ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

নিষিদ্ধ জালের ব্যবহারে সাগরের ২৫০কি:মি: এলাকা, অপ্রতিরোধ্য জেলেরা: মৎস্য ভান্ডারেরর ব্যাপক ক্ষতির আশংকা

মনির আহমদ, কক্সবাজার ::  কক্সবাজার সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে ২৫০ কি:মি: এলাকা জুড়ে নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার আশংখা জনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রভাবশালী এসব জেলেদের কারনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে মৎস্য ভান্ডার রক্ষা। এতে ব্যাপক ক্ষতির আশংকা করা হচ্ছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্রের।

মৎস্য আইনে খুঁটা ও দুই ইঞ্চির নীচে ফাঁদের ভাসা জাল ব্যবহার করা নিষিদ্ধ হলেও এ নিষেধাজ্ঞা মানছেনা কক্সবাজারের জেলেরা। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে কুতুবদিয়া ও মহেশখালীর কাছাকাছি বঙ্গোপসাগরে এ জাল ব্যবহার করে মৎস্য আহরন করছে। ফলে নিষিদ্ধ সময়সহ সারা বছর ইলিশের বংশবিস্তারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কক্সবাজারের মহেশখালী কোষ্টগার্ড ও উপকুলের জেলেদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। জেলেরা জানায়, গভীর সমুদ্র থেকে সাগরের মোহনা এবং নদ-নদীতে ডিম ছাড়ার জন্য মা ইলিশ ধেয়ে আসে। মা ইলিশ শিকারের জন্য নিষেধাজ্ঞা শুরুর আগেই মাছ চলাচলের পথে পুঁতে রাখা হয়েছে খুঁটা জাল। প্রতিটি খুঁটা জাল দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত সাগরে পাতানো থাকে। ফলে বহু জেলে নিষিদ্ধ সময়েও এ জাল দিয়ে মা ইলিশ শিকার করে। অন্যদিকে এ সময়ে জাটকা ইলিশ নদ-নদী থেকে গভীর সমুদ্রে যাওয়ার পথে জেলেদের ভাসা জালে ধরা পড়ে। এ দুই শ্রেণির জাল দিয়ে মা ইলিশ এবং জাটকা ইলিশ শিকার করা হয়। অবৈধ জাল সাগর ও নদীতে ব্যবহার না করার বিষয়টি নিশ্চিত হলে ইলিশ উৎপাদন আরো বাড়বে বলে মনে করেন সচেতন জেলেরা।

সম্প্রতি চকরিয়ার বদরখালীর উপকুলে গিয়ে দেখা গেছে, ইঞ্জিনচালিত ছোট বড় অনেক ট্রলার সমুদ্র থেকে ফেরিঘাটের দিকে ধেয়ে আসছে। ট্রলারটি বদরখালীর ঘাটে নোঙ্গর করে ব্যবসায়ীদের কাছে ইলিশ মাছ বেচা-কেনা করছে।ঐসব ট্রলারে কোনো জাল নাই। জালবিহীন বোট গুলোই খুটা জালের মাছের বোট বলে জানায় তারা।

গল্পের ছলে কয়েকজন জেলে জানান, কুতুবদিয়া থেকে ২০/২৫ কিলোমিটার গভীরে যে পয়েন্ট দিয়ে ইলিশ চলাচল করে, সেখানে এই জাল সরঞ্জামসহ ট্রলারযোগে নিয়ে যাওয়া হয়। এটি সাগরে পানির নিচে খুঁটা গেড়ে পাতিয়ে দেয়া হয়। জালের ২০ হাত পর পর একটি ভাসমান ট্যাঙ্কী (ভাসা) জালের ওপরের অংশে এবং জালের নিচে বাঁধা হয় ইট। খুঁটা জালের ঘনত্ব (ফাঁস) সাধারণত আধা ইঞ্চি থেকে সাড়ে তিন কিংবা চার ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। সাগরে পুঁতে রাখা খুঁটার রশির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় জেলের নামের প্রথম অংশ বা নির্ধারিত চিহ্ন, যা দেখে জালের সন্ধান সহজে পাওয়া যায়। এভাবে টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ থেকে কুতুবদিয়া পর্যন্ত প্রায় ২৫০ কিলোমিটারে কমপক্ষে ৫০ হাজার জেলে খুঁটা জাল এবং ভাসা জাল ব্যবহার করে মাছ ধরা অব্যাহত রেখেছে।

ওই জেলেরা আরো জানান, অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত জাটকা নদ-নদী থেকে জোয়ার-ভাটার সঙ্গে গভীর সমুদ্রের পথে যাতায়াত করে। তখন জেলেরা দুই-তিন হাজার হাত লম্বা এবং ২৪ হাত খাড়া (প্রশস্ত) এবং সোয়া এক ইঞ্চি থেকে সাড়ে ৩ ইঞ্চি ফাঁসের ভাসা জাল ব্যবহার করে। ছোট ফাঁসের এসব ভাসা জাল দিয়ে ৩০ কিলোমিটার গভীর সমুদ্রে গিয়ে পোয়া, টেংরা, ছুরী,লইট্টা সহ বিভিন্ন শ্রেণির মাছ শিকারের নামে চলে মুলত জাটকা ইলিশ নিধন। সাগরতীর থেকে ৩০ কিলোমিটার গভীরে পর্যন্ত ২৫০ কিলোমিটারে কমপক্ষে আরো ৫০ হাজার জেলে ভাসা জাল ব্যবহার করে ইলিশ মাছ ধরে। ফাঁদ ছোট হওয়ায় ছোট বড় সমস্ত ইলিশ মাছ ধরা পড়ে যায় এই সব জালে।

জেলেরা বলেন, গভীর সাগরের হাইর এলাকায় ইলিশ মাছ চলাচলের পথ। ৫০ হাজারেরও বেশি খুঁটা জাল চলাচল পথে

পাতা হয়। এর ফলে মা ইলিশ চলাচলের পথ স্বাভাবিক থাকে না। প্রতিটি খুঁটা জালে প্রতি জোয়ার ও ভাটায় কমপক্ষে ১০-১৫টি মা ইলিশ ধরা পড়ে। তিনি আরো বলেন,খুঁটা জালে ইলিশ আটকে পড়ার এক ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়। এক ঘণ্টার মধ্যে

জাল থেকে মাছ ছাড়িয়ে আনতে না পারলে তা পঁচে জাল থেকে ছুটে যায়। এ ভাবে নষ্ট হয় হাজার হাজার মাছ। তখন তা কাঁকড়া ও সামুদ্রিক চিলের খাদ্য হয় এ মাছ। তিনি আরো বলেন, ‘এই ২৫০ কিলোমিটারের মধ্যে খুঁটা ও ভাসা জালের ব্যবহার বন্ধ করা গেলে সমুদ্রে ইলিশের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাবে। ’

এ বিষয়ে বদরখালী মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবু তালেব বলি বলেন, অতি লোভি কতিপয় জেলে ক্ষতিক্ষর জাল ব্যবহার করছে। কোষ্ট গার্ড সদস্যরা তাদের আটক করে অনেক সময় জাল পুড়িয়ে দেয়। তারপরও তারা অবৈধ জাল ব্যবহার করে মৎস্য ভান্ডারের ক্ষতি করছে।

তবে যে সব জেলে খুঁটা ও ছোট ফাঁদের ভাসা জাল দিয়ে ইলিশ শিকার করে, তারা কখনোই ভালো মানুষ না বলেও মন্তব্য করেন সভাপতি আবু তালেব।

এ ব্যাপারে মহেশখালী কোষ্টগার্ডের ইন্চার্য কন্টিজেন্ট কমান্ডার আরশাদ বলেন, বঙ্গোপসাগরে ২৫০ কি:মি: এলাকা জুড়ে নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রভাবশালী কিছু জেলেদের কারনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে মৎস্য ভান্ডার রক্ষা। এতে ব্যাপক ক্ষতির আশংকা করা হচ্ছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্রের।তিনি আরো বলেন, উপকুলীয় এলাকা বদরখালীতে জানামতে ফিসিং বোট রয়েছে ৪৪টি। তার মধ্যে লাইসেন্স রয়েছে মাত্র ২ টি বোটের। বাকী সব লাইসেন্স বিহীন। বোটের লাইসেন্স না থাকায় মালিকানা সনাক্ত করতে কষ্ট হয়। অনেক সময় জল দস্যুর বোট সন্দেহ করে সিগনেল দিলে পালাবার চেষ্টা করে তারা। তখন তাদের ধাওয়া করে ধরলে দেখা যায় অবৈধ জাল ব্যবহারকারীর বোট,

ডাকাতের বোট নয়। অনেক সময় অবৈধ ভাসা জাল পুড়িয়েও দেওয়া হয়। এ সময় ছাড়িয়ে নিতে দৌঁড় ঝাপ করেন বদরখালী বোট মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদক আবুল হাসেম। ছাড়াইতে না পারলে অনেক সময় জেলে সমিতির সাথে মনোমালিন্য হয়। কারন,

লাইসেন্স-পরিচিতি চিহ্ন না থাকায় কোনটি ডাকাতের কোনটি জেলের সনাক্ত করা মুশকিল। তাই বোটের লাইসেন্স করানোর জন্য

একাধিকবার তাদের সতর্ক করা হয়েছে। তবে বদরখালী বোট মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদক আবুল হাসেম সর্বশেষ আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সমস্ত বোটের লাইসেন্স সম্পন্ন করবেন বলে কথা দিয়েছেন বলে জানান মহেশখালীর কন্টিজেন্ট কমান্ডার আরশাদ।

পাঠকের মতামত: