ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

চট্টগ্রামে দেড় শতাধিক পোশাক কারখানা বন্ধ

চট্রগ্রাম প্রতিনিধি ::  ইউরোপ-আমেরিকার পোশাক ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় বেড়েই চলেছে বন্ধ পোশাক কারখানার সংখ্যা। গত তিন বছরের ব্যবধানে চট্টগ্রামে ১৫৩টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের কড়াকড়ি ছাড়াও রপ্তানি আদেশের সংকট এবং নানা সমস্যায় চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত ৩৩৫টি পোশাক কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন মালিকপক্ষ। আবার যেসব কারখানা উৎপাদনে আছে, অধিকাংশই অন্য কারখানার কার্যাদেশের ওপর নির্ভরশীল। এসব কারখানা শুধুমাত্র সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।
পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে পোশাক শিল্পের পরিস্থিতি খুবই নাজুক। রপ্তানি আদেশ কমে যাওয়ার পাশাপাশি ক্রেতারা আগের তুলনায় ডজন প্রতি পোশাকের মূল্য কমিয়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে প্রতি বছর বাড়ছে উৎপাদন খরচ। এছাড়া শ্রমিকের মজুরিও আগের চেয়ে বেড়েছে।
অপরদিকে, পোশাক কারখানার কাঁচামাল বিশেষ করে ফেব্রিক্স খালাসে চট্টগ্রাম কাস্টমসে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। বন্ড সুবিধায় আনা ফেব্রিক্সকে মিথ্যা ঘোষণার অভিযোগ দিয়ে রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এতে পরীক্ষাগারে ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রবিশেষে ৭ থেকে ১০ দিন মতো সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। তাই, সঠিক সময়ে ক্রেতাদের কাছে পণ্য পাঠানো সম্ভব হয় না।
অন্যদিকে, তৈরি পোশাক সঠিক সময় জাহাজ ধরতে ব্যর্থ হলে বিমানে পণ্য পাঠাতে হয়। ফলে ব্যবসায়ীদের দ্বিগুণ খরচ বহন করতে হয়। ব্যবসায়ীদের দাবি, পোশাক খাতকে রক্ষা করতে হলে সিঙ্গেল ডিজিটে ব্যাংক ঋণ সুবিধা দিতে হবে। এছাড়া বন্দরে সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন জেটি নির্মাণ ও অফডক বাড়ানোসহ পণ্য পরিবহনে পোশাক খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে ছোট-বড় মিলে ৬৮৬টি পোশাক কারখানার মধ্যে বর্তমানে চালু আছে ৩৫১টি। এর মধ্যে আমদানি-রপ্তানি করছে ২০০টি। বাকি ১৫১ কারখানা সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করছে। এছাড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া ৩৩৫ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স এবং ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান (ন্যাপ) আইএলওর শর্তপূরণ করতে না পারায় বন্ধ হয়েছে ১৫৩টি। বাকি কারখানাগুলো রপ্তানি আদেশের সংকট ও নানা পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
কয়েকজন কারখানা মালিকের দাবি, অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের শর্ত পূরণ করে কারখানাগুলোতে রিমেডিয়েশন প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ছোট ও মাঝারি কারখানাকে ৫ থেকে ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে হয়। এই বিপুল পরিমাণ টাকা অনেকে সংস্থান করতে না পেরে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার অনেকে সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করে কোনোভাবে কারখানা টিকিয়ে রেখেছেন।
এদিকে, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতার অভাবে পণ্য খালাসে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যায়। অনেক সময় ক্রেতাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গিয়ে কারখানা মালিকদের বিমানে পণ্য আমদানি করতে হয়। এতেও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে পোশাক ব্যবসায়ীদের।
জানা গেছে, বর্তমানে তৈরি পোশাকের বিশ্ববাজার ৪৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২১ সালে তা দাঁড়াবে ৬৫০ বিলিয়ন ডলারে। তবে, কারখানা বন্ধ হওয়ার প্রভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পোশাক শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধিও নিম্নমুখী রয়েছে। এছাড়া কারখানা বন্ধের সাথে চট্টগ্রাম থেকে পোশাক রপ্তানি আয় প্রতি বছর হ্রাস পাচ্ছে।
বিজিএমইএর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রাাম শহর এলাকায় জমির দাম অনেক গুণ বেড়ে যাওয়ায় এই অঞ্চলে শিল্প উদ্যোক্তারা চাইলেও আর্থিক কারণে পোশাক কারখানা করতে পারছেন না। ফলে অপরিকল্পিতভাবে কিছু কারখানা গড়ে উঠলেও ক্রেতাদের কঠিন শর্তের কারণে সেইসব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিও পোশাক শিল্প প্রসারে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। নতুন করে কোথাও গ্যাস সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না। এর বাইরে চট্টগ্রাম বন্দর ও বিভিন্ন বেসরকারি অফডেকের অব্যবস্থাপনা ও যন্ত্রপাতির সংকটের কারণে এই খাতের বিনিয়োগকারীদের মাশুল গুণতে হচ্ছে। তবে মীরসরাই ইকোনমিক জোন পোশাক শিল্পের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে।
বিজিএমইএর পরিচালক এএনএম সাইফুদ্দিন বলেন, অনেক পোশাক কারখানা অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সের শর্ত পূরণ করতে পারেনি বলে বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ, ছোটখাটো অনেক পোশাক কারখানার পক্ষে শর্ত পূরণ করাটা সম্ভব না। এছাড়া আমাদের দেশে একটি বিল্ডিংয়ে দেখা গেছে তিন-চারটি কারখানাও ছিল। আবার নিচে মুদির দোকান, উপরে কারখানা। এর মধ্যে অনেক বিল্ডিং ঝুঁকিপূর্ণও ছিল। সেফটি ইস্যুতে আমরা কখনো কারখানাকে সমর্থন করি না।
অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ক্রেতা জোট অ্যালায়েন্স অবশ্য আমাদের এখানে আপাতত কাজ করছে না। তারা মেয়াদ শেষেই চলে গেছে। তবে অ্যাকর্ডের ক্ষেত্রে একটু ঝামেলা রয়ে গেছে। আদালতের ঝামেলা থাকার কারণে তারা এখনো আছে। মূলত অ্যাকর্ডের দাবি, তাদের আরো কাজ বাকি আছে। অন্যদিকে, আমাদের সরকারের দাবি, তাদের আর মেয়াদ বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। এ বিষয়ে আগামী ৭ এপ্রিল আদালতে শুনানি আছে। এরপরই মূলত বোঝা যাবে, তারা আদৌ আমাদের এখানে কাজ করবে কি না।
পোশাক কারখানার বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহ-সভাপতি মোহাম্মদ ফেরদৌস বলেন, চট্টগ্রামের সার্বিক পোশাক কারখানার অবস্থা ভালো নয়। কিছু বড় কারখানা বাদ দিলে ছোটখাট কারখানাগুলোতে অর্ডার নেই বললেই চলে। অনেকে কিছু কিছু সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করে টিকে আছেন। এতে করে কারখানা মালিকেরা খুব চাপে আছেন। চাপ নিতে না পেরেই মূলত কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে পোশাক ক্রেতারা চট্টগ্রামের বেশিরভাগ কারখানার পরিবেশ বিবেচনায় খুব কম মূল্য প্রস্তাব করে। এর মধ্যে শ্রমিকদের অব্যাহত মজুরি বৃদ্ধির কারণে কারখানার পরিচালন ব্যয়ও খুব বেশি। ক্রেতারা দিন দিন অর্ডার প্রাইস কমিয়ে দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, এছাড়া কিছু ক্রেতা আমাদের দেশে আর অর্ডারও প্লেস করতে চান না। অনেক ক্রেতা আমাদের দেশের তুলনায় কম্বোডিয়াতে বেশি অর্ডার দিচ্ছেন। তাদের যুক্তি, আমাদের পণ্য আমেরিকায় পৌঁছাতে সময় লাগে ৩০ দিন। কিন্তু কম্বোডিয়া থেকে সময় লাগে ১৫ দিন। এছাড়া, চীন থেকে কাঁচামাল আসতে আমাদের দেশে সময় লাগে ২০ দিনের মতো। সেটি তাদের ক্ষেত্রে লাগছে ১০-১২ দিন। মূলত লিড টাইম (নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য পৌঁছানো) কম বলেই তারা কম্বোডিয়াকে বেছে নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে আমরা দিন দিন বাজার হারাচ্ছি। পোশাক খাতকে এগিয়ে নিতে হলে আমাদের বন্দরের সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স গঠিত হয়।
অ্যাকর্ড হলো, বিভিন্ন ব্র্যান্ড এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মধ্যে একটি আইনত বাধ্যতামূলক স্বতন্ত্র চুক্তি, যা নিরাপদ এবং সুস্থ বাংলাদেশি তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো একটি কার্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেখানে কোনো শ্রমিক আগুন লাগা, বিল্ডিং ধসে পড়া, বা অন্য কোনো দুর্ঘটনার ভয় পাবে না। উপযুক্ত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
অন্যদিকে, অ্যালায়েন্স শ্রমিক সংগঠন, কারখানার মালিক, এনজিও, সুশীল সমাজ, কারিগরি ও প্রকৌশল পরামর্শদাতা, শিল্প সংস্থা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কারিগরি মানসম্পন্ন এবং টেকসই নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কাজ করে।

পাঠকের মতামত: