ঢাকা,মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের ১৯ কোটি টাকা লুট, সত্যতা পেল দুদক টিম শীঘ্রই চার্জশিট

কক্সবাজার প্রতিনিধি ::  কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের নামে ভুয়া ব্যাংক একাউন্ট দেখিয়ে ১৭ কোটি টাকা লুট ও ভুয়া বিল ভাউচার বানিয়ে আরো ২ কোটি আত্মসাতের ঘটনায় দুদকের দায়ের করা ৮ মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে শীঘ্রই অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত দুইদিন কক্সবাজারে মামলার তিনজন তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তকাজ শেষে গতকাল মঙ্গলবার বিকালে সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান।

কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল ও জেলা ট্রেজারার অফিসের চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রায় ১৯ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৮ সালে পৃথক ৮টি মামলা দায়ের করে দুদক। ২০১২ সাল থেকে অভিযোগের তদন্ত শুরু হওয়ার পর গেল বছরের শেষ দিকে তদন্ত শেষে দুদকের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক হুমায়ুন আহম্মদ বাদী হয়ে এসব মামলা করেন।
মামলার আসামিরা হলেন- ইফতেখার উদ্দিন (তৎকালীন প্রধান সহকারী, চকরিয়া), আবদু সবুর (তৎকালীন ট্রেজারার সুপার), আবদুস সামাদ (প্রয়াত প্রধান সহকারী) ও তৎকালীন জেলা ট্র্রেজারার নাছির উদ্দিন মো. আবু সুফিয়ান। অভিযুক্তরা চাকুরী কালীন কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল ও নার্সিং ইনস্টিটিউট নিয়ে পৃথক বিল ভাউচার বানিয়ে ও ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেন।
দায়েরকৃত ৮ মামলার তদন্ত করছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের তিনজন কর্মকর্তা। এরমধ্যে একজন উপ-পরিচালকের নেতৃত্বে আরো দুইজন সহকারী পরিচালক মামলা তদন্তের জন্য সোমবার সকালে কক্সবাজারে আসেন। এরপর তারা গত দুইদিনে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল, জেলা ট্রেজারারের অফিস ও ব্যাংক থেকে কিছু নথিসংগ্রহ করেন। মঙ্গলবার বিকালে তারা তদন্ত শেষে ফিরে যাওয়ার সময় অভিযোগের সত্যতা পেয়ে এসব মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে খুব শীঘ্রই চার্জশিট দেয়া হবে বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তারা।
দুদক চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ-পরিচালক মাহবুবুল আলম বলেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে দায়েরকৃত মামলার তদন্ত করতে দুদকের একটি টিম হাসপাতাল, ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এই দলে দুদক চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ-পরিচালক মো. রিয়াদসহ তদন্ত দলের অন্য কর্মকর্তারাও রয়েছেন।
জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা: সোলতান আহম্মদ সিরাজী জানান, দুদকের তদন্ত দল হাসপাতালে এসে কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেয়েছিল। তা সরবরাহ করা হয়েছে।
যেভাবে বেরিয়ে আসে আসল ঘটনা!
২০১২ সালে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের তৎকালীন ট্রেজারার ও প্রধান সহকারী আবদুস সামাদ আকস্মিকভাবে মারা গেলে বেকায়দায় পড়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ওই সময় তার অফিস বিভিন্ন ড্রয়ারের তালা ভেঙ্গে নথিপত্র উদ্ধার করতে গিয়ে পাওয়া যায় নগদ প্রায় এক কোটি টাকা এবং ১৭ ভরি স্বর্ণালংকার। উদ্ধার টিমে ছিলেন ডা.রফিক, অফিস সহকারী রেজাউল করিম সহ কয়েক জন টিম সদস্য। পরে উদ্ধারকৃত নগদ টাকা ও মালামাল দুদকে জমা দেয়া হয়।
আবদু সামাদ (তৎকালীন প্রধান সহকারী) ২০১২ সালের মৃত্যুর আগে চট্টগ্রামের রিয়াজ উদ্দিন বাজার গোলাম রসুল মাকের্টে কোটি টাকার শপিং মল, জেলা সদর হাসপাতালের পাশে (জেলা সদর হাসপাতালের প্রস্তাবিত নাসিং ইনস্টিটিউিট এর জায়গা) দ্বিতল ভবনসহ স্বনামে বেনামে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হন। ওইসময়ে আবদু সামাদ ছাড়াও হাসপাতালের অনেক কর্মকর্তা দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন।
হাসপাতালের দুর্নীতি সংক্রান্ত ইনভেন্ট্রি কমিটির প্রতিবেদন সুত্রে জানা যায়, সোনালী ব্যাংকের কক্সবাজার শাখায় ‘ডা. এবিএম মোস্তফা, হাসপাতাল সুপারিনটেন্ডেন্ট’ নামে একটি চলতি হিসাব (নং- ০৯০৩৩৩০১৮৩৮৭) বিগত ১৯৯৪ সালের ৯ মে থেকে চালু রয়েছে। অথচ এ নামে জেলা সদর হাসপাতালে এ যাবতকালে কোন তত্ত্বাবধায়ক কিংবা সাধারণ চিকিৎসকও ছিলনা। মূলত হাসপাতালের টাকা লুটপাটের জন্য এই ভুয়া একাউন্ট করা হয়েছিল।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, ২০১১-১২ সালের হাসপাতালের আর্থিক প্রতিবেদনে শুধুমাত্র ৪৬০১ কোডে খরচ দেখানো হয় ৯৬ লাখ ৩২ হাজার ১৩৭ টাকা। কিন্তু হিসাব রক্ষণ কার্যালয় প্রদত্ত প্রতিবেদনে সেই কোডে উত্তোলিত টাকার পরিমাণ ২ কোটি ৫ হাজার ১১৫ টাকা। একইভাবে নার্সিং ইনষ্টিটিউটের ক্ষেত্রে ১৮ লাখ ৫২ হাজার ৬৩২ টাকা খরচের স্থলে ২৬ লাখ ১২ হাজার ৯২৭ টাকা উত্তোলন করা হয়। হাসপাতালে এরকম আরো ৩০ এর অধিক কোড রয়েছে। যার প্রত্যেকটিতে অনেক আর্থিক অসঙ্গতি রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, হাসপাতালের তৎকালীন প্রধান সহকারী কাম হিসাব রক্ষক মোঃ আবদুল সামাদ (প্রয়াত) চাকরীর মেয়াদ পূর্তির পরেও প্রায় দেড় বছর স্বপদে বহাল ছিলেন। আত্নরক্ষার্থে সরকারী বিধি লঙ্ঘন করে তাকে এ পদে বহাল রাখেন তৎকালীন কর্মকর্তারা। তবে মামলায় উর্ধতন কাউকে অভিযুক্ত করা হয়নি।
ইনভেন্ট্রি কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, তৎকালীন প্রধান সহকারী কাম হিসাব রক্ষক মোঃ আবদুস সামাদের মৃত্যুর পর তার ব্যবহৃত ২টি রুম থেকে মালিকবিহীনভাবে ৬৩ লাখ ৭৩ হাজার ২৭৫ টাকা উদ্ধার করা হয়েছিল। এসব অর্থ হাসপাতালের নামের ভুয়া ওই ব্যাংক একাউন্টে (চলতি হিসাব নং- ০৯০৩৩৩০১৮৩৮৭) জমা রাখা হয়। একইভাবে আরো বিভিন্ন নামে তদন্ত করতে গিয়ে জুলাই’২০০৬ থেকে জুন’২০১২ পর্যন্ত ২৯ কোটি টাকা আর্থিক অনিয়মের প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পায় বলে দাবি করেছিল সংশ্লিষ্ট তদন্ত টিম।
হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ডা. আজয় ঘোষ ২০১২ সালের ৪ আগস্ট সুপার/ককস/হাসপাতাল/প্রশাঃ/২০১২/১৭৫৮ নং স্মারকমূলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর হাসপাতালের প্রশাসনিক অনিয়ম ও তহবিল তছরূপের বিষয়ে জরুরি ভিক্তিতে তদন্তের আবেদন করেন। এরই ভিক্তিতে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (অর্থ) ডা. সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল ঘটনার তদন্ত করেন। পরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে আরেকটি দল বিষয়টি সরেজমিন তদন্ত করে যান। ২০১৩ সালের আগস্টেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (অর্থ) ডা. সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে আরেকটি তদন্ত দল ৩ দিন ধরে পুনরায় তদন্ত করেন।

পাঠকের মতামত: