ঢাকা,শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

মাতামুহুরী নদীর ভাঙনে নিঃস্ব অসংখ্য পরিবার

ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া :: পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদীকে একসময় বলা হতো মানুষের জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু গত দশ বছর ধরে এই নদী আশীর্বাদের বদলে অভিশাপে পরিণত হয়ে উঠেছে। প্রতিবছর একাধিক ভয়াবহ বন্যায় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানির সঠিক প্রবাহ না হওয়ায় এবং নদীর ভয়াল থাবায় সর্বনাশ ঘটছে কক্সবাজারের চকরিয়ার মানুষের। বিশেষ করে মাতামুহুরী নদী বিধৌত ইউনিয়ন এবং চকরিয়া পৌরসভার মানুষ সর্বস্ব হারানোর তালিকায় বেশি স্থান করে নিচ্ছে। প্রতিবছর বন্যা এর আগের বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। একদিনের বৃষ্টিতেই নদী উপচে বন্যার পানি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে, নদী ভাঙনে ভিটেছাড়া হচ্ছে মানুষ, বিলীন হচ্ছে কোটি কোটি টাকার কৃষি ক্ষেত, বছরজুড়ে চেষ্টায় মেরামতকৃত সড়ক মুহূর্তেই ভেঙে খান খান হচ্ছে। গবাদিপশুর খামার তছনছ হয়েছে। বেকার হয়ে পড়েছে মানুষ। প্রতিবছরই বন্যার সাথে লড়াই করা মানুষগুলো হার মানছে মাতামুহুরীর এই তান্ডবের কাছে। এই অবস্থায় সামনে আসছে আবারো বর্ষাকাল। কিন্তু বরাবরের মতোই নদীর তীর সংরক্ষণ টেকসইভাবে নির্মাণ না হওয়ায় সামনের বর্ষায়ও মাতামুহুরী নদীর দুই তীরে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দেবে। বর্তমানেও বিভিন্নস্থানে নদীর তীর ভাঙন চলছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০১২ সালের বন্যা ছিল সর্বোচ্চ রেকর্ড, তখন মাতামুহুরী নদীতে পানি ছিল বিপদসীমার ওপরে প্রায় ৬ দশমিক ৮ মিটার। ১৯৯৮ সালে ছিল ৬ দশমিক ৭ মিটার। সেই দুটি বন্যাই ছিল জুলাই মাসে। কিন্তু ২২ জুন ২০১৫ সালের বন্যায় মাতামুহুরী নদীর চিরিঙ্গা পয়েন্টে পানি ছিল ৭ দশমিক ৬ মিটার, এরপর ৭ জুলাই ছিল ৬ দশমিক ৬ মিটার, ২৮ জুলাই ছিল ৭ দশমিক ২ মিটার এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১ আগষ্ট ছিল ৭ দশমিক ৩ মিটার। চারটি বন্যার তিনটিই ছিল ২৭ বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ড।
সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতে দিনের মধ্যেই বন্যা ঃ
২০১৭ সালে মৌসুমের পুরো জুলাই মাসে ৭৬৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার পূর্বাভাস দেয় আবহাওয়া অধিদপ্তর। কিন্তু আটদিনেই বৃষ্টিপাত হয়েছে ৫৫৩ মিলিমিটার। এরমধ্যে শুধু ৬ জুলাই বৃষ্টিপাত হয়েছে ৯৩ মিলিমিটার! এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভালো- একনাগাড়ে ভারী বর্ষণ হলেও কখনো চকরিয়া ডুবে যায় না। উজানে অবস্থিত লামা-আলীকদমে বৃষ্টির ওপরই চকরিয়া-পেকুয়া বন্যায় ভেসে যায়। আর মৌসুমের শুরুতেই লাগাতার ভারী বর্ষণে দিনের মধ্যেই ডুবে যায় জনপদ।
তামাক চাষ ও পাহাড় উজাড় বন্যার মূল কারণ ঃ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তামাক চাষ, পাহাড় উজাড় করে ফেলা ও পাহাড় থেকে নিয়ম না মেনে পাথর উত্তোলন বন্যার মূল কারণ। প্রধানত তামাক পাতা পোড়ানোর চুল্লিতে ব্যবহৃত হচ্ছে গাছ। এছাড়া ন্যাড়া পাহাড় খুঁড়ে গাছের গোড়ালি পর্যন্ত তুলে এনে ব্যবহার করা হচ্ছে তামাক চুল্লিতে। আর বনখেকোদের কবলে পড়ে বেশিরভাগ পাহাড় এখন প্রায় ন্যাড়া পাহাড় পরিণত হয়েছে, সেখানে নেই কোন নতুন করে সবুজাভ। এ কারণে ব্যাপক বৃষ্টিপাত দূরে থাক সামান্য বৃষ্টিতেই এসব পাহাড় ধ্বসে মাটি-বালি নদীতে গিয়ে পড়ছে। এতে নদীর তলদেশ দ্রুতই ভরাট হয়ে গেছে। আর সামান্য বৃষ্টিতেই নদী উপচে বন্যার পানি সমতল গিলে খাচ্ছে। সেইসাথে পানি নেমে যাওয়ার পর পরই দেখা দেয় নদীতীরের তীব্র ভাঙন।
এ বিষয়ে কাকারার বাসিন্দা মাহমুদুর রহমান মাহমুদ বলেন, পাহাড় নিধন, বৃক্ষরাজি উজাড়ের পাশাপাশি পাথর উত্তোলনের কারণে প্রতিবছর ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। পানি নেমে যাওয়ার পর পরই দেখা দেয় তীব্র নদীভাঙন। কিন্তু প্রতিবারই পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীর তীর সংরক্ষণ বা ড্রেজিংয়ের নামে সরকারের কোটি কোটি টাকার জলাঞ্জলি দিলেও কার্যত কোন সুফল পায়না মানুষ। এতে ফের বন্যা পরবর্তী মাতামুহুরী নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করে। তখন নদীতীরের মানুষগুলোর কপালে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। ভিটে-বাড়িসহ সহায়-সম্পদ চলে যায় নদীগর্ভে।
সর্বশেষ দুই বন্যায় ক্ষতি তিন হাজার কোটি টাকা ঃ
বিগত ২০১৫ সালের প্রলয়ংকরী বন্যায় শুধু চকরিয়ায় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরূপণ করেছিল উপজেলা প্রশাসন। ৪০ বছরের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ চারদফা বন্যায় উপজেলার পাঁচ লাখ মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ভেসে গিয়েছিল দেশের বড় মৎস প্রজেক্টের কয়েকশত কোটি টাকার মাছ। বিধ্বস্ত হয়েছিল সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা।
ভেঙে যায় বেড়িবাঁধ ও নদীর তীর সংরক্ষণ বাঁধ। ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে ৫ লক্ষ মানুষকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে বিশেষ বরাদ্দ দাবি করে ১৩ দফা প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রস্তাবনার সামান্য অংশ বাস্তবায়িত হলেও বাকী প্রস্তাবনা আলোর মুখ দেখেছি। তার ওপর চলতি ২০১৭ সালের দুইদফা ভয়াবহ বন্যায় সবকিছু চুরমার করে দিয়ে গেছে। ওইসময়ের দুইদফা বন্যায় আরো ক্ষতি হয় প্রায় হাজার কোটি টাকা। এই অবস্থায় সামনে চলে আসছে বর্ষাকাল। এতে নদীতীরের মানুষগুলোর মধ্যে এখন থেকে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
মাতামুহুরী নদী যথাযথভাবে শাসন হয়নি একবারও ঃ
পার্বত্য বান্দরবানের থানচি সীমান্ত এলাকা থেকে মাতামুহুরী নদী আলীকদম, লামা, চকরিয়ার কাকারা-কৈয়ারবিল-বেতুয়াবাজার হয়ে পেকুয়ার উজানটিয়া দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। ১৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী জন্ম থেকে কখনো নদী শাসন বা খনন হয়নি। ২০১৫ সালের ভয়াবহ বন্যায় চকরিয়া উপজেলা প্রশাসনের ১৩ দফা সুপারিশের মধ্যে প্রধান ছিল বান্দরবানের লামার ইয়াংছা থেকে চকরিয়া উপজেলার বাঘগুজারা রাবার ড্যাম পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার এবং বেতুয়া বাজার থেকে পালাকাটা রাবার ড্যাম পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটারসহ মোট ৪০ কিলোমিটার এলাকায় মাতামুহুরী নদীর খনন এবং উভয় তীরে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণসহ নদী শাসনের। ৩৯টি পয়েন্টে নদী ভাঙন ও বেড়িবাঁধ পানি সমপদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জরুরী ভিত্তিতে মেরামত করে দেওয়া ছিল অন্যতম সুপারিশ। এর কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান ওইসময় জানিয়েছিলেন, ২০১৫ সালের ভয়াবহ বন্যার পর উপজেলা প্রশাসনের ১৩ দফা প্রস্তাবনার অন্যতম ছিল মাতামুহুরী নদীর শাসন ব্যবস্থা।

কিন্তু প্রথম প্রস্তাবনাটি আলোর মুখ না দেখলেও ২০১৭ সালের বর্ষার পর একটি দীর্ঘমেয়াদী পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এর আওতায় নদীর সুরাজপুর-মানিকপুর থেকে বাঘগুজারা রাবার ড্যাম পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার নদীর তলদেশ খনন, সেইসাথে দুই তীর টেকসইভাবে যাতে সংরক্ষণ করা যায় সেজন্য একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়। এই কাজের বিপরীতে ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এসব কাজের সমীক্ষা শেষে নদী ড্রেজিংসহ নদীর দুইতীর সংরক্ষণে কিছু কাজও শুরু করা হয়।
নদীর ড্রেজিংসহ দুই তীর সংরক্ষণ প্রকল্প নিয়ে চকরিয়ার সচেতন লোকজন অভিযোগ করেছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বলে দাবি করেছেন তা কোন কাজে আসছে না।
নদীর প্রস্থ বেড়েছে, গভীরতা কমেছে ঃ
১৯৮০-৮৫ সালে মাতামুহুরী নদীর গভীরতা ছিল ৩০-৪০ ফুট। প্রস্ত ছিল ৫০০-৭০০ ফুট। কিন্তু নদীর সাথে সংযোগকারী ঝিরি ও খালগুলি থেকে নির্বিচারে পাথর আহরণের কারণে একদিকে যেমন পানির উৎস হারিয়ে গেছে, অপরদিকে ঝিরির পলিতে ভরাট হচ্ছে নদী। বিগত বছরে ভরাট হয়ে নদীর গভীরতা ১৫-২০ ফুটে চলে এসেছে। দু’পাড় ভেঙে গিয়ে নদীর প্রস্থ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০০-১২০০ ফুটে। সামান্য বৃষ্টিতে পানি ফুলে-ফেঁপে উঠে তলিয়ে যায় তীরবর্তী লামা পৌর শহর ও আলীকদম উপজেলা সদর এলাকা। এই নদীতে বর্তমানে নৌ-যান চলাচল করছে মাত্র ৩-৪ ফুট পানির মধ্যে দিয়ে। কোন কোন অংশে আরও কম।
বর্ষা আসলেই ঠেকানোর কাজ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড ঃ
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সব কাজই হচ্ছে বর্ষা মৌসুমের আগেই। বছরজুড়ে তারা চুপ থাকার পর বর্ষা শুরুর আগেই টনক নড়ে। ফলে এসব অর্থ সরাসরি নদীতে চলে যায়। শুষ্ক মৌসুমে তাদের কোন কাজই বাস্তবায়ন হয় না। পুরো মাতামুহুরী নদীর দুই তীরে সিসি ব্লক দিয়ে তীর সংরক্ষণ করা হলেও ভাঙন রোধ করা হতো। কিন্তু মাত্র কয়েক কিলোমিটারে সিসি ব্লক দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘আসলে বর্ষাকালেই তো আপদ-বিপদ আসে। সেহেতু বর্ষা মৌসুমেই আপদকালীন কাজই করা হয়।’
চকরিয়া উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘প্রতিবছর বর্ষামৌসুমে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় চকরিয়ার মানুষ। বিশেষ করে মাতামুহুরী নদীর ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়ে বসতভিটে হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েন নদীতীরের মানুষগুলো। তাই এসব বিষয়কে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দিয়ে এবং যথাযথ পরিকল্পনা হাতে নিয়ে নদীর ভাঙন ঠেকানো হবে।’এ বিষয়ে কক্সবাজার-১ আসনের এমপি জাফর আলম চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘চকরিয়াকে মাতামুহুরী নদীর ভাঙন থেকে যে কোনভাবেই রক্ষা করতে হবে। সেজন্য যত বড় প্রকল্পই নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে তা-ই নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে এসব বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

পাঠকের মতামত: