ঢাকা,বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

হুন্ডির ১০ সিন্ডিকেট সক্রিয় রিয়াজুদ্দিন বাজার-তামাকুমন্ডি লেইন ঈদ সামনে রেখে আসছে শত শত কোটি টাকা

অনলাইন ডেস্ক ::  ব্যাংকিংয়ে নানা হয়রানির অজুহাতে সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশ থেকে প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে হুন্ডি। বিশেষত রমজানের ঈদকে সামনে রেখে শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আসছে হুন্ডির মতো নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে। আন্তর্জাতিক স্বর্ণ ও মুদ্রা চোরাচালান চক্রের এজেন্ট হিসেবে চট্টগ্রামেও বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট এ হুন্ডি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। নগরীর রিয়াজুদ্দিন বাজার ও তামাকুমন্ডি লেইনে অন্য ব্যবসার আড়ালে হুন্ডি ব্যবসার কমপক্ষে ১০টি সিন্ডিকেট রয়েছে। এদের সাথে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের সম্পর্ক।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্বর্ণ ও মুদ্রা চোরাচালানের পাশাপাশি হুন্ডি ব্যবসার মাধ্যমে দেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। নগর গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, শুধু রমজানে নয়, সারা বছরেই হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাসীদের টাকা দেশে আসে। হুন্ডি প্রতিরোধে পুলিশ সবসময় সতর্ক।
চট্টগ্রামের ছেলে কায়সার (ছদ্মনাম) দীর্ঘদিন ধরে দুবাই থাকেন। তিনি ব্যাংকিং চ্যানেলে না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠান। দুবাইয়ে থাকা হুন্ডির এজেন্টদের কাছে টাকা জমা দিয়ে দেশে তার ছোট ভাই রিয়াদকে (ছদ্মনাম) ফোনে জানিয়ে দেন। প্রবাসী ভাইয়ের কাছ থেকে ফোন পাওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যেই রিয়াদের ফোনে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে বলা হয়, ‘ভাই আপনার একটি চালানি আছে?’ এপাশ থেকে সম্মতিসূচক জি বলতেই অপর প্রাপ্ত থেকে বলা হয়, কত?। রিয়াদ বলেন, ‘দুই চল্লিশ’। অপর প্রান্ত থেকে নিশ্চিত হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই রিয়াদের দেওয়া ঠিকানায় চলে আসে অপরিচিত ওই ব্যক্তি। দুটি এক হাজার টাকার বান্ডেল এবং আরো ৪০টি এক হাজার টাকা নোট দিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন অপরিচিত ওই ব্যক্তি। কথোপকথনের ‘দুই চল্লিশ’ মানে দুই লাখ চল্লিশ হাজার টাকা।
এভাবে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয় হুন্ডিতে। শুধু দুবাই প্রবাসী কায়সার নন, প্রবাসীদের একটি বড় অংশ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করা প্রবাসীদের বেশিরভাগই হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রবাসীদের অভিযোগ, ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে হয়রানির শিকার হতে হয়। কিন্তু হুন্ডিতে টাকা দেওয়ার ঘণ্টার মধ্যেই ঘরে পৌঁছে যায়।
প্রবাসীদের এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রামে হুন্ডির অসংখ্য সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বিশেষত নগরীর রিয়াজুদ্দিন বাজার ও তামাকুমন্ডি লেইনের প্রায় ১০টি সিন্ডিকেট হুন্ডির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা ব্যবসা করছে। আন্তর্জাতিক স্বর্ণ ও মুদ্রা চোরাচালান চক্রের এজেন্ট হিসেবে এসব সিন্ডিকেট দেশে বসেই হুন্ডি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য আগে প্রবাসী পরিবারে টাকা পৌঁছে দেওয়ার পরেই বিদেশে অবস্থান করা প্রবাসীর কাছ থেকে টাকা গ্রহণ করে হুন্ডি এজেন্টরা।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন হুন্ডি এজেন্ট জানান, দুবাইয়ে প্রবাসীদের কাছ থেকে যে টাকা গ্রহণ করা হয়, সে টাকা দেশে আসে না। এখানকার এজেন্ট যারা স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত, তারা প্রবাসী পরিবারে যে পরিমাণ টাকা পৌঁছে দেয় সে পরিমাণ টাকা মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে। এরপর ওই টাকার সমপরিমাণ স্বর্ণ চোরাইপথে দেশে আনা হয়। এভাবে বাংলাদেশে স্বর্ণ আসার পর সেই স্বর্ণের একটি অংশ আবার ভারতে পাচার করা হয়। ভারতে পাচার হওয়া ওই স্বর্ণের টাকায় ভারত থেকে গরু নিয়ে আসে চোরাচালান চক্রের সদস্যরা। রমজানের ঈদ ও কোরবানির আগে হুন্ডির মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি টাকা আসে বলে জানান তারা।
এভাবে চোরাচালানের মাধ্যমে ব্যবসা হচ্ছে আর রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। হুন্ডির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রিয়াজুদ্দিন বাজার ও তামাকুমন্ডি লেইনে অন্য ব্যবসার আড়ালে জনৈক সরোয়ার, বাবলু, ইমরান, ফয়েজ, আকতার, আলম, সাইফুল, আজিজ ও বেলাল হুন্ডি ব্যবসার সাথে জড়িত। এর মধ্যে সরোয়ার ও বাবলু আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালান ও মুদ্রা পাচারের সাথে জড়িত। চট্টগ্রামে ব্যবসা থাকলেও সরোয়ার ঢাকায় বসেই হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ করেন। চট্টগ্রামে খোকা নামে তার এক সহযোগী রয়েছে।
জানা যায়, চলতি বছরের ৩ মার্চ পুলিশ নগরীর সিআরবি এলাকায় একটি প্রাইভেট কার থেকে ৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা মূল্যের ১শ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করে। এর মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের জোরারগঞ্জে আরেকটি প্রাইভেটকারে তল্লাশি চালিয়ে ২৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা মূল্যের ৬শ পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করে পুলিশ। দুই ঘটনায় জড়িতরা রিমান্ডে এসব স্বর্ণ রিয়াজুদ্দিন বাজার থেকে পাচারের জন্য নিয়ে যাচ্ছিল বলে স্বীকার করে।
একইভাবে ২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি রিয়াজুদ্দিন বাজারের বাহার মার্কেট থেকে সিন্দুকভর্তি ২৫০ পিস স্বর্ণের বার ও নগদ ৬০ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। এর আগে ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল সদরঘাট এলাকার একটি ইলেকট্রনিঙ পণ্যের গুদাম থেকে ২০ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রায় সবগুলো ঘটনায় রিয়াজুদ্দিন বাজার ও তামাকুমন্ডি লেইনের নাম উঠে আসে।
এ ব্যাপারে রিয়াজুদ্দিন বাজার বণিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি মাহবুবুল আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘রিয়াজুদ্দিন বাজার বিশাল একটি বাণিজ্যকেন্দ্র; যেখানে হাজার হাজার ব্যবসায়ী রয়েছেন। এখানে বৈধ-অবৈধ সবকিছুর সংশ্লেষ থাকতে পারে। তবে অবৈধ কিছুর সাথে ব্যবসায়ী সংগঠন হিসেবে আমাদের সমর্থন নেই। কারণ অবৈধ ব্যবসায়ীদের কারণে বৈধ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন।’
তামাকুমন্ডি লেইন বণিক সমিতির সভাপতি সামশুল আলম বলেন, ‘কোনো অবৈধ ব্যবসার সাথে আমাদের সমিতির সদস্যরা জড়িত নন। হুন্ডির মতো কোনো অবৈধ ব্যবসাকে আমরা সমর্থন করি না।’
অবৈধ নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসার কারণে ব্যাংকিং খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট ব্যাংকার, মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড চট্টগ্রামের জোনাল হেড জসিম উদ্দিন বাবুল। তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘প্রবাসীদের কামানো টাকায় যেখানে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হতো, সেখানে হুন্ডির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসার মধ্য দিয়ে ব্যাংকিং খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারও রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে।’
তবে শুধু স্বর্ণ চোরাচালান নয়, দেশের ব্যাংকিং পুঁজি হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম। আবার কালো টাকা সাদা করার জন্যও হুন্ডিকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ। তিনি আজাদীকে বলেন, ‘কালো টাকার মালিকরা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করছে। আবার তারা পাচারকৃত অর্থ নিজেদের আত্মীয়-স্বজনকে দিয়ে ফরেন এঙচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠানোর মধ্য দিয়ে কালো টাকা সাদা করছেন।’
নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) মিজানুর রহমান আজাদীকে বলেন, ‘শুধু রমজান কিংবা ঈদকে সামনে রেখে নয়, পুরো বছরই হুন্ডি ব্যবসা চলে। হুন্ডি প্রতিরোধে আমরা সবসময় সচেষ্ট। হুন্ডি প্রতিরোধে নগরীর চারদিকে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে।’

পাঠকের মতামত: