ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

থানার ক্রাইম বোর্ডে অপরাধীর ছবি নেই ।। কোথাও আবার বোর্ডই নেই, সিএমপি কমিশনারের নির্দেশও ফাইলবন্দী

অনলাইন ডেস্ক ::
ঈদে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অপরাধীরা। কেউ জামিনে এসে ফের জড়িয়েছে অপরাধে, কেউ আবার বাইরে থেকে নগরীতে এসেছে ঈদের মৌসুমকে টার্গেট করে। এদের বাস সাধারণের মাঝে। নগরবাসীর ধারণা-ই নেই, তার পাশে থাকা মানুষটি চিহ্নিত অপরাধী। থানা পুলিশও এদের ধরতে হিমশিম খাচ্ছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ, অপরাধীদের ক্রাইম বোর্ড হালনাগাদ না হওয়া। একটা সময় থানায় প্রবেশ করলে চোখে পড়তো নোটিশ বা ক্রাইম বোর্ড। জরুরি নোটিশ ছাড়াও এলাকায় চিহ্নিত ও শীর্ষ অপরাধীদের ছবি সাঁটানো থাকতো এতে। সতর্ক করতে এবং পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে সাধারণ মানুষের সহায়তা পাওয়াই ছিল এ কাজের প্রধান উদ্দেশ্য। কিছু থানায় এখনও বোর্ড আছে, তবে তাতে নেই কোনও শীর্ষ অপরাধীর ছবি। এর বদলে হয়েছে অজ্ঞাত লাশ ও নিখোঁজ ব্যক্তির ছবি। আবার কোন থানায় বোর্ড পুরোটাই খালি। থানায় বোর্ড লাগানোর জায়গা নেই এমন থানাও রয়েছে সিএমপিতে। পুলিশ অজুহাত দিয়ে বলছে, থানাগুলো ডিজিটাল হওয়ায় অপরাধীদের তালিকা অনলাইনে প্রকাশ করা হচ্ছে। তবে সেই তালিকা শুধু দেখতে পারে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ কর্মকর্তারা। কিন্তু তাদের সে দাবির বাস্তব ভিত্তি ঠুনকো। শুধু তাই নয়, সিএমপি কমিশনার মো: মাহবুবর রহমান প্রতিটি থানায় প্রকাশ্য স্থানে মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের ছবি সম্বলিত বোর্ড টাঙানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন ঢের আগে; যাতে থানায় আগত সাধারণ মানুষ তাদের দেখে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তাদের খোঁজ পেলে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। তাও এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয় নি।
সূত্র মতে, তালিকা বা ছবি রাখার মূল উদ্দেশ্য ছিল লোকজন তাদের দেখবে, নাম জানবে। যাতে পরবর্তীতে তাদের কোথাও দেখলে বা সন্ধান পেলে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করবে। এতে পুলিশ আসামি গ্রেপ্তারে সাধারণ জনগণের সহায়তা পাবে।
সমপ্রতি নগরীর কোতোয়ালী, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, পতেঙ্গা, ইপিজেড, সদরঘাট, চকবাজার, আকবরশাহ, বাকলিয়া, ডবলমুরিং থানা ঘুরে দেখা গেছে সেখানে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কোনও তালিকা বা ছবি নেই। থানাগুলোর ক্রাইম বোর্ডে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের পরিবর্তে নিখোঁজ ব্যক্তি কিংবা অজ্ঞাত লাশের ছবি ঝুলছে। আবার কোথাও কোথাও মোটরসাইকেল ও মোবাইল চোরের ছবি আছে। আছে ওসির নিজস্ব কৃতিত্বের রঙচঙা বোর্ড। চট্টগ্রাম নগরীর থানাগুলোয় শীর্ষ অপরাধীদের ছবি দৃশ্যমান স্থানে না থাকার ভিন্ন ভিন্ন কারণের কথা বলেছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। কেউ বলছেন, থানাগুলো ডিজিটাল হয়েছে, যে কারণে ক্রাইম বোর্ডে অপরাধীদের তালিকা না টাঙিয়ে অনলাইনে ডাটাবেজ করা হচ্ছে। আবার কেউ বলছেন, আগের মতো দাগী অপরাধী নেই, তাই বোর্ডে ছবিও নাই।
কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন আজাদীকে বলেন, অপরাধীদের ডাটাবেজের আওতায় নিয়ে আসতে কেন্দ্রিয়ভাবে ‘ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ (সিডিএমএস) তৈরি করা হচ্ছে। এই সিডিএমএস-এ অপরাধীদের ডাটা প্রতিটি থানাতেই এন্ট্রি করা হয়। সারাদেশে যত মামলা হয় সব এই সিডিএমএস এ লিপিবদ্ধ থাকে। একবার কারও নামে মামলা হলে সেটা সিডিএমএস এ ওঠে। ফলে ওই ব্যক্তি আবার অন্য কোথাও গ্রেপ্তার বা মামলা হলে তার নামে দেশের অন্য থানাগুলোতে যত মামলা আছে সেগুলোর আপডেট তথ্য চলে আসে। যাতে করে আসামি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে সময় কম লাগছে। এটার সুফল পাওয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। তবে তিনি এটাও স্বীকার করেন যে, সিএমপিতে এ সুবিধা এখন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না, কাজ চলছে। কোতোয়ালী থানা এলাকায় ক্রাইম বোর্ডে কোন ছবি না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি আসার পর একটু একটু করে থানার সংস্কার কাজ করছি। তাই বোর্ড লাগানো হয়েছে, শীর্ষ অপরাধীদের ছবিও ঝুলানো হবে, যাতে সকলেই দেখতে পারে।
এ বিষয়ে বাকলিয়া থানার ওসি নেজাম উদ্দিন আজাদীকে বলেন, ক্রিমিনাল ডাটাবেইজ এখনো পুরোপুরি তৈরি হয় নি। আমরা শীর্ষ অপরাধীদের নাম ঠিকানা, ছবি ও মামলার সংখ্যা লিপিবদ্ধ রাখছি খাতায়। আমার থানায় স্থান সংকুলান নেই, তাই আসামিদের ছবি সম্বলিত বোর্ড লাগানোটা দুরূহ।
সন্ত্রাসীদের নাম বা ছবি প্রকাশে যেমন সুবিধা আছে, তেমনি অসুবিধাও আছে বলে জানান ডবলমুরিং থানার ওসি সদীপ কুমার দাশ। তিনি আজাদীকে বলেন, থানায় অপরাধীদের ছবি থাকলে মানুষ সতর্ক থাকতে পারতো। কিন্তু এতে কিছু সমস্যাও আছে। ছবি প্রকাশের পর অপরাধীরা এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দেয়।
আবার ছবি প্রকাশ করা নিয়ে হাইকোর্টের এক রুলের ব্যাপারে অপস্পষ্টতা রয়েছে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে। যদিও ২০১২ সালের দেওয়া রুলে বলা হয়েছে, গ্রেপ্তারকৃত বা সন্দেহভাজন হিসেবে আটক ব্যক্তিকে স্বীকারোক্তি প্রদানের জন্যে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা যাবে না। কারণ গ্রেপ্তারকৃত বা সন্দেহভাজন ব্যক্তি বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হতে পারেন। তাই বিচারের আগে তাকে মিডিয়ার সামনে হাজির করা শুধু মিডিয়া ট্রায়ালই নয়, এটা মিডিয়া কনভিকশনও বটে। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ওসি বলেন, একজন ম্যাজিস্ট্রেট গ্রেপ্তারের পর ছবি প্রকাশ করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। তখন থেকে আর থানায় ছবি প্রকাশ করা হয় না। থানা থেকে আসামিদের কোনও ছবিও সাংবাদিকদের দেওয়া হলেও তা এমন ভাবে করা হয়, যেন থানা থেকে তোলা, সেটা বুঝা না যায়।
অভিযোগ আছে নগরীর ১৬টি থানায় অপরাধী তালিকা হালনাগাদ হয় না দীর্ঘদিন। যদিও থানা পুলিশের দাবি প্রতিনিয়তই তালিকা আপডেট করা হচ্ছে। অবশ্য অপরাধীর সংখ্যাটি কত তা বলতে চাননি কোনো থানার কর্মকর্তারা। যুক্তি হিসেবে তারা দাঁড় করিয়েছেন- নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার প্রসঙ্গ যদিও পুলিশ সদর দফতরের একটি সূত্র জানিয়েছে, অপরাধী তালিকা বলতে যা বোঝায় সে ধরণের কোনো তালিকা নেই পুলিশের কাছে। তবে সারা দেশে থানায় দায়ের হওয়া লাখ লাখ মামলার ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত ৭৩ লাখ মানুষের পূর্ণাঙ্গ নথি লিপিবদ্ধ আছে সদর দফতরের কাছে। সে হিসেবে ছিঁচকে চোর থেকে শুরু করে শীর্ষ সন্ত্রাসী সবাই আছে পুলিশের জালে। মূলত দুটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে এসব তথ্য রাখা হচ্ছে। সদর দফতরের সফটওয়্যার ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বা সংক্ষেপে সিডিএমএস আর ডিএমপির সফটওয়্যারটির নাম হলো এসআইভিএস বা সাসপেক্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম। আজাদী

পাঠকের মতামত: