ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

ভেজাল খাদ্য থেকে মুক্তি কবে…

খাদ্যে বিষক্রিয়ায় প্রতি বছর নানা রোগে আক্রান্ত ৪৫ লাখ মানুষ ।। অভিযানে জরিমানা হলেও থেমে নেই অপরাধ

নিউজ ডেস্ক ::

টেক্সটাইলের কাপড়ের রং ও ফ্লেভার মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জুস, আইসক্রিম, মিষ্টি, পাউরুটি, বিস্কুট, দই, ললিপপ, চকলেট এবং কেক। এমনকি শিশুখাদ্য গুঁড়ো দুধেও মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান। খাদ্য বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন, হাইড্রোজ, ইথোপেনসহ নানা ক্ষতিকর রং ও রাসায়নিক বিষের সংমিশ্রণ। এছাড়া শাক-সবজি, ফলমূল ও মাছ তরতাজা রাখতে ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। বিভিন্ন সময় খাবারে ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি সংস্থা। অভিযানে ভেজালের দায়ে বিভিন্ন হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং খাবার উৎপাদনকারীকে জরিমানা করা হয়। জরিমানা পরিশোধ করে আবারও সেই পুরনো অবস্থায় ফিরে যান ভেজালকারীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। প্রতি বছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কিডনি বিকল, হার্ট অ্যাটাক, ক্যান্সারসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে ক্ষতিকারক রাসায়নিকযুক্ত খাবারই দায়ী। এছাড়া দেশে খাদ্যে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার কোনো নজির নেই। ফলে তারা শুধু জরিমানার অংক গুণেই ফের একই কাজ করতে থাকে।

বর্তমানে উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত সবখানেই ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়ি। ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন, ভেজাল থেকে কবে মুক্তি মিলবে? বিশেষজ্ঞরা জানান, খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধ হিসেবে প্রতিবেশী দেশ ভারত সরকার যাবজ্জীবন সাজা দিয়ে থাকে। এছাড়া চীনে মৃত্যুদণ্ড, পাকিস্তানে ২৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। আমাদের দেশেও খাদ্যে ভেজাল মেশালে আইন আছে। কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ নেই। এদিকে, বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ-১৯৫৯ (সংশোধিত ২০০৫) মতে, খাদ্যে ভেজাল পাওয়া গেলে সর্বোচ্চ এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

অপরদিকে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯-এ সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। নতুন প্রণীত নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩-এ জরিমানা ও শাস্তির পরিমাণ বাড়িয়ে ৫ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এসবের খুব একটা প্রয়োগ হয় না বললেই চলে। খাদ্যে ভেজাল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মনির উদ্দিন বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খাবারে রং ব্যবহৃত হয়। তবে তারা খাদ্যের সাথে সহনশীল (ফুড গ্রেড) রং ব্যবহার করে। ফুড গ্রেড রং ফুডের (খাবারের) সাথে সরাসরি মিশে যায় না। যে রং ফুডের সাথে সহজে মিশে যায়, বুঝতে হবে সেখানে ভেজাল আছে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, আমাদের দেশে ফুডে টেঙটাইল কালার (কাপড়ের রং) ব্যবহারেরও অভিযোগ পাওয়া যায়। এই ধরনের রং মিশ্রিত খাবার খেলে শরীরে বিভিন্ন স্পর্শকাতার অঙ্গ যেমন কিডনি, লিভার ও গলব্লাডার আক্রান্ত হয়। আবার দেখা যায়, ফুডে হাইড্রোজ ব্যবহার করা হয়; যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

তিনি আরো বলেন, প্রায় শুনি, মুড়িকে অত্যধিক সাদা করার জন্য ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়। এটা খুবই ভয়াবহ। এছাড়া বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্টে একই তেল দিয়ে বারবার রান্না করা হয়। যখন একই তেল দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা তখন তা অঙিডাইজ হয়ে যায়। পোড়া তেলের খাবার শরীরে গেলে ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অপরদিকে, বর্তমানে কলা কিংবা আনারস পাকার কাজে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করা হয়। কার্বাইড শরীরের জন্য অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর হলেও এতে দীর্ঘমেয়াদী নানা সমস্যায় ভোগার সম্ভাবনা থাকে। এমনকি দীর্ঘদিন ধরে প্লাস্টিক বোতলে কিংবা পলি প্যাকে খাবার সংরক্ষণ করা হলে তাতেও খাদ্যে বিষক্রিয়া হতে পারে। কারণ প্লাস্টিক বোতল কিংবা পলি প্যাক কোনোটাই ফুড গ্রেড অনুযায়ী তৈরি হয়নি।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, প্রাথমিকভাবে ভেজাল খাবার খেলে ডায়রিয়া, আমাশয়, পেট ফাঁপা এবং বমি হতে পারে। তবে ভেজাল খাবার দীর্ঘদিন খেলে কিডনি ও লিভার বিকল হয়ে যেতে পারে। এছাড়া আলসার এবং ক্যান্সারে ভুগে একসময় মৃত্যুর দিকে ধাবিত হওয়ারও ঝুঁকি থাকে। নিরাপদ খাবার গ্রহণে সবাইকে সচেতন হতে হবে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, আমাদের দেশে প্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল সংস্থা ভেজালের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু দেখা যায়, প্রশাসন প্রায় সময় জরিমানা দিয়েই দায় সারে। কিন্তু আমরা বারবার বলে আসছি, জরিমানার পরিবর্তে যদি অপরাধীদের জেল দেওয়া যায়, তাহলে অপরাধের প্রবণতা কমত। আবার দেখা যায়, প্রশাসন জরিমানা দেওয়ার পরে তিন মাস আর ওই প্রতিষ্ঠানের আশপাশে যায় না। ফলে ওই অপরাধী একই ধরনের কাজ অব্যাহত রাখে। যদি জরিমানা করার পরের মাসে একটি ফলোআপ চালানো যায়, তাহলে ওই ব্যবসায়ী কিংবা মালিক ভয়ে থাকবে।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বলেন, ভেজালের বিরুদ্ধে পুরো বছরই আমাদের অভিযান চলে। অভিযানের কারণে ভেজাল খাবারের পরিমাণ আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। তবে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলা যাবে না। তবে খাদ্য ভেজালকারীদের আমরা ছাড় দেব না।

পাঠকের মতামত: