ঢাকা,বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

মাষ্টারি না করেও তিনি মোস্তাফিজ মাষ্টার

রিপোর্টারের ডায়েরি

12805990_1351029054922696_5505726695802391946_n– তোফায়েল আহমদ
নিজের সহধর্মীনী ছালেহা খানম ছিলেন জাতীয় সংসদের সদস্য এবং নিজের জেষ্ট পুত্র লুৎফুর রহমান কাজলও ছিলেন সংসদ সদস্য। একটি প্রতিষ্টিত রাজনৈতিক পরিবার বললেও ভুল হবে না। তবুও লোকটি বরাবরই রাজনীতি বিমুখ ছিলেন। রাজনীতি তাকে কোনদিনও টানেনি। কেবল ব্যবসার প্রতি ছিল তার অদম্য টান। কিভাবে একটি কচু গাছে ১০ টি লতি বের করা যায়-সেই লতি বিক্রিতে আয় করা যায় ৫ টাকা। কত দ্রুত চিংড়ি এবং তেলাপিয়া বর্ধন করা যায়। ঈদগড়ের পাহাড়ী বাগানটির গাছগুলোর সাইজ কিভাবে বাড়ানো যেতে পারে। লবণ মাঠের উৎপাদনইবা কিভাবে বাড়ানো সম্ভব- কেবল এসব চিন্তায় তিনি কিলবিল করতেন। তিনি মোস্তাফিজুর রহমান। একনামে পরিচিত মোস্তাফিজ মাষ্টার। আবার আরো মোস্তাফিজ মাষ্টার থাকায় তিনি ছিলেন নিরিবিলির মোস্তাফিজ মাষ্টার। বেশ কিছুকাল ধরে রোগে ভুগছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত গতকাল মঙ্গলবার (০৮ মার্চ ২০১৬) সকালে ঢাকায় একটি হাসপাতালে পরপারে পাড়ি জমালেন কক্সবাজারের এই সফল ব্যবসায়ী এবং নিরব দানশীল ব্যক্তিটি।
বলা যায় মাষ্টারি ছাড়াই তিনি পরিচয় পেয়েছিলেন মাষ্টার মোস্তাফিজ মিয়া হিসাবে। এক অসাধারণ মেধাবী লোক ছিলেন তিনি। সাংবাদিকতার হাতেখড়ি থেকে শুরু করে তাঁর সাথে সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছে অগণিত সংখ্যক। কোন বিরক্তি নেই। তবে রাজনীতির কথা ছাড়া হতে হবে শিল্প এবং ব্যবসার কথা। জীবনে বহুবার তিনি টাকা রোজগারের পথ দেখিয়েছিলেন। দীর্ঘমেয়াদী যেমনি তেমনি স্বল্প মেয়াদী আয়ের পথও তার দেখানো ছিল। কিন্তু কি জানি টাকা আয়ের প্রতি এমন এক ভীতি কাজ করেছে যে-সেই পথেই পা বাড়ানো হয়নি। কিন্তু তিনি যেন নাছোড় বান্দা। এই শিল্পপতির বড়ই ইচ্ছা ছিল-আমাকে যেন কিছু টাকার মালিক করে দিয়ে যান। অগাধ বিশ্বাস ছিল আমার প্রতি। এমনকি শেষ পর্যন্ত একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় কলাতলির নিজের শিল্প কারখানার শতকোটি টাকা মূল্যের জমি বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে তিনি আমার মোবাইল নম্বর পর্যন্ত ব্যবহার করেছিলেন।
বলেছিলেন-‘তুমি আমার উছিলায় নিরবে যদি কিছু একটা করার মত রোজগার করতে পার তাহলে আমি খুশি হব।’ মোস্তাফিজ মাষ্টারের মৃত্যুর পর বুঝছি আসলে তিনি আমাকে নিরবে সাহায্য করে যেতে চেয়েছিলেন। এ রকম নিরব সহযোগিতা তিনি নিশ্চয়ই আরো দিয়ে গেছেন। হয়তোবা অজানা রয়ে গেছে। কক্সবাজারের হোটেল ব্যবসার পাইওনিয়ার ছিলেন মোস্তাফিজ মাষ্টার। তেমনি লবণ মাঠ আর লবণ ব্যবসা, চিংড়ি ও তেলাপিয়া চাষ- বলতে গেলে কৃষিজ পাইওনিয়ার ছিলেন তিনি। কক্সবাজারে শিল্প-কারখানারই একজন ¯্রষ্টা। কক্সবাজার সদরের পোকখালী ইউনিয়নের গোমাতলী (গোয়াখালী) গ্রামের এই মেধাবী সন্তান সেকালে মেডিকেল কলেজে ভর্ত্তি হয়েছিলেন। কিন্তু এম,বি,বিএস পাস করার মাত্র ২ বছর আগেই গাট্টি-বোচকা নিয়ে কলেজ ছেড়ে আসেন গ্রামে। এরকম মেডিকেল কলেজ ত্যাগি আরো একজন লোক ছিলেন টেকনাফের হ্নীলায়। অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। তিনি মরহুম ডাক্তার শফিকুর রহমান (ডাঃ শফিক)। ডাক্তারি পড়া শেষ না করলেও তিনি ডাঃ হিসাবে পরিচিতি ছিলেন।
মেডিকেলে পড়া সত্বেও মোস্তাফিজুর রহমান নামের আগে ডাক্তার নামে পরিচিতি পান নি। গেল বছর এ প্রসঙ্গটি নিয়ে আমি তার সাথে আলাপ করেছিলাম। আলাপে চমৎকার রসালো লোক ছিলেন তিনি। বললেন, মেডিকেল থেকে আমার যাত্রা সোজা লবণ মাঠ। সেই লবণ মাঠে গিয়ে বেচা কেনায় জড়িয়ে পড়লাম। মণপ্রতি দশ পয়সার ব্যবসা। লবণ মাঠে একাজটি ‘নুনের দালালি’ হিসাবে পরিচিত। আমার মত লেখাপড়া জানা লোকের অভাব ছিল তখন। হিসাব-নিকাস করতে লোকজন ছুটে আসতে শুরু করে আমার কাছে। তবে ভাগ্যিস লবণের দালালি করলেও লোকজন আমাকে ‘দালাল’ না ডেকে ‘মাস্টার সাব’ হিসাবেই ডাকা শুরু করে। স্কুলে মাষ্টারি না করলেও সেই লবণ মাঠের মাষ্টার নামটিই সারাজীবন বহন করে চলেছি-বলেন নিরব দানশীল এই ব্যক্তিটি।
রাজধানী ঢাকার একজন প্রবীণ সাংবাদিক কিছুদিন আগে জানতে চেয়েছিলেন-হোটেল নিরিবিলি আবাসিক এবং খাবার হোটেলের কথা। তাকে বলেছিলাম-কক্সবাজারের এই পাইওনিয়ার ব্যবসায়ীর অবদানের কথা। কক্সবাজারে পর্যটন বিকাশের জন্য তিনি অনেকগুলো সুপারিশ মালা রেখে গেছেন। অসাধারণ এই মেধাবী লোকটি কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ সড়ক রক্ষার ব্যাপারেও বেশ কিছু সুপারিশ রেখে গেছেন। যখনই তার সামনে পড়তাম তখনই বসাতেন। বলতেন-তোমার নোট বই খুলে একটু নোট কর। একদিন কাজে আসবে আমার কথা। তোমার লেখায় যোগান দেবে আমার কথা। দেশ ও দশের জন্য বলা সবই। ভারুয়াখালীর কলিমুল্লাহ এবং মহেশখালী ফিশারীজের শুক্কুর সাহেব সহ আমাকে যদি পেয়েই যান-তাহলে একটি অনুরোধ যাতে উনার কথা শুনতে হবে এবং নোট করতে হবে।
Tofayel-Ahmad-01_1জীবনের উত্থান-পতন নিয়ে সাংঘাতিক রকমের বিশ্বাসী লোক ছিলেন তিনি। জেনারেল এরশাদের সময় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত মোস্তাফিজ সাহেবকে তার তারাবনিয়া ছড়ার এক কানি জমির বাড়ী-ভিটিটি পর্যন্ত দুবাই বুড়ির কাছে বিক্রি করতে হয়েছিল। এমন পতনেও ভেঙ্গে পড়েননি তিনি। কলাতলিতে অনাবাদি জমি কিনে সেখানেই কলা ,কদু , কচু চাষ এবং দুধের গরু নিয়ে শুরু করলেন নতুন সংগ্রাম। এরপর শুরু করলেন চিংড়ি চাষ, চিংড়ি পোণা উৎপাদন এবং সর্বশেষ তেলাপিয়ার চাষ ও তেলাপিয়ার পোণার হ্যাচারি নিয়ে মাতামাতি। বলতে গেলে চিংড়ির অগ্রযাত্রায় এমন লোকটির অবদান কোন ভাবেই ছোট করা যাবে না। সেই যাত্রায় আবার উঠে গেলেন। তিনি বলতেন না নিজের পরিবারের কথা। বলতেন কেবল ব্যবসা কিভাবে প্রসার করা যায়। পোলট্রি ফার্ম কিভাবে গড়া যায়। পর্যটন কিভাবে প্রসারিত হবে। দেশী-বিদেশী পর্যটককে কিভাবে আকৃষ্ট করা হবে। একজন পর্যটককে কত কম টাকায় এক বেলা খাওয়ানোর সুযোগ করে দেয়া যায়। আহারে-দেশ ও সমাজ গড়ার এমন চিন্তার লোকগুলোইতো একে একে হারিয়ে যাচ্ছেন। কোথায় পাব এরকম আরেকজন মোস্তাফিজ মাষ্টারকে। হে আল্লাহ-তুমি উনাকে শান্তিতে রাখুন-আমিন। লেখক-তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজারের বিশিষ্ট সাংবাদিক।

পাঠকের মতামত: