ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

মরে যাচ্ছে মাতামুহুরী!

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::

১ কোটি ২২ লক্ষ টাকা ব্যয়ে লামা ও আলীকদমে দু’টি খাল (ঝিরি) খনন করা হলেও অস্বাভাবিক ভাবে নাব্যতা হ্রাস পাওয়া মাতামুহুরী নদী খননের কোন উদ্যোগ নেই। মাতামুহুরী নদীর লামা ও আলীকদম অংশে অস্বাভাবিকভাবে নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়ে পুরো নদী জুড়ে জেগে উঠেছে কচ্ছপের পিঠের মত করে অসংখ্য বালির চর। অব্যাহত বৃক্ষ নিধন, জুম চাষ, নদীর তীরে তামাক চাষ এবং বিধি বহির্ভূতভাবে পাথর আহরনের বিরূপ প্রভাবে মাতামুহুরী দ্রুত নাব্যতা হারিয়ে ক্রমশ মরা নদীতে পরিণত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
সূত্র জানায়, মায়ানমারের আরাকান রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত ক্রাউডং বা ময়বার পর্বতমালা থেকে মাতামুহুরী নদী উৎপন্ন হয়ে আলীকদমের রিজার্ভ বনভূমির উপর দিয়ে সর্পিল গতিতে প্রবাহিত হয়ে উত্তর দিকে লামা উপজেলা পর্যন্ত এসে পশ্চিম দিকে কক্সবাজারের চকরিয়া অভিমুখে প্রবাহিত হয়ে গেছে। এ নদীর উৎপত্তি স্থান থেকে ৩২৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ১২টি খাল ও ৫৪ টি ঝিরি নিয়ে চকরিয়া উপজেলার বেতুয়া বাজারের কাছে দু’টি ধারায় বিভক্ত হয়ে মহেশখালী চ্যানেলে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। মাতামুহুরী নদীর সাথে এর আশ-পাশের লোকজনের জীবন জীবিকার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এ নদীটি তার অববাহিকায় বসবাসকারি জনগোষ্ঠীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে মূখ্য ভূমিকা পালন করছিলো।
তবে গত কয়েক দশক ধরে এক শ্রেণির লোভী মানুষের কালো থাবায় বিভিন্ন ধরনের আগ্রাসনের শিকার হয়ে নদীটির নাব্যতা অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পেয়ে ঐতিহ্যবাহি এ নদী হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। এ নদীর যেখানে অথৈ পানি আর বিভিন্ন প্রজাতির মাছ থাকার কথা, সেখানে এখন বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ। লামা ও আলীকদম অংশে অস্বাভাবিকভাবে নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় নদীর তলদেশের প্রায় পুরো অংশ জুড়ে এখন সবুজ ফসলের মাঠ। উপর থেকে নেমে আসা পাহাড়ি বালি আর মাটি জমে নাব্যতা হারানোর কারণে পুরো নদী জুড়ে জেগে উঠেছে বিশাল আকারের বালির চর। স্থানীয় জনসাধারণ সে চরে নির্বিঘ্নে চলতি মৌসুমে ফলাচ্ছে বিভিন্ন ফসল।
গত এক দশক পূর্বেও এ নদীর গভীরতা ছিল ২৫/৩০ ফুট।
বর্তমানে পুরো নদীর দু’এক জায়গা ব্যতিত কোথাও গভীরতা খূঁজে পাওয়া যায়না।
জানা গেছে, অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়ি ছড়া ও ঝিরি থেকে মাটি খনন করে এবং বারুদের বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে গত কয়েক বছর যাবত ব্যাপক হারে পাথর আহরণের ফলে পাহাড়গুলো বর্ষা মৌসুমে ধসে পড়ে। ধসে পড়া পাহাড়ের বালি ও মাটি মাতামুহুরী নদীতে জমে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। অপরদিকে, সম্প্রতি বছরগুলোতে এর সাথে যুক্ত হয়েছে মাতামুহুরী নদীর তীর কেটে এবং পাহাড়ি ঝিরির (খাল) পাড় কেটে তামাক চাষ।
নদীর তীরে তামাক চাষের জন্য চাষীরা অপরিকল্পিতভাবে নদীর দু’তীর কেটে তামাক চাষের উপযোগী করে তোলে। তার পর সেখানে বোরো ও রবি মৌসুমে চাষীরা তামাক চাষ করে । নদী এবং ঝিরির পাড়ে চাষাবাদের উপযোগী করে তোলা নরম মাটি বর্ষায় বৃষ্টির পানি এবং পাহাড়ি ঢলের পানিতে ভেসে যায়। ভেসে যাওয়া এসকল মাটি আঁকা বাাঁকা মাতামুহুরী নদীর বিভিন্ন বাঁকে এবং কূপে জমে নদী ভরাট হয়ে দ্রুত নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। গত ৩/৪ বছর ধরে অস্বাভাবিকভাবে এ নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় এলাকার মানুষ আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। বর্ষা মৌসুমে সামান্য বৃষ্টিতে মাতামুহুরী নদী পরিপূর্ণ হয়ে দু’কুল ফেপেঁ উঠে লামা ও আলীকদমে বন্যার সৃষ্টি করে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।
এদিকে, লামা ও আলীকদমে ১ কোটি ২২ লক্ষ টাকা ব্যয়ে শুরু হয়েছে দু’টি খাল পূনঃ খনন প্রকল্প। বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০, শত বর্ষের ডেল্টা প্ল্যান এর অংশ হিসেবে ৬৪ জেলার অভ্যন্তরস্থ ছোট নদী, খাল এবং জলাশয় পুনঃ খনন প্রকল্পের (১ম পর্যায়) আওতায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে প্রকল্প দু’টি বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্প দু’টি হচ্ছে লামা পৌরসভার মধুঝিরি খাল এবং আলীকদমের মোস্তাক পাড়া ঝিরি (খাল) পুনঃ খনন। অস্বাভাবিকভাবে ভরাট হয়ে যাওয়া মাতামুহুরী নদী খনন না করে, নদী সংলগ্ন খাল খনন করাকে সরকারি অর্থের অপচয় বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
মাতামুহুরী নদী খননের বিষয়ে বান্দরবান পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রকিবুল হাসান জানান, সাংগু ও মাতামুহুরী নদী পূনরুদ্ধারের সম্ভাব্যতা যাছাই সম্পর্কিত একটি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রকল্পটির কাজ শুরু হলেই নদী দু’টির বর্তমান অবস্থার উন্নতি হবে।
প্রমত্তা মাতামুহুরীর তলদেশে এখন আর অথৈ পানি নেই। নেই জেলেদের জাল ফেলার সুযোগ। সর্বত্রই জেগে রয়েছে কচ্ছপের পিঠের মত বালির চর। জরুরী ভিত্তিতে দ্রুত এ নদীর ড্রেজিংয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন স্থানীয়রা।

পাঠকের মতামত: