ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

ক্যান্সার আক্রান্ত মৃত্যুর পথযাত্রী মেধাবী শিক্ষার্থী আফরিন জান্নাত সুন্দর পৃথিবী বাঁচতে চান

এম.জিয়াবুল হক, চকরিয়া ::

দূরন্তপনার এই বয়সে সবার সঙ্গে হেসে খেলেই বেড়ানোর সময় তাঁর। হাসতে হাসতে দুষ্টমির চলে প্রতিদিন সহপাঠীদের সঙ্গে নিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার কথা ছিল তাঁর। একসঙ্গে যাবে বিপনী বিতানে পছন্দের নতুন কাপড়টি কিনতে। খুনসুটি আরো কী। কিন্তু না, মরণব্যাধি ক্যান্সার তার শরীরে বাসা বেঁধেছে। বিদ্যালয়ে যাওয়া তো দুরের কথা, গেল একবছর ধরে বিছানায় শুয়ে বসে সময় কাটছে তাঁর। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে তার শরীর। গল্পটা আফরিন জান্নাত (১৪) নামের এক মেধাবী শিক্ষার্থীর। কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বিএমচর ইউনিয়নের দক্ষিণ বহদ্দারকাটা এলাকার দিনমুজুর মোহাম্মদ শফির মেয়ে। ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় আফরিন জিপিএ ৪ দশমিক ৬০ পেয়েছে। ২০১৮ সালে নবম শ্রেণিতে মানবিক বিভাগে ভর্তি হলেও ফেব্রুয়ারি থেকে আর ক্লাসে যেতে পারেনি অধম্য এ মেধাবী।

মেধাবী শিক্ষার্থী আফরিনের চিকিৎসা ব্যয় চালাতে গিয়ে এলোমেলো হয়ে গেছে পরিবারের অন্যদের জীবনও। অন্যদশ শিক্ষার্থীর মতো জীবনের স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা করে একদিন বড় ডাক্তার হবে। সমাজ ও দেশের মানুষের সেবা করবে। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন মাঝপথে আটকে আছে দরিদ্র বাবার পলিথিন ঢাকা ভাঙা ঘরের মাটির বিছানায়। হাঁটুতে ধরা পড়েছে ব্রোন ক্যান্সার।

সরেজমিনে দেখাগেছে, হতদরিদ্র মোহাম্মদ শফি চার মেয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন একটি ভাঙা ঝুপড়ি বাড়িতে। ঘরের চালা ভেঙে যাওয়ায় পলিথিন দিয়ে ঢেকে কোনরকম রোদ বৃষ্টি থেকে রক্ষা করে চালিয়ে যাচ্ছেন তার জীবন সংসার। ঘরের ভিতরে গিয়ে দেখা যায়, ঘরে কোন আসবাবপত্র নেই। মাটি দিয়ে বানিয়েছেন থাকার বিছানা। এখন এ মাটির বিছানায় শুয়ে বসেই নীরবে চোখের জ্বল ফেলে কাটছে মেধাবী ছাত্রী স্বপ্নকাতর আফরিনের জীবন। কখনো কখনো ব্যথার যন্ত্রণা সইতে না পেরে চিৎকার করে আহাজারি করেন। কখনো নিরবে চোখের পানি ফেলেন। মা রেনুআরা বেগম আর ছোটবোন আশরাফুল জন্নাত সবসময় থাকেন তার পাশেই।

মোহাম্মদ শফি ও রেনোয়ারা বেগম দম্পতির বড় ছেলে তারেক আজিজ কাজ নিয়েছেন তরকারির আড়তে। মেঝ ছেলে পোশাক কারখানায়। বড় মেয়ে জন্নাতুল নাইম এইচএসসি পরীক্ষার্থী থাকা অবস্থায় একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কাজ নিয়েছেন। মেঝ মেয়ে জন্নাতুল বকেয়া পেকুয়া শহীদ জিয়াউর রহমান উপকূলীয় কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনিও এখন টিউশনী করেন। আফরিনের ছোট বোন আশরাফা জান্নাত বহদ্দারকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। আফরিনের চিকিৎসা খরচ চালাতে ও পরিবারের ঘ্লানি টানতে গিয়ে এখন পরিবারের অন্যদের পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

আফরিনের বাবা মোহাম্মদ শফি জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত আফরিনের চিকিৎসায় সাত লাখ ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ১০ শতকের এক খন্ড জমি ছিল, তাও তিন লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন আর চিকিৎসার ব্যয় মেঠাতে পারছেন না তিনি।

মেধাবী আফরিন বলেন, ২০১৭ সালে জেএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সময় বাম পায়ে প্রথম ব্যাথা অনুভুত হয়। ধীরে ধীরে ব্যাথা বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালের ফ্রেব্রুয়ারি থেকে অন্যের সাহায্য ছাড়া হাটাচলা বন্ধ হয়ে যায়। এখন বিছানা থেকে উঠতে পারে না। বাম পায়ের হাটু পুরো ফুলে গেছে। তীব্র ব্যাথা, ইচ্ছে হয় মরে যাই। মরে গেলেই তো সব শেষ!

দু’মিনিট পরেই আফরিন বলে ‘আমি বাঁচতে চাই। পৃথিবীতে এতো মানুষ থাকতে আমি মারা যাবো!’ এ কথা বলেই আফরিন অশ্রুভেজা চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে অন্য মনস্ক হয়ে পড়ে। বিছানায় তার পাশে সাধারণ জ্ঞানের একটি বই আছে। সে বইটি হতে তুলে নিয়ে আবার কথা শুরু হয় তার, ‘এ বইয়ের সব আমার মুখস্থ। আমি জেএসসিতে জিপিএ-৫ পেতাম। কিন্তু হাঁটুর ব্যাথায় ভালো করে পড়তে পারিনি। আচ্ছা, আমি কি বাঁচবো! যদি বেঁচে থাকি তাহলে আমি দেশের সেবা করতে করবো। সব ক্যান্সার রোগীর জন্য কাজ করবো। তাঁদের পাশে থাকবো।’ আদৌ তার এ স্বপ্ন পূরণ হবে! নাকি স্বপ্নের মৃত্যু ঘটবে-এখন সেটাই বড় প্রশ্ন।

আফরিনের বাবা বলেন, ১২-১৫ দিন পর চার ব্যাগ করে রক্ত দিতে হয়। প্রতিবার রক্ত দেওয়ার পর কেমোথেরাপি দিতে হয়। রক্ত ও কেমোথেরাপি চকরিয়ার কোথাও দেয়া যায় না। এটার জন্য চট্টগ্রাম চলে যেতে হয়। আফরিন সোজা হয়ে বসতে পারে না। তাকে কোথাও নিতে হলে গাড়ি রিজার্ভ করতে হয়। তার চিকিৎসার খরচ বহন করতে গিয়ে আমি এখন নি:স্ব। মাথা গোজার জায়গাটি ছাড়া আমার আর কিছু নেই।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ এম এ আউয়াল আফরিনের শরীরে বুন ক্যান্সার শনাক্ত করেন। এমএ আউয়াল বলেন, ‘ভালো চিকিৎসা পেলে আফরিন ভালো হবে। তাকে ঢাকা বা ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

বহদ্দারকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জিনাত সোলতানা বলেন, আফরিন আমাদের বিদ্যালয়ের খুব মেধাবী ছাত্রী। জেএসসির পরে সে শারিরীকভাবে অসুস্থ হয়ে গেলে সবাই তাকে পরামর্শ দিয়ে মানবিক বিভাগে ভর্তি করায়। কিন্তু সে আর ক্লাস চালিয়ে নিতে পারেনি। এখন তার জন্য খুব খারাপ লাগছে। কয়েকবার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মিলে আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছে। কিন্তু ব্যয়বহুল খরচে তা খুব অপ্রতুল।

এলাকাবাসি ও পরিবারের আবেদন, দেশের প্রত্যেক বিত্তবান ও দয়ালু নাগরিকরা চাইলে ক্যান্সার আক্রান্ত মেধাবী শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়াতে পারে। একটুখানি সহযোগিতার হাত বাড়ালে মেধাবী শিক্ষার্থী আফরিনকে সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচানো সম্ভব হবে। তাকে সাহায্য করতে চাইলে যে কেউ তাঁর বাবা মোহাম্মদ শফির নামে চকরিয়া উপজেলার রূপালী ব্যাংক চিরিঙ্গা শাখার (হিসাব নম্বর-১৩৭০০১০৯১০৩১১) নাম্বারে দিতে পারবে। #

পাঠকের মতামত: