ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

হালদায় বিপর্যয়: এক বছরের ব্যবধানে কমবে দুইশ কোটি টাকার মাছ

অনলাইন ডেস্ক ::

এক বছরের ব্যবধানে হালদা নদী থেকে প্রাপ্ত ডিমে প্রায় দুইশ কোটি টাকার কম মাছ উৎপাদন হবে। পরিবেশ বিপর্যয়সহ বিভিন্ন কারণে মাছের ডিম ছাড়ার পরিমাণ দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি কমে গেছে। যা দেশের মোট মাছ নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে অভিমত মৎস্য বিশেষজ্ঞদের।

এদিকে হালদা গবেষকরা এ বছর মাছের ডিম ছাড়ার পরিমাণ কমে যাওয়ার কয়েকটি বিশেষ কারণ উল্লেখ করেছেন। তারা বলছেন, মৎস্য প্রজননের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা ‘কারণগুলোর’ উত্তোরণ ঘটানো গেলে হালদা অতীতের মতো অনন্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে এবছর মা মাছ আশানুরূপ ডিম ছাড়েনি। মৌসুমের একেবারে শেষ সময়ে এসে ডিম ছাড়লেও তা ছিল প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে বিশেষ করে এপ্রিল, মে, জুন এই তিন মাসে নদীর পরিবেশগত কিছু বৈশিষ্ট্য যেমন- ভৌতিক, রাসায়নিক এবং জৈবিক কারণে হালদা নদীতে মাছ ডিম ছাড়তে আসে। অমাবস্যা বা পূর্ণিমার ‘জো’ বা তিথিতে বজ্রসহ প্রচুর বৃষ্টিপাত, উজানের পাহাড়ি ঢল, তীব্র স্রোত, ফেনিল ঘোলা পানিসহ নদীর ভৌত-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যগুলোর সমন্বিত ক্রিয়ায় হালদা নদীতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলে কার্প জাতীয় মাছ বর্ষাকালে ডিম ছাড়ে। গত কয়েক বছর এপ্রিলের প্রথম থেকে তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে মা মাছ ডিম ছাড়লেও এবছর মে মাসের শেষ পূর্ণিমার জো অতিক্রম করলে স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারীরা অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েন। তবে গত ২৪ মে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হলে নদীতে মা মাছের ডিম ছাড়ার ব্যাপারে সকলেই আশাবাদী হয়ে উঠেন। ২৫ মে রাতে নদীতে ডিম সংগ্রহ শুরু হয়।

মৎস্য অধিদপ্তর এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি যৌথভাবে হিসাব করে জানায়, হালদায় মোট ৭ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছে। তবে এর পরিমাণ অত্যন্ত কম হওয়ায় অনেকেই হতাশা ব্যক্ত করেন। এক বছরের ব্যবধানে সংগৃহিত ডিমের পরিমাণ দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি কমে গেছে। গত বছর হালদায় সর্বমোট ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছিল।

হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, এবছর চারদিনের রেণু প্রতি কেজি ৮০ হাজার টাকা করে বিক্রি হয়েছে। রেণু থেকে পোনা ফোটানোর পর বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন দামে তা বিক্রি হয়। এবছর প্রাপ্ত ৭ হাজার কেজি ডিম থেকে এক বছর পর প্রায় ৭৫ কোটি টাকার মাছ উৎপাদিত হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ হিসেব তৈরি করার ক্ষেত্রে তিনি পৃথক চারটি ধাপ অনুসরণ এবং প্রতিটি ধাপে ৬০ শতাংশ পোনা বাদ দিয়ে হিসেব কষেছেন। এক বছর বয়সী প্রতি কেজি মাছের দাম ধরা হয়েছে ১৫০ টাকা করে। বাজারে এক বছর বয়সী রুই মাছের দাম কেজিপ্রতি ১৫০ টাকার চেয়ে বেশি হবে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, চলতি বছর যে পরিমাণ পোনা উৎপাদন হয়েছে তা আগামী এক বছর পর বাজারে একশ’ কোটিরও বেশি টাকার মাছে পরিণত হবে। ফলে এবছর ডিম কম সংগ্রহ হওয়ায় গত বছর থেকে অন্তত দুইশ’ কোটি টাকার কম মাছ উৎপাদিত হবে। গত বছর ২২ হাজার ৬০০ কেজি ডিম থেকে প্রায় তিনশ’ কোটি টাকার মাছ বাজারে এসেছিল।

হালদা নদী নিয়ে এ বছর সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বেশ ভালো কিছু পরিকল্পনা এবং কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছিল। হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গণমুখী। কিন্তু এত আয়োজনের পরও প্রত্যাশিত ডিম না পাওয়া কিংবা মাছের ডিম না ছাড়ার জন্য বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে।

অধ্যাপক মোহাম্মদ মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, এবছর মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়া ডিম সংগ্রহে ভাটা পড়ার একটি বড় কারণ। এপ্রিল মে এবং জুন মাসের মোট ৬টি জো’র মধ্যে এপ্রিল-মে মাসের ৪টি জো’ শেষ হয়েছিল পর্যাপ্ত বৃষ্টিবাদল ছাড়া। একেবারে শেষ জো তে এসে মাছ ডিম ছেড়েছে। এতে দীর্ঘ সময় পরিপক্ক গোনাড নিয়ে মা মাছগুলো অস্বস্তিকর অবস্থায় ছিল। এপ্রিল-মে মাসের অতিরিক্ত তাপমাত্রা এতে আরো প্রভাব ফেলে। এ অবস্থায় পূর্ণিমার জো না থাকা সত্ত্বেও ২৪ তারিখের ভারি বৃষ্টিপাতে পাহাড়ি ঢলের প্রভাবে ২৫ তারিখ রাতে মা মাছ ডিম ছাড়ে। এটিকে অস্বাভাবিক বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মার্চের শেষ বা এপ্রিলের প্রথম দিকে কালবৈশাখীসহ প্রথম ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে নদীর অববাহিকায় জমে থাকা দূষিত পদার্থ ও আবর্জনা নদীতে মিশে যায়। আমাবস্যা বা পূর্ণিমার সময় দ্বিতীয় ভারি বৃষ্টিপাতের সময় মা মাছ ডিম দেয়। কিন্তু এবার বৃষ্টি না হওয়ায় নদীতে মিশে যাওয়া দূষিত পদার্থ একটি অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। এবছর পানির পিএইচএর মাত্রা ছিল ৮ এরও বেশি। যা ডিম ছাড়াসহ মাছের স্বাভাবিক প্রজননে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, জৈবিক, ভৌতিক ও রাসায়নিক অনুকূল পরিবেশ এবং নিরাপদ আবাসস্থল মাছের স্বাভাবিক প্রজননের পূর্ব শর্ত। কিন্তু ২০১৮ সালের বছরব্যাপী এবং ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত হালদা নদীর প্রজনন এলাকায় নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনে বড় আকৃতির বার্জ, বোট ও ট্রলারের প্রতিনিয়ত অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিত চলাচলে হালদা নদীর বাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশ, মাছ ও ডলফিনসহ জীববৈচিত্রের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি অবৈধ বালি উত্তোলনের ড্রেজার চলাচল ছিল অনিয়ন্ত্রিত। আঘাতজনিত কারণে ১৯টি ডলফিন এবং ৯টি মা মাছের মৃত্যুই নদীজুড়ে মানুষের অনিয়ন্ত্রিত কর্মকাণ্ডের প্রমাণ বহন করে। এর আগে আর কোনো দিন এত বিপুল সংখ্যক মা মাছ এবং ডলফিনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।

অন্যদিকে কেরামতলির বাঁক থেকে রামদাশ মুন্সির হাট পর্যন্ত ৯টি ‘কুমের’ মধ্যে ৭টি কুম সংলগ্ন নদীর বাঁকে ভাঙন প্রতিরোধ ব্ল্লক ও জিও ব্যাগ দেওয়ার ফলে মাছের আবাসস্থল নষ্ট হওয়া ডিম প্রাপ্তির পরিমাণকে প্রভাবিত করেছে। এছাড়া গত কয়েক বছর ধরে নদীর উজান এলাকায় তামাক চাষ বৃদ্ধি, ১৮টি শাখা খালে স্লুইসগেট নির্মাণ, মূল নদীতে ভূজপুর রাবার ড্যাম তৈরি, শিল্প বর্জ্য, মা মাছ নিধন ও খন্দকিয়া খালের দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় এক বছরের ব্যবধানে ডিম সংগ্রহ ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে বলে দাবি সূত্রগুলোর।

পাঠকের মতামত: