ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

বাঁশখালী র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুজন নিহত

বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি ::  গ্রামে হেঁটে যাচ্ছেন। প্রথমে মনে হবে সামাজিক উৎসবে বাজি ফুটছে। খেয়াল করলেই বোঝা যায়, সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো আধিপত্য নিয়ে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত। খবর পেয়ে পুলিশও ছুটে এসে পরিস্থিতি শান্ত করতে ফাঁকা গুলি ছুড়বে। বাজি নাকি বন্দুকের গুলির আওয়াজ খেয়াল না করলে হয়তো প্রাণে মরতে হবে, নয়তো পঙ্গু হতে হবে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এমন কয়েকটি গ্রাম আছে যেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও যেতে ভয় পায়।

এই ভয়াল পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাঁশখালীর মধ্যম সরল গ্রামে গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত র‌্যাবের সঙ্গে ডাকাত গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে দুই ডাকাত নিহত হয়েছে। এরা দুই সহোদর। এদের বড়জন জাফর আহমদ (৪৮) এতটাই ভয়ংকর ছিলেন যে র‌্যাবের হাতে তাঁর নিহত হওয়ার খবরে বাঁশখালী থানা পুলিশও নিজেদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করেছে। তার বিরুদ্ধে বাঁশখালী থানায় ২৭টি মামলা এবং ১১টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। তাঁর ছোট ভাই খলিল আহমদও (৪৩) ডাকাতিতে হাত পাকিয়েছিলেন।

জনপদটির পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াভয় তা থানার দেওয়া তথ্যে বোঝা যায়। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১৫ মাসে

এখানে সন্ত্রাসীদের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের, পুলিশ ও আনসার সদস্য আহত হয়েছে ২২ জন, সাধারণ মানুষ আহত ও পঙ্গু হয়েছে ৮৭ জন, র‌্যাবের ক্রসফায়ারে গতকালের দুজনসহ নিহত হয়েছে ছয়জন, র‌্যাব-পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র্ত্র উদ্ধার করেছে ৪০টি, কার্তুজ উদ্ধার হয়েছে ২৭৩ রাউন্ড।

সন্ত্রাসের শিকার সরল, চাম্বল ও বাহারছড়া গ্রামের মানুষ সম্প্রতি সন্ত্রাসীদের অস্ত্র মহড়া ভিডিও করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়। ভাইরাল হওয়া এসব ভিডিওতে সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের মহড়া দেখে প্রশাসন বিব্রত। বৈলছড়ি, সরল, চাম্বল, ছনুয়া, গণ্ডামারা, বাহারছড়া, খানখানাবাদ, কাথারিয়া ও পুকুরিয়া—এই ৯টি ইউনিয়ন অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারে রীতিমতো অঘোষিত যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিয়েছে। বাকি পাঁচ ইউনিয়ন পুঁইছড়ি, শীলকূপ, সাধনপুর, শেখেরখিল, কালীপুুর ও একটি পৌরসভায়ও অস্ত্রের ঝনঝনানির কমতি নেই।

এসবের হিসাবে দেখা গেছে—সরকারিভাবে পরিত্যক্ত ও মালিকানাধীন কয়েক হাজার একর জমির চিংড়ি ঘের দখল, লবণ মাঠ দখল, বন বিভাগের বিস্তীর্ণ এলাকার পাহাড়ি গাছ কর্তন, পাহাড় কাটা, বালি উত্তোলন, স্ট্যাম্পের মাধ্যমে বন বিভাগের জায়গা বিক্রি ও সেখানে বাড়িঘর তোলা ইত্যাদি নিয়ে কয়েকজন জনপ্রতিনিধি, সন্ত্রাসী ও প্রভাবশালীদের দ্বন্দ্ব। অভিযোগ উঠেছে, এসব বিষয় থেকে লাখ লাখ টাকা জনপ্রতিনিধি ও কতিপয় সরকারি কর্মকর্তার পকেটেও যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অপরাধ দমনে দায়সারা ভাব দেখায়।

বাঁশখালীজুড়ে এখন মানুষের মুখে সশস্ত্র লড়াইয়ের হোতাদের নিয়ে আলোচনা চলে। সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছেন ছনুয়া ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান ও আটটি মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত দুর্ধর্ষ জলদস্যু মো. ইউনুচ, সরল ইউনিয়নের পাঁচটি মামলায় ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক দুর্ধর্ষ ডাকাত শের আলী, সাতটি মামলার পলাতক দুর্ধর্ষ ডাকাত কবির আহমদ ও চাম্বল ইউনিয়নের ছয়টি মামলার পলাতক দুর্ধর্ষ ডাকাত জাকের হোসেন।

সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করতে গিয়ে গত ১৫ মাসে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন কাথারিয়ায় ফেরিওয়ালা আহমদ কবির (৫০) (এই সময় পাঁচ পুলিশও আহত হয়), দক্ষিণ সরল গ্রামে মামলার বাদী আবুল কালাম (৪২), পুকুরিয়ায় লিচু ব্যবসায়ী মো. আমিন (৫০), খানখানাবাদের ডোংরা গ্রামের অটোরিকশাচালক ফোরখ আহমদ ওরফে লেদু (৪০) সহ ৯ জন।

র‌্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ গত ২৫ মার্চ নিহত হন ছনুয়ার এক জনপ্রতিনিধির দেহরক্ষী হিসেবে পরিচিত সাতটি মামলার দুর্ধর্ষ জলদস্যু মো. তালেব (৩৮), ১১ এপ্রিল নিহত হন একই এলাকার আরেক দুর্ধর্ষ ডাকাত ও ১২ মামলার পলাতক আসামি দেলোয়ার হোসাইন ওরফে হোসাইন্য (৪০), গত ৫ মে নিহত হয় ছনুয়ার খুদুকখালী গ্রামের দুর্ধর্ষ ডাকাত ও সাত মামলার আসামি সোলতান বাহাদুর (৪৭)। এ ছাড়া এক শিশুছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে শেখেরখিল ইউনিয়নে মো. আলী নামে একজনও ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়। এদের লাশের পাশ থেকে উদ্ধার হয় বিপুলসংখ্যক অস্ত্র ও কার্তুজ। এ ছাড়া পুলিশ সরল, চাম্বল, গণ্ডামারা, পুঁইছড়ি, বাহারছড়া, খানখানাবাদসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে আরো আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করেছে।

গত বুধবার বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোমেনা আক্তারের সভাপতিত্বে আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সহকারী কমিশনার (ভূমি), বাঁশখালী থানার ওসি, সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় সংসদ সদস্যের ব্যক্তিগত সহকারী, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ১৪ চেয়ারম্যান, একটি পৌরসভার মেয়র ও সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। ইউএনও মোমেনা আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া ও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এই জরুরি বৈঠক হয়েছে। প্রশাসনের তরফ থেকে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে। অস্ত্রবাজ, মদদদাতা ও বন্দুকযুদ্ধের সুবিধাভোগী কেউ রক্ষা পাবে না। সন্ত্রাসীদের তালিকা তৈরি করতে প্রত্যেক জনপ্রতিনিধিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

উপজেলা চেয়ারম্যান চৌধুরী মোহাম্মদ গালিব সাদলী বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা শুধু অস্ত্রের মাধ্যমে নয়, ফেইক আইডি খুলে ফেসবুকের মাধ্যমে উসকানি ছড়াচ্ছে। প্রত্যেকের অবস্থান থেকে কঠোরভাবে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দমন করতে হবে।’

সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর ব্যক্তিগত সহকারী ও বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বাহারছড়ায় সন্ত্রাসীদের ভয়াবহ বন্দুকলড়াই খুবই আতঙ্কের বিষয়। বাঁশখালীর অন্যান্য স্থানেও যা হচ্ছে তা খুবই খারাপ। আমি আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় বলেছি, যারা এই অস্ত্রের লড়াইয়ে লিপ্ত তাদের ধূলিসাৎ করে দিতে হবে। এক পক্ষকে প্রশাসন বুকে নিবে, আরেক পক্ষকে প্রশাসন পিঠে নিবে তা হয় না।’

চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চৌধুরী বলেন, ‘চাম্বল ইউনিয়ন জামায়াত অধ্যুষিত জঙ্গি এলাকা। একসময় পুলিশও ভয়ে এখানে আসত না। আমি চাম্বলকে যখন শান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছি তখন সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নিয়ে স্থানীয় বনবিট কর্মকর্তা শেখ আনিসুজ্জামান গত তিন মাস ধরে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে পাহাড়ের গাছ, মাটি, বালু উত্তোলন, স্ট্যাম্পের মাধ্যমে জায়গা বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা কামাই করছেন। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে বদলি হননি এই বিট কর্মকর্তা। প্রায় ১৫ একর জায়গার গাছ কেটে ফেলেছেন তিনি। আমি ১৯ জুন এই বন কর্মকর্তাসহ তিনজনের অপকর্মের বিষয়ে দালিলিক প্রমাণ ইউএনওকে দিয়েছি।’

কাথারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘একসময় প্রবাদের মতো বলা হতো, চেয়ারম্যানরা সন্ত্রাসী লালন-পালন করেন। আমি চেয়ারম্যান হয়ে দেখছি ভিন্নরূপ। প্রভাবশালী সন্ত্রাসীরা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে। অবোধ শিশুর হাতেও এখন অস্ত্র। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের তালিকা দিলেও পুলিশ তাদের ধরে না।’ সরল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রশিদ আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘সরলে ব্যাপকহারে অস্ত্রের মহড়া বেড়ে গেছে।’

বাঁশখালী থানার ওসি মো. রেজাউল করিম মজুমদার বলেন, ‘আমি সবেমাত্র যোগদান করেছি। সশস্ত্র লড়াই ও অস্ত্রের মহড়ার বিষয়টি নিয়ে আমি স্থানীয় চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও অবহিত করেছি। কারা এসব অপরাধ ঘটাচ্ছে তাদেরও তালিকা তৈরি হচ্ছে। খুব শিগগির এর ফলাফল বাঁশখালীবাসী পাবে।’

র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুজন নিহত হওয়া প্রসঙ্গে র‌্যাব-৭-এর মিডিয়া অফিসার মো. মাশকুর রহমান বলেন, ‘র‌্যাব-৭-এর একটি টহল দল সরল ইউনিয়নের মধ্যম সরল গ্রামে নিয়মিত অভিযান পরিচালনাকালে জাফর গ্রুপের সন্ত্রাসীরা র‌্যাবের দিকে গুলি ছোড়ে। র‌্যাবও পাল্টা গুলি ছুড়লে বন্দুকযুদ্ধে ওরা নিহত হয়। র‌্যাবের তিন সদস্যও আহত হয়েছে।’

র‌্যাবের বন্দুকযুদ্ধে জাফর নিহত হওয়ায় পুলিশের পক্ষ থেকে মিষ্টি বিতরণ করার কথা জানিয়ে বাঁশখালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামাল উদ্দিন চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘এই দুর্ধর্ষ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে পুলিশ অসংখ্যবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল।’

পাঠকের মতামত: