ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

ভুয়ার ভিড়ে আসল চেনা দায়

ঋত্বিক নয়ন, চট্রগ্রাম :: ভুয়ার ভিড়ে আসল চেনা দায়। আর এই ভুয়াদের অভিনব প্রতারনায় নিজেকে সঁপে সর্বস্ব খোয়াচ্ছে সাধারণ মানুষ। কখনো ডিবি, কখনো র‌্যাব, কখনো পুলিশ, চিকিৎসক, ম্যাজিস্ট্রেট, দুদক কর্মকর্তা, বিয়ে পড়ানোর কাজী পরিচয় দিয়ে নিত্য প্রতারনা করছে তারা। কখনো সংঘবদ্ধভাবে, কখনো আবার একাকী তারা এ জাল বিছিয়ে রেখেছে চট্টগ্রামসহ সারা দেশেই। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দাবি, নির্দিষ্ট কিছু চক্র এ কাজ করছে, তারা ধরাও পড়ছে। কিন্তু ব্যক্তি কেন্দ্রিক প্রতারনার বিষয়টি আগেভাগে জানাটা কঠিন। তবে ঘটনার পর ধরা পড়ছে এসব সদস্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব প্রতারকদের মধ্যে ডিবি পরিচয়ে প্রতারনার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। সংঘবদ্ধ এ চক্রের দুর্বৃত্তরা গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তার জ্যাকেট, বেল্ট, রিভলবার হোল্ডার, পুলিশের লোগোযুক্ত টর্চলাইট, হ্যান্ডকাফ, ব্যাজ, পদবির সবকিছুই ব্যবহার করছে। তাদের মাইক্রোবাস, সিএনজি ও মোটরসাইকেলে লাগানো থাকছে পুলিশ, ডিবি লেখা স্টিকার। দু’একজনের হাতে ওয়াকিটকিও থাকে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের মতো কথাবার্তা, আচরণও করে তারা। টার্গেট ব্যক্তিকে শত শত মানুষের সামনে থেকেই জোরপূর্বক গাড়িতে তুলে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে লাগিয়ে দেয়া হয় হ্যান্ডকাফ, চোখ বেঁধে ফেলা হয় কালো কাপড়ে। চলন্ত গাড়িতেই দুর্বৃত্তরা শুরু করে মারধর। ভয় দেখায় ক্রসফায়ারের। জাল টাকার কারবারি, হুন্ডি ব্যবসায়ী, মাদক ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি–ইত্যাদি নানা অভিযোগ তুলে আটক ব্যক্তির টাকা পয়সা, মোবাইল ফোনসেট, সোনার চেইনসহ মূল্যবান সবকিছু হাতিয়ে নিয়ে নামিয়ে দেয় নির্জন কোন স্থানে। ব্যাংক কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ টাকা নিয়ে বের হচ্ছে কি না সেটা নজরদারি করে তাদের নিজস্ব সোর্স। তার সংকেত পেয়ে টার্গেটের পেছনে ধাওয়া করে। এসব অপরাধীদের নিয়মিত নজরদারি না থাকায় তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এড়িয়ে অপরাধ কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হতে বহিষ্কৃত সদস্যদের অনেকেও এদের সাথে জড়িত।
সর্বশেষ গতকাল কক্সবাজারের পেকুয়ায় জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসঅাই) জুনিয়র কমিশন অফিসার পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করার সময় নীলফামারী এলাকার শাচীন্দ্র নাথের ছেলে বিপুল চন্দ্র রায়কে অাটক করেছে থানা পুলিশ। এসময় তার সহযোগি হিসাবে যশোর মনিরামপুর এলাকার অাবদুল কাদেরের ছেলে মোঃ ইলিয়াছ ও জলঢাকা নীলফামারীন এলাকার মোঃ খয়রাত হোসেনের ছেলে রোকনুজ্জামানকে অাটক করলেও জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এনএসঅাই পেকুয়ার দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা সুলেয়ামান মিয়ার অভিযোগের ভিত্তিতে শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় পেকুয়া চৌমহুনী থেকে তাকে অাটক করা হয়।

গত শুক্রবার নগরীতে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিচয়ে তল্লাশির নামে ছিনতাইয়ের অভিযোগে বাকলিয়া মিয়াখান নগর থেকে জাহাঙ্গির নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকলিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন বলেন, শুক্রবার রাতে হৃদয় নামে একজন গাড়িচালক নগরীর জেলরোড থেকে মিয়াখান নগরে বাসায় ফিরছিলেন। পথে নিজেকে ডিবি সদস্য পরিচয় দিয়ে তার থেকে ১১ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়া হয়। এসময় হৃদয় চিৎকার দিলে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় টহল পুলিশ তাকে আটক করে।
একই দিন কোতোয়ালী থানার চেরাগি পাহাড় মোড় থেকে র‌্যাব সদস্য পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে এরশাদ রহমান (৩০) ও মারুফ হোসেন (৩০) নামে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা এ পরিচয় ব্যবহার করে একজনের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের চট্টগ্রাম জোনের সহকারী পরিচালক এএসপি মো. মাশকুর রহমান।
গত ৭ আগস্ট পাঁচলাইশ থানাধীন ২নং গেট শেখ ফরিদ মার্কেট এলাকা থেকে এক ভুয়া ট্রাফিক পুলিশকে আটক করে আসল ট্রাফিক পুলিশ।
১ জুলাই রাউজানে নুরুল আবছার নামে এক ভুয়া ডিবি পুলিশকে আটক করে জনতা। সে দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে ডিবি পুলিশ অফিসার পরিচয় দিয়ে চট্টগ্রাম রাঙামাটি সড়কে চাঁদাবাজি করে আসছিল।
২৪ জুন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আব্দুল মন্নান (২২) নামে এক ভুয়া এনএসআই (জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা) সদস্যকে আটক করা হয়। সকাল ১১টার দিকে চমেক হাসপাতালের ২৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে তাকে আটক করা হয়।
১৯ জুন দক্ষিণ পতেঙ্গার বিজয় নগরে বিকিরন বড়ুয়া নামে এক ভুয়া ডাক্তারকে গ্রেফতার করে ভ্রাম্যমান আদালত। তাকে ৬ মাসের কারাদণ্ডসহ ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
গত ২৩ মে খুলশী ঝাউতলায় গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে বাস থামিয়ে গণেশ সিংহ নামের এক ব্যক্তি থেকে তিন লাখ ১০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় মামুন নামে এক ভুয়া ডিবি পুলিশকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার করে খুলশী থানা পুলিশ। খুলশী থানার ওসি প্রণব চৌধুরী বলেন, একটি প্রতারক চক্রের লীডার মামুন। প্রথমে তার দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয। তাদের তথ্য মতে ২৩ মে রাতে পুলিশ খুলশী থানার ভাঙ্গারপুল এলাকা থেকে মামুনকে গ্রেফতার করে। এসময় পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় মামুন আহত হয়।
১১ মে বাকলিয়ার তুলাতুলি এলাকার শুটকির দোকানে ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেটের ভয় দেখিয়ে জরিমানা আদায়কালে আটক হয় কথিত সাংবাদিক ও ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট। খবর পেয়ে দ্রুত ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে প্রতারকদের আটক ও চিংড়ি শুটকিতে রং ও তেল মেশানোর অপরাধে শুটকি ব্যবসায়ী খোরশেদকে ৩ মাসের কারাদন্ড দেন।
২ মে আন্দরকিল্লা এলাকা থেকে মো. আইয়ুব (২১) নামে এক নকল পুলিশকে আটক করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। এ সময় তার গায়ে ছিল পুলিশের ইউনিফর্ম, বুকে নেমপ্লেট, হাতে পুলিশের লাঠি।
একই দিন হাটহাজারীতে ধরা পড়েছে এক ভুয়া কাজী ও তার সহকারী। তারা সরকারি কাজী না হয়েও গত এক যুগ ধরে দুই শতাধিক তরুণ-তরুণীর বিয়ে পড়িয়েছেন। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন তাদের আটক করে।
২ এপ্রিল নগরীতে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে এক ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা ও মোবাইল ছিনতাইকালে মো. জাহেদুল ইসলাম (৪৪) ও খোকন মিয়া (৩০) নামে দুইজনকে পিটুনি দিয়ে পুলিশে দিয়েছে স্থানীয়রা। কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন জানান, কাউছার আলম নামে এক ব্যক্তি গত রোববার সন্ধ্যায় চাঁদপুর থেকে চাকরির খোঁজে চট্টগ্রামে আসেন। রেল স্টেশন থেকে বিআরটিসি মোড়ে এসে কাউছার চা পান করার সময় জাহেদুল ও খোকন তার কাছে গিয়ে নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখায়।

x

পাঠকের মতামত: