ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ, হাসপাতালে ঠাঁই নেই

ডেঙ্গুর পাশাপাশি ঠান্ডাজনিত রোগের প্রকোপ, বাড়ছে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা

রতন বড়ুয়া, চট্রগ্রাম ::

চট্টগ্রামেও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। আক্রান্তদের ভিড় বাড়ছে হাসপাতালগুলোতে। আতঙ্কেও অনেকে ছুটে যাচ্ছেন। তবে ডেঙ্গুর পাশাপাশি প্রকোপ বেড়েছে শিশুদের ঠাণ্ডাজনিত বিভিন্ন রোগের। বিশেষ করে ব্রঙ্কিউলাইটিস (শ্বাসকষ্ট), নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। হাসপাতালগুলোতে গত কয়েকদিনে আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে। সব মিলিয়ে হাসপাতালগুলোতে যেন ঠাঁই নেই অবস্থা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল এবং আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালসহ নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এমন চিত্র দেখা গেছে।
শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ব্রঙ্কিউলাইটিস, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া ভাইরাস জনিত রোগ। তবে নিউমোনিয়ার প্রকোপ শিশুদের মাঝে সারা বছর কম বেশি দেখা গেলেও ব্রঙ্কিউলাইটিসের প্রকোপ তেমন থাকে না। কিন্তু ঋতু পরিবর্তনের সময় আরএসবি (রেসপিরেটরি সিনসেটিয়াল ভাইরাস) ও ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণজনিত এই রোগের প্রকোপ হঠাৎ বেড়ে যায়। ‘ভাইরাল’ জনিত এসব রোগে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই বললেও এ নিয়ে অভিভাবকদের সজাগ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের শিশু-স্বাস্থ্য বিভাগে অন্য সময় দৈনিক ৩০ থেকে ৩৫ জন শিশু ভর্তি হলেও গত কয়েকদিনে এই সংখ্যা একশ ছাড়িয়ে গেছে। যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। গতকাল দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের ৯নং ওয়ার্ডে ২৭১ জন শিশু ভর্তি রয়েছে। এর মধ্যে মঙ্গলবার একদিনেই ভর্তি হয় একশ জন। অথচ ওয়ার্ডে শয্যা সংখ্যা মাত্র ৬৪টি। হিসেবে ওয়ার্ডটিতে ভর্তি শিশুর সংখ্যা শয্যা সংখ্যার তুলনায় ৪ গুণেরও বেশি। যার কারণে এক শয্যায় অন্তত ৩/৪ জন করে শিশু রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে ওয়ার্ডটিতে। কোনো কোনো শয্যায় এই সংখ্যা আরো বেশি।
একই চিত্র শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের ৮নং ওয়ার্ডেও। ২০ শয্যার বিপরীতে ১৩২ জন শিশু ভর্তি রয়েছে ওয়ার্ডটিতে। আর বিশেষ চারটি ইউনিটসহ শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের মোট ১৩২ শয্যার বিপরীতে কয়েকদিন ধরে পাঁচশরও বেশি শিশু চিকিৎসাধীন বলে জানিয়েছেন শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান প্রনব কুমার চৌধুরী। চিকিৎসাধীন এসব শিশুর প্রায় ৯০ শতাংশই ব্রঙ্কিউলাইটিস রোগে আক্রান্ত বলে জানালেন শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন মাহমুদ। বাকি রোগীদের মধ্যে কিছু সংখ্যক নিউমোনিয়া ও হাতে গোনা কিছু শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত বলে জানান তিনি। শয্যা সংখ্যার অপ্রতুলতার কারণে একটি শয্যায় ৪/৫ জন করে শিশু রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে জানিয়ে ডা. নাসির উদ্দিন মাহমুদ বলেন, এখানে চিকিৎসা নিতে আসা পরিবারগুলোর অধিকাংশই কম সামর্থ্যবান। তাই শয্যা না থাকলেও ভর্তি না করে এখান থেকে কাউকে ফিরিয়ে দেয়া হয় না। যার ফলে এক শয্যায় ৪/৫ জন শিশুকে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এদিকে, শিশু স্বাস্থ্য বিভাগে ৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে বলে নিশ্চিত করেছেন বিভাগের প্রধান ডা. প্রনব কুমার চৌধুরী।
রোগীর অতিরিক্ত চাপ বেড়েছে মেডিসিন বিভাগেও। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মেডিসিন বিভাগের তিনটি ওয়ার্ডে (১৩, ১৪ ও ১৬) মোট শয্যা সংখ্যা ১৭০টি। কিন্তু গতকাল তিন ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি ছিল প্রায় ৬শ’। এর মধ্যে ১৩নং ওয়ার্ডে ৫৪টি শয্যার বিপরীতে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ২২০ জন। মঙ্গলবার একদিনেই ওয়ার্ডটিতে ভর্তি হয় ৫৪ জন। ১৪নং ওয়ার্ডে ৫৪ শয্যার বিপরীতে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১৬৬ জন। এর মধ্যে মঙ্গলবার ভর্তি হয় ৬১ জন। ১৬নং ওয়ার্ডে ৬২ শয্যার বিপরীতে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ১৯৪ জন। ওয়ার্ডটিতে মঙ্গলবারেই ভর্তি হয় ৫০ জন।
মেডিসিন ওয়ার্ডগুলো ঘুরে দেখা গেছে, শয্যা সংকটে মেঝে ছাড়িয়ে ওয়ার্ডের বারান্দা-করিডোরেও ঠাঁই নিতে হয়েছে রোগীদের। ফ্লোরে বিছানা পেতে সেখানেই থাকছেন রোগীরা। মেডিসিন বিভাগের এই তিন ওয়ার্ডে বর্তমানে প্রায় ৬০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন। এসব রোগীকে আলাদা ব্লক করে মশারি টাঙিয়ে দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু ছাড়াও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানান মেডিসিন বিভাগের একটি ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক ডা. অনুপম বড়ুয়া।
১ হাজার ৩১৩ শয্যার হাসপাতালে বুধবার ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৯৩৫ জন বলে জানান হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আখতারুল ইসলাম। রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে রোগীর চাপ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বেসরকারি মা ও শিশু হাসপাতালে। ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালে শয্যার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি করানো হয় না। এরপরও তিনশ রোগী বর্তমানে ভর্তি রয়েছে বলে জানান বেসরকারি হাসপাতালটির শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক ডা. আবু সাঈদ চৌধুরী। তিনি জানান, ভর্তি রোগীদের মধ্যে শ্বাসকষ্টে (ব্রঙ্কিউলাইটিস) আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এর বাইরে নিউমোনিয়া ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। তবে হাসপাতালের বহির্বিভাগে (আউটডোরে) রোগীর সংখ্যা খুব বেশি বেড়েছে বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালেও রোগীর সংখ্যা আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির তত্ত্ববধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথ। তিনি বলেন, বিশেষ করে শিশু ওয়ার্ডের ৩৫টি শয্যার বর্তমানে অধিকাংশই রোগী ভর্তি। শিশুদের মাঝে শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি বলে জানান জেনারেল হাসপাতালের এ তত্ত্বাবধায়ক। এই কয়টি ছাড়াও নগরীর বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগীর সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। শিশুর পাশাপাশি ডেঙ্গু আক্রান্তের ভীড়ও দিনদিন বাড়ছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) তত্ত্বাবধানে পরিচালিত মেমন জেনারেল হাসপাতালের (মেমন-২) বহির্বিভাগে দৈনিক প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন শিশু চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে জানিয়ে হাসপাতালটির কনসালট্যান্ট (শিশু-স্বাস্থ্য) ডা. সুশান্ত বড়ুয়া বলেন, বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা অধিকাংশ শিশুই ব্রঙ্কিউলাইটিস, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত।
সবকয়টি রোগই ভাইরাসজনিত কারণে হয়ে থাকে জানিয়ে এ শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ‘ঋতু পরিবর্তন, ঘর স্যাঁতস্যাঁতে ও অপরিষ্কার থাকা, ঠান্ডা-গরমের মিশ্র আবহাওয়া ও ঠান্ডাজনিত কারণে শিশুদের এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এছাড়া আক্রান্ত শিশুর হাঁচি থেকেও ব্রঙ্কিউলাইটিস রোগটি সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে। মূলত এসব কারণেই আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। এ রোগের লক্ষ্মণ হিসেবে হঠাৎ কাশি বেড়ে যাওয়া, নাক দিয়ে পানি পড়া ও অল্প-অল্প জ্বরের সাথে শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে বলে জানান তিনি। আর এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে রক্ষা পেতে ঘর ও শিশুকে সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, শিশুর নাক পরিষ্কার রাখা এবং শিশুর শরীরে ঠান্ডা লাগতে না দেওয়ার পরামর্শ দেন চমেক হাসপাতালের শিশু-স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. প্রনব কুমার চৌধুরী। তবে শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া কিংবা নিউমোনিয়া দেখা দিলে দেরি না করে শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন মাহমুদ।

পাঠকের মতামত: