ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

ফোর মার্ডার : ২ টি প্রশ্নের উত্তর এখনো মিলেনি

মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী ::  উখিয়া উপজেলার রত্নাপালং ইউনিয়নের পূর্ব রত্নাপালং বড়ুয়াপাড়ায় চাঞ্চল্যকর ফোর মার্ডার হত্যাকান্ডের ক্লু বের করতে গিয়ে অনেক প্রশ্ন সামনে আসলেও ২টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর এখনো মিলেনি। স্থানীয় অনেকের ধারণা, যেকোন ভাবে হোক এ ২ টি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলে হয়ত হত্যাকারী সনাক্তকরণ কাজ অনেক বেশী সহজ হয়ে আসতো।
প্রশ্ন ২ টির একটি হলো :
গত ২৫ সেপ্টেম্বর দিবাগত যে রাত্রে হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়, সেই রাত্রের প্রথম দিকে স্বজনহারা প্রবাসী রোকেন বড়ুয়ার সেজ ভাই শিপু বড়ুয়া ও রিকু বড়ুয়ার শিশু কন্যা সনি বড়ুয়া পাশ্ববর্তী রোকেন বড়ুয়ার বাড়িতে দাদীর সাথে ঘুমানো জন্য তার মা রিকু বড়ুয়া তাকে পৌঁছে দেয়। রোকেন বড়ুয়ার বাড়িতে কিছুক্ষণ থাকার পর শিশু সনি বড়ুয়া আবার নিজের বাড়িতে ফিরে আসে। নিজের বাড়িতে ফিরে আসার কিছুক্ষন পর শিশু সনি বড়ুয়া আবার চাচা রোকন বড়ুয়ার বাড়িতে যায়। এসময় বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিলোনা। দ্বিতীয়বার শিশু সনি বড়ুয়াকে রোকেন বড়ুয়ার বাড়িতে দাদীর কাছে কে পৌঁছে দিয়েছিল, সে প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। অনেকের ধারণা, সনি বড়ুয়াকে দ্বিতীয়বার রোকেন বড়ুয়ার বাড়িতে যে ব্যক্তি পৌঁছে দিতে গিয়েছিল, সে ব্যক্তি কৌশলে রোকেন বড়ুয়ার বাড়িতে প্রবেশ করে আত্মীয় বা পরিচিত হিসাবে সেখানে থেকে গিয়ে এ হত্যাকান্ড সংঘটিত করতেও পারে। কারণ রোকেন বড়ুয়ার বাড়ির দরজা, কলাপসিবল গেইট ইত্যাদি দিনে রাতে সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। সুতরাং সেখানে রাত্রে এত শক্ত নিরাপত্তা বেষ্টনীর মতো দরজা খুলে সনী বড়ুয়াকে দাদীর কাছে রোকেন বড়ুয়ার বাড়িতে কে পৌঁছে দিয়েছিল, এ প্রশ্নটার উত্তর এখনো কেউ মিলাতে পারেনি।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো :
রোকেন বড়ুয়ার বাড়ির পশ্চিম সীমনায় কৃষ্ঠ বড়ুয়ার পুত্র রাসেল বড়ুয়ার সাথে সীমানা বিরোধ ছিলো দীর্ঘদিনের। ঘটনার পরদিন ২৬ সেপ্টেম্বর রাত্রে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন, রত্নাপালং ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার ডা. মোক্তার আহমদ সহ সেই রাসেল বড়ুয়ার বাড়ীতে গেলে রাসেল বড়ুয়ার মা, স্ত্রী ও বোন রাসেল বড়ুয়ার বাড়ীতে অবস্থান করা নিয়ে তিন জন ৩ ধরনের কথা বলে। রাসেল বড়ুয়া ঐ সময় বাড়িতে থাকার পরও নাই বলে তাদেরকে জবাব দেওয়া হয়। এছাড়া, পরে একই ইউনিয়নের সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বারকে নিয়ে রাসেল বড়ুয়ার বাড়িতে গেলে রাসেল বড়ুয়াকে ঠিকই তার বাড়িতে পাওয়া যায়। রাসেল বড়ুয়ার আত্মীয়স্বজনেরা আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো কিছু প্রশ্নের জবাব দিয়েছে খুব এলোমেলোভাবে। রাসেল বড়ুয়ার আসা যাওয়াও ছিল সন্দেহজনক। এসব কারণে সেই রাসেল বড়ুয়ার দিকেও স্থানীয়দের অনেকে তার দিকে সন্দেহের তীর ছুড়ছেন।

কিন্তু হত্যাকান্ডের দীর্ঘ ১১ দিন অতিবাহিত হলেও এ দুটি প্রশ্নের উত্তর এখনো মিলেনি। রহস্যাবৃত রয়ে গেছে এ ২ টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
চাঞ্চল্যকর এই ফোর মার্ডার হত্যাকান্ডের খুনীদের সনাক্ত করা সম্ভব না হওয়ায় বিভিন্ন প্রশ্ন বার বার উঠে আসছে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ, উখিয়া থানা পুলিশের দীর্ঘ ১১ দিন যাবৎ ঘটনার মূল হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও কোন ইতিবাচক ফলাফল পায়নি। এডিশনাল এসপি (এডমিন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন, এডিশনাল এসপি (উখিয়া সার্কেল) নিহাদ আদনান তাইয়ান, উখিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ আবুল মনসুর, ওসি (তদন্ত) ও আইও মো. নুরুল ইসলাম মজুমদার, রত্নাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খাইরুল আলম চৌধুরী, রত্না পালং ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার ডা. মোক্তার আহমদ, পিবিআই, সিআইডি, র‍্যাব সহ সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টার কোন ফলোদয় হয়নি।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে পৈশাচিক এই হত্যযজ্ঞ সংগঠিত হলেও দীর্ঘ ১১ দিনে হত্যাকান্ডের কোন ক্লো বের করতে না পারলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এতে মনোবল হারায়নি। কোন গন্তব্য পৌঁছাতে পারেনি মামলার তদন্ত কার্যক্রম। সবমিলিয়ে গত ১১ দিনের তদন্তের ফলাফল কার্যত শূন্য। যা এলাকাবাসীর মনে হতাশার উদ্রেক করেছে। তারা এই চাঞ্চল্যকর ফোর মার্ডার হত্যাকান্ডটি নাকি শেষপর্যন্ত ‘সাগর-রুনি’ হত্যাকান্ডের মতো হয়ে যায়, তা নিয়ে এলাকাবাসীর উদ্বেগের শেষ নেই। এলাকা থেকে সন্দেহজনক মানুষগুলোকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শুধু আনা হচ্ছে, আর জিজ্ঞাসাবাদে কোন ক্লু বের করতে নাপেরে তাদেরকে আবার ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। সন্দেহজনকভাবে আগে ১০/১১ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছিল, তাদেরকে গত শুক্রবার ৪ অক্টোবর রত্না পালং ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার ডা. মোক্তার আহমদের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে প্রবাসী স্বজনহারা রোকেন বড়ুয়ার সেজ ভাই শিপু বড়ুয়া ও তার স্ত্রী রিকু বড়ুয়াকে আবারো শনিবার ৫ অক্টোবর পিবিআই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গেছে।

এভাবে আসা-যাওয়ার মধ্যে রয়েছে পুরো তদন্ত প্রক্রিয়া। খুনীদের পায়ের চাপ, সিআইডি’র ফরেনসিক ল্যাব টেস্ট রিপোর্ট, ক্রাইম সিন টিমের রিপোর্ট, খুন হওয়াদের সুরতহাল রিপোর্ট, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট, ভিডিও চিত্র, স্থির চিত্র, বিভিন্ন জনের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া বক্তব্য, প্রতিবেশী ও এলাকাবাসীদের মতামত সবকিছুই পর্যালোচনা করা হয়ে গেছে।

কিন্তু ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে খুনীরা। বার বার ব্যর্থ হচ্ছে, সব ধরনের তদন্ত, সব ধরনের ল্যাব টেস্ট রিপোর্ট। মোবাইল ফোন অপারেটরদের জিপিএস ট্রেকিং হিস্ট্রি কাজে লাগিয়ে ভিকটিমদের চতুর্পাশের মোবাইল ফোন গুলোর কলসিস্ট যাচাই করাও হয়ে গেছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা লোকদের মোবাইল ফোনে পাওয়া কললিস্ট যাচাই করাও হয়েছে। সেখানেও কোন কাজ হয়নি। তবে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী এতে মোটেও হতাশ নয়। তাদের মনোবল এখনো খুব শক্ত। তারা এখনো হাল ছেড়ে দেয়নি।

স্থানীয় একজন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতা জানান, এখানকার বড়ুয়া সম্প্রদায়ের স্বভাব হলো-কোন নেগেটিভ ঘটনার বিষয়ে কারো কিছু জানা থাকলেও তারা সাধারণত সে নেগেটিভ বিষয়ে জানা থাকলেও সহজে মুখ খুলতে চাননা। শত্রু হতে চাননা করো, কারো ইর্ষার স্বীকার হতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন সহজে রাজী নন। তারা যে কোন নেতিবাচক পরিস্থিতিতে নিজেদের নিরাপদ রাখতে চান।

প্রসঙ্গত, উখিয়া উপজেলার রত্নাপালং ইউনিয়নের পূর্ব রত্নাপালং বড়ুয়া পাড়ায় প্রবাসী রোকন বড়ুয়ার বাড়ীতে গত ২৫ সেপ্টেম্বর বুধবার দিবাগত রাত্রে রোকন বড়ুয়ার মা সুখী বালা বড়ুয়া (৬৫), সহধর্মিণী মিলা বড়ুয়া (২৫), একমাত্র পুত্র রবিন বড়ুয়া (৫) ও ভাইজি সনি বড়ুয়া (৬) কে কে বা কারা জবাই করে হত্যা করে। এরমধ্যে নিহত রবিন বড়ুয়া রুমখা সয়েরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক প্রাথমিক শ্রেণির ছাত্র এবং সনি বড়ুয়া একই স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী ছিলো।

এবিষয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর উখিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নম্বর ৪৭/২০১৯, যার জিআর মামলা নম্বর : ৪৭৮/২০১৯ (উখিয়া) ধারা : ফৌজদারি দন্ড বিধি : ৩০২ ও ৩৪। মামলায় নিহত মিলা বড়ুয়ার পিতা ও রোকন বড়ুয়ার শ্বশুর শশাংক বড়ুয়া বাদী হয়েছেন। মামলার এজাহারে সুনির্দিষ্ট কাউকে আসামী করা হয়নি, আসামী অজ্ঞাত হিসাবে এজাহারে উল্লেখ রয়েছে। মামলাটির পরিবর্তিত তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) হচ্ছেন-উখিয়া থানার ওসি (তদন্ত) নুরুল ইসলাম মজুমদার।

পাঠকের মতামত: