ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

ত্রুটিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাসে চট্টগ্রামে বাড়ছে হৃদরোগী

চকরিয়া নিউজ, স্বাস্থ্য ডেস্ক ::
বিশ্বে বিভিন্ন অসুখে যে পরিমাণ মানুষ মৃত্যুবরণ করে, তার শতকরা ৩১ শতাংশই মারা যায় হৃদরোগের কারণে। একারণেই বর্তমান বিশ্বে হৃদরোগকে একনম্বর ঘাতকব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে- বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস রোগে মৃত্যুর হার ১৫ লাখ, শ্বসনতন্ত্রের রোগজনিত মৃত্যুর হার ৪০ লাখ, ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর হার ৮২ লাখ। অন্যদিকে, হৃদরোগজনিত মৃত্যুর হার বছরে সর্বোচ্চ ১ কোটি ৭৩ লাখ। অর্থাৎ সারাবিশ্বে প্রতিবছর ১ কোটি ৭৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় হৃদরোগে। যার শতকরা ৮০ ভাগই স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশে। তবে ২০৩০ সাল নাগাদ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর এই সংখ্যা বেড়ে ২ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশন।
এমন পরিস্থিতিতে আজ (২৯ সেপ্টেম্বর) পালিত হচ্ছে বিশ্ব হার্ট দিবস। বিশ্বের ১৯৪টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করছে। ২০০০ সাল থেকেই এদেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘বি এ হার্ট হিরো।’ দিবসটি উপলক্ষে চট্টগ্রামেও বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। হৃদরোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে র‌্যালি, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশেও হৃদরোগে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রতি একশ’জন রোগীর মধ্যে ১২ থেকে ১৫ জন হার্টের রোগী। আর বাংলাদেশের মধ্যে এ রোগের জন্য সবচেয়ে ঝুকিঁপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে রয়েছে চট্টগ্রামের নাম। ক্রটিপূর্ণ খাদ্যাভাসের কারণেই চট্টগ্রামে হৃদরোগী বেশি বলে মনে করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের প্রধান ডা. প্রবীর কুমার দাশ। সমপ্রতি চট্টগ্রামে ইমপেরিয়াল হাসপাতাল উদ্বোধন করতে এসে অনেকটা অভিন্ন তথ্য দিয়েছিলেন বিশ্বের খ্যাতিমান হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও ভারতের নারায়ণা ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিয়াক সায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা ডা. দেবী প্রসাদ শেঠী।
বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ভারত-বাংলাদেশে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি জানিয়ে ডা. দেবী শেঠী বলেন, বাংলাদেশ-ভারতের লোকজনের জিনগত বৈশিষ্ট্য প্রায় একই। জিনগত কারণে ভারত-বাংলাদেশের লোকজন হার্ট অ্যাটাকের বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। এখানকার মানুষের জীবনধারা, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভাস, নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াবেটিস ও ধূমপান প্রি-মেচিউর হার্ট অ্যাটাকের কারণ।
খ্যাতনামা এই চিকিৎসক বলেন, এ অঞ্চলের মানুষ ব্যায়াম করেন না। আর বেশি বেশি মাংস খেতে পছন্দ করে। হৃদরোগের কারণ হিসেবে এসবও কম দায়ী নয়। আর ক্রুটিপূর্ণ খাদ্যাভাস বলতে লাল মাংসের (রেড মিট) প্রতি চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের বেশি আগ্রহের কথা বলেছেন ডা. প্রবীর কুমার দাশ। চিকিৎসকরা বলছেন, উন্নত আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রা, অস্বাস্থ্যকর জীবনাভ্যাস, অসচেতনতা, এসব কারণে হৃদরোগ শুধু বড়দের নয়, শিশু-কিশোরদের মাঝেও দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ১৭ ভাগই হৃদরোগের কারণে।
অথচ প্রাত্যাহিক জীবনযাপনে ছোট ছোট কিছু পরিবর্তন এনে এই হৃদরোগ প্রতিরোধ সম্ভব বলে জানান চিকিৎসকরা। রোগটি প্রতিরোধে শুধু একটু সচেতনতা জরুরি জানিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, খাদ্য তালিকায় স্বাস্থ্যকর খাবারের পরিমাণ বাড়ানো, দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করা, শারীরিক পরিশ্রম বাড়ানো এবং ধুমপান থেকে বিরত থেকে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটা কমানো যায়।
স্থূলতা, ব্যায়ামের ঘাটতি ও উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগের ঝুঁকির প্রধান কারণ উল্লেখ করে চিকিৎসকরা বলছেন, সচেতন থাকলে এ সংক্রান্ত ঝুঁকি এড়ানো যেতে পারে। আর হৃদরোগের ঝুঁকি এড়াতে কাজে সক্রিয় থাকা, পর্যাপ্ত খনিজসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া, মাছ খাওয়া, বেশি বেশি আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া, দিনে কমপক্ষে পাঁচ দফায় ফল বা সবজি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। একই সাথে দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখা, চর্বি জাতীয় খাবার থেকে দূরে থাকা, ধূমপান থেকে বিরত থাকা, লবণ কম খাওয়া এবং মদ্যপান থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। হৃদরোগের ঝুঁকি এড়াতে এই পরামর্শগুলো অবশ্যই মেনে চলতে হবে বলে জানান চমেক হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের প্রধান ডা. প্রবীর কুমার দাশ।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, বাংলাদেশের হাসপাতাল এবং পার্শ্ববর্তী ভারতসহ অন্যান্য দেশে হৃদরোগের চিকিৎসা নিতে যাওয়া বাংলাদেশিদের মধ্যে চট্টগ্রামের মানুষ বেশি। এ বিষয়ে সারাদেশের জেলাওয়ারি হৃদরোগে আক্রান্তের সংখ্যাতাত্ত্বিক গবেষণা নেই। তবে মেজবান ও গরুর মাংসের প্রতি চট্টগ্রামের মানুষের বিশেষ আগ্রহের বিচারে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। রাজধানী ঢাকার তুলনায় চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে মানসিক ও পারিপার্শ্বিক চাপ কম থাকলেও হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি। এর অন্যতম কারণ খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় গাফিলতি ও শারীরিক পরিশ্রমের চরম স্বল্পতা। তাছাড়া গরু, খাসিসহ চর্বিজাতীয় খাবারকে আমরা অধিক পছন্দ করে থাকি। যে কোনো অনুষ্ঠানে রেড মিট (মাংস) আমাদের থাকতেই হবে। তাছাড়া ফাস্ট ফুডে আসক্তিও রয়েছে এই অঞ্চলের মানুষের। যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। আর এই ঝুঁকি এড়াতে হলে শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করার পাশাপাশি রেড মিট, ফাস্ট ফুড ও চর্বি জাতীয় খাবার খাবার থেকে দূরে থাকতে হবে বলে জানান এই চিকিৎসক।
চমেক হাসপাতালে হৃদরোগে চিকিৎসা সুবিধা : হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য গরীব-অসহায় মানুষের ভরসাস্থল বলা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে। স্বল্প খরচে হৃদ্‌রোগের সব ধরনের সেবা মেলে সরকারি এই হাসপাতালে। চমেক হাসপাতালের স্বতন্ত্র হৃদরোগ বিভাগ চালু হয় ১৯৮৯ সালে। বর্তমানে একশ শয্যার এই বিভাগে প্রতিনিয়ত ৩ শতাধিক রোগী ভর্তি থাকে। তবে চিকিৎসক সংকটে এই বিশাল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা সেবায় হিমশিম খেতে হচ্ছে বিভাগের চিকিৎসকদের। হৃদরোগ বিভাগ সংশ্লিষ্টরা জানান, সবমিলিয়ে বিভাগে ৯ জন চিকিৎসক রয়েছে। কিন্তু সূচারুভাবে চিকিৎসা সেবা দিতে হলে অন্তত ২০ জন চিকিৎসক প্রয়োজন বিভাগে। তাছাড়া পুরো বিভাগে অধ্যাপকের একপি পদও নেই বলে জানান বিভাগ সংশ্লিষ্টরা। যদিও পদ সৃজনে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়ার কথা জানিয়েছে হাসপাতাল প্রশাসন।
এনজিওগ্রাম : হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের ক্যাথ ল্যাবে স্বল্প খরচে এনজিওগ্রাম করা হয়। সরকারি ফি, ইনজেকশন ও আনুষঙ্গিক সবকিছু মিলে এনজিওগ্রামে ৬ হাজার টাকার মতো খরচ পড়ে। বেসরকারি হাসপাতালে এর খরচ ১৮ হাজার টাকার কম নয়। খুবই কম খরচে এখানে (চমেক হাসপাতালে) এনজিওগ্রাম করা যায় জানিয়ে হৃদরোগ বিভাগের প্রধান ডা. প্রবীর কুমার দাশ বলেন, ২০০৪ সাল থেকে এই বিভাগে এনজিওগ্রাম সুবিধা চালু হয়। তখন থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১১ হাজার রোগীর এনজিওগ্রাম করা হয়েছে। এছাড়া ২০১২ সালে চালু হয় হার্টে রিং পড়ানোর সুবিধা। তখন থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার রোগীর হার্টে রিং পড়ানো হয়েছে বলে জানান বিভাগীয় প্রধান।
ওপেন হার্ট সার্জারি : হাসপাতালে হৃদরোগ (কার্ডিয়াক) সার্জারি বিভাগ চালু হয় ২০১২ সালে। বিভাগটি চালু হওয়ার পর থেকে এই বিভাগে প্রায় সাড়ে চারশ রোগীর অস্ত্রোপচার করা হয়। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশই ওপেন হার্ট (সার্জারি) অস্ত্রোপচার। চিকিৎসকেরা জানান, এই বিভাগে ওপেন হার্ট সার্জারিতে খরচ পড়ে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু বেসরকারি কোন হাসপাতালে করতে গেলে এর খরচ ২ লাখ টাকার কম নয়। বরং বেশি। হৃদরোগের অন্যান্য অস্ত্রোপচার করতে গেলে চমেকে খরচ পড়ে ১০-১২ হাজার টাকা। বাইরে তা তিন থেকে চার গুণ। বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক নাজমুল হোসেন বলেন, এখানকার খরচ সকল বেসরকারি হাসপাতালের চেয়ে অনেক কম। সেবাও ভালো। শুধুমাত্র ওষুধ ও পারফিউনিস্টের খরচ বাবদ টাকা দরকার হয়।

পাঠকের মতামত: