ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি চিহ্নিত করে দুদকের ২৫ সুপারিশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২৩ জন বদলি

অনলাইন ডেস্ক ::

সারা দেশে স্বাস্থ্য খাতে অনুসন্ধান চালিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্নীতির ১১টি উৎস চিহ্নিত করেছে। সংস্থাটির ‘প্রাতিষ্ঠানিক টিমের’ এই অনুসন্ধান শেষে স্বাস্থ্য খাত থেকে দুর্নীতি নির্মূলে ২৫ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলো প্রতিবেদন আকারে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান সচিবালয়ে গিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের কাছে এ প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন।

এদিকে দুদকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া আট জেলার ৯টি হাসপাতালে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয় আটটি তদন্ত কমিটিও করেছে।

স্বাস্থ্য খাতে দুদকের অনুসন্ধানে সমন্বয়ক ছিলেন কমিশনের উপপরিচালক মির্জা জাহিদুল ইসলাম। আর অনুসন্ধান চালান সদ্য অবসর নেওয়া পরিচালক মো. জাহেদ হোসেন খান ও সহকারী পরিচালক মো. সালাউদ্দিন আহম্মেদ।

দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যেসব খাতে দুর্নীতির সুযোগ রয়েছে এমন ১১টি খাত আমরা ধরতে পেরেছি। এসব জায়গা থেকে কিভাবে দুর্নীতি নির্মূল হবে তার জন্য ২৫টি সুপারিশ আজ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দিয়েছি। আমরা মনে করি, তারা যদি এ বিষয়ে আরো যত্নবান হয়, তাহলে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব।’ তিনি বলেন, সরকার এখন ‘দুর্নীতিকে না বলুন’ নীতিতে চলছে। দুদকও একই নীতির সঙ্গে কাজ করে।

সূত্র জানায়, দুদকের চিহ্নিত করা দুর্নীতির উৎস সম্পর্কে বলা হয়েছে—স্বাস্থ্য খাতের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিসহ বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতি ও অনিয়ম চলছে। চিকিৎসকরা সাধারণত প্রত্যন্ত এলাকায় থাকতে চান না। বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকের কর্মচারীরা একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন কর্মরত থাকার কারণে স্থানীয় দালালদের সমন্বয়ে সংঘবদ্ধ চক্রে পরিণত হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ক্রয় কমিটিতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নিরপেক্ষ ও দক্ষ কর্মকর্তা সংযুক্ত না থাকায় অতি সহজেই সরকারি টাকা আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ক্রয় কমিটির কর্মকাণ্ডে সরকারের যথাযথ নজরদারি না থাকায় ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অন্যান্য পণ্য ক্রয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে।

উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য দক্ষ জনবল নিয়োগ না দিয়েই যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। কোথাও কোথাও যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও মেরামত দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে তা করা হয় না। দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে সংঘবদ্ধ দালালচক্র সক্রিয় থাকে। তাদের কাজই হলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা অসহায় গরিব রোগীদের প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। নজরদারি না থাকায় হাসপাতালগুলোতে রোগীরা পাচ্ছে না সরকার নির্ধারিত ওষুধ। ওই সব ওষুধ কালোবাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। স্থানীয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেট জেলা সিভিল সার্জনের সহযোগিতায় নামসর্বস্ব ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালু করে রমরমা ব্যবসা করে। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে মেধা যাচাই না করে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করানো হচ্ছে।

নিম্নমানের এবং অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে অহরহ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রকিউরমেন্ট-সিএমএসডিতে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার মাধ্যমে লুটপাট চলছে। বাংলাদেশের কিছু ওষুধ কম্পানি অথবা নকল ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের ও নকল ওষুধ সরবরাহ করছে। বিক্রয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে চিকিৎসকদের বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে এসব ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লেখা হচ্ছে।

সুপারিশমালা

দুদকের সুপারিশমালায় বলা হয়েছে, প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে সিটিজেন চার্টার প্রদর্শনের বিধান নিশ্চিত করা এবং প্রতিদিন হাসপাতলে কী কী ওষুধ রাখা হচ্ছে তা প্রদর্শন করা। ওষুধ ও মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট ক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রয় কমিটিতে বিশেষজ্ঞ রাখা যেতে পারে। দরপত্র আহ্বান এবং পিপিআরের মাধ্যমে অবশ্যই কেনাকাটা করতে হবে। প্রতিটি হাসপাতালে সরকারি ওষুধের তালিকা এবং পরীক্ষার মূল্যতালিকা জনসমক্ষে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা, স্টক রেজিস্টার ও ই-রেজিস্টারের ব্যবস্থা, দালালদের উৎপাত বন্ধে ভিজিল্যান্স টিম বা মনিটরিং টিম গঠন করাসহ সিসিটিভির মাধ্যমে তদারকি জোরদার করে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসা, অনুমোদনবিহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে সার্ভিল্যান্স টিম গঠন করা এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। ওই সব হাসপাতালে সরকারি কর্মচারীরা জড়িত আছেন কি না চিহ্নিত করা ও ব্যবস্থা নেওয়া।

স্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষার কার্যক্রম জেলা-উপজেলায় নির্বাহী দপ্তরকে অবহিত করা এবং বিল ভাউচারে সিভিল সার্জনসহ দুজন কর্মকর্তার তদারকি করা। চিকিৎসাসেবার মানোন্নয়নের জন্য চিকিৎসকদের একটি সুনির্দিষ্ট বদলি নীতিমালা থাকা। তিন বছরের বেশি হলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বদলি কার্যকর হবে এবং প্রত্যন্ত জেলায় বদলির ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সরকারি হাসপাতালের রাজস্ব আদায় কার্যক্রমকে অটোমেশনের আওতায় এনে রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান নিশ্চিত করা, ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সময় চিকিৎসা ফি নেওয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করা। বিভিন্ন ওষুধ কম্পানির প্রতিনিধির মাধ্যমে উপঢৌকন নিয়ে অসাধু চিকিৎকদের প্রাইভেট রোগী দেখার সময় ব্যবস্থাপত্রে নিম্নমানের ওষুধ লেখা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।

বিভিন্ন দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে প্রতি ইউনিয়নে স্বাস্থ্য মেলার আয়োজনের করা, নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্য বীমা চালু করা এবং বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্তকরণ ও প্রশাসনিক সুবিধার্থে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ভেঙে স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর নামে পৃথক দুটি অধিদপ্তর করা, চিকিৎসা শিক্ষার মানোন্নয়ন বিশেষ করে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, নার্সিং কলেজ, প্যারামেডিক ইনস্টিটিউটগুলোর মানোন্নয়ন করা; একজন নির্দিষ্ট ডাক্তার দৈনিক কতজন রোগী দেখবেন এবং তাঁর ফি কত হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা।

সুপারিশে আরো বলা হয়েছে, চিকিৎসকদের পদোন্নতির জন্য পিএসসি ও মহাপরিচালক (স্বাস্থ্য) এবং পিএসসির প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে সুপারিশ প্রদান করা যেতে পারে, চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের নাম না লিখে জেনেরিক নাম লেখা বাধ্যতামূলক করা, ইন্টার্নশিপ এক বছর থেকে বাড়িয়ে দুই বছর করা এবং বর্ধিত এক বছর উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে থাকা বাধ্যতামূলক করা; উপজেলা পর্যায়ে কাজ না করলে উচ্চশিক্ষার অনুমতি না দেওয়া এবং সব হাসপাতালে জরুরি হটলাইন, পরামর্শ ও অভিযোগকেন্দ্র এবং যোগাযোগের সার্বক্ষণিক ব্যবস্থা রাখা।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক হাসপাতাল/স্বাস্থ্যকেন্দ্র/সিভিল সার্জন অফিস পরিদর্শনকালে সরকারি বরাদ্দবহির্ভূত আপ্যায়ন প্রথা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা। চিকিৎসকদের জন্য প্রতি তিন মাস অন্তর নৈতিকতাভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা, বাংলাদেশে বর্তমানে বিরাজমান ওষুধ উৎপাদন, বিতরণ ও বিক্রয় ব্যবস্থাপনার পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কার্যকর নজরদারির লক্ষ্যে এবং ভবিষ্যতে ওষুধের মান বজায় রাখার জন্য ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের একই সঙ্গে একাধিক উৎস থেকে কাঁচামাল দ্বারা ওষুধ উৎপাদন নিষেধ করা।

২৩ কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলি

দুদকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী ফয়জুর রহমানকে সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, প্রধান সহকারী মাহফুজুল হককে নেত্রকোনা সিভিল সার্জন কার্যালয়, কম্পিউটার অপারেটর আজমল খানকে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ, ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমানকে রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়, প্রধান সহকারী-কাম হিসাবরক্ষক আব্দুল কুদ্দুসকে ভোলার চরফ্যাশন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সিলেটের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের প্রধান সহকারী নুরুল হককে জামালপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়, প্রশাসনিক কর্মকর্তা গৌস আহমেদকে সিরাজগঞ্জ সিভিল সার্জন কার্যালয়, উচ্চমান সহকারী আমান আহমেদকে কুড়িগ্রামের চিলমারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও অফিস সহকারী-কাম কম্পিউটার অপারেটর নেছার আহমেদ চৌধুরীকে নেত্রকোনার বারহাট্টা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয়েছে। এ ছাড়া খুলনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের ব্যক্তিগত সহকারী ফরিদ হোসেনকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, অফিস সহকারী মো. মাসুমকে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, প্রধান সহকারী আনোয়ার হোসেনকে নওগাঁ সিভিল সার্জন অফিস, বরিশাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের প্রধান সহকারী রাহাত খানকে মানিকগঞ্জের সিভিল সার্জন অফিস, উচ্চমান সহকারী মো. জুয়েলকে কক্সবাজারের মহেশখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, রংপুর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী আজিজুর রহমানকে শেরপুরের সিভিল সার্জন কার্যালয়, স্টেনোগ্রাফার সাইফুল ইসলাম গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমকে সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন অফিসে বদলি করা হয়েছে। কালের কন্ঠ

পাঠকের মতামত: