজলক্ষ্মী ও রাজউক মার্কেটে ২০টি দোকান রয়েছে। এছাড়া ময়মনসিংহের ভালুকায় ১৭৫ বিঘা জমি।

গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে ইউএনও অফিসের পাশে ও কলেজ মোড়ে দুটি বাড়ি। মুকসুদপুরে মা ফিলিং স্টেশন, নিজ গ্রাম বোয়ালিয়ায় ১৫০ একর জমি কিনেছেন আনিস। সেখানে মাছের ঘের ও হাঁসের খামার করা হয়েছে। নিজ গ্রামে তিন বিঘা জমির ওপর নির্মাণ করেছেন আলিশান প্রাসাদ।

নারায়ণগঞ্জে একটি চটকল আছে তার। ধানমণ্ডির শুক্রাবাদের ৮/২/এ ৭ তলা বাড়িটি ৫ কোটি টাকায় কিনলেও ২০ লাখ টাকা পরিশোধ করে লিখে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া রাজধানীতে তার সাতটি অফিস রয়েছে।

এসব অফিসে বসে নিয়ন্ত্রণ হতো টেন্ডারবাজিসহ নানা অপকর্ম। তার শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ আছে দেড়শ’ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খান নিয়ন, নাজমুল, মোক্তাদির শিমুল, সুন্দর রানা, শ্যামল রায়, বাবুল, নোমান ও ইউসুফ হোসেন সুজন আনিসের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন। অভিযান শুরুর পর তাদেরও দেখা মিলছে না। এসব অভিযোগের বিষয়ে কাজী আনিসুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়।

পাঠকের মতামত: