ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

বিকৃত রুচির নরপশুদের থামাবে কে?

:: মাহবুবা সুলতানা শিউলি ::

প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকার পাতা খুললে দেখা যায়, কোন না কোন পাতায় ধর্ষণের ঘটনা। মুসলিম প্রধান দেশ সত্বেও এটি যেনো নিত্যদিনকার সাধারণ একটি সংবাদের শিরোনাম।

গতকাল পহেলা জানুয়ারী দিবাগত রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার ৫নং চরজুবলি ইউনিয়নে ৪নং ওয়ার্ডে চার সন্তানের জননী পারুলকে গণধর্ষণ ও তার স্বামী ও ছেলে-মেয়েদের ব্যাপক মারধর করেছে কিছু নরপশু। আর এতে ইতিহাস তুমি কি বলবে..!

অবশেষে না ফেরার দেশেই চলে গেলেন চার সন্তানের এ জননী। কিছু নরপশু বিকৃতমনা মানুষের গণধর্ষণের শিকার তিনি।

‘আমাকে তোরা বেইজ্জত করিস না, আমার পোলাপাইন আমাকে মা বলে ডাকবে না’ গণধর্ষণের সময় এটাই ছিল এ মাতার আর্তনাদ আর আকুতি। মানবতা আজ এ মাতার মতই নিষ্প্রাণ হয়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছে মনে হয়..!! এ মায়ের সন্তানেরা তাদের মায়ের কবরে তীব্র চিৎকার করে বুক ফাটিয়ে আর্তনাদ করছে। এ আর্তনাদ কি সঠিক জায়গায় পৌঁছবে..!

শিল্পী হায়দার হোসেনের কন্ঠে-

‘কতটুকু অশ্রু গড়ালে হৃদয় হবে জলে সিক্ত, কত প্রদীপ শিখা জ্বালালেই জীবন আলোয় উদ্দীপ্ত। কত ব্যথা বুকে চাপালেই তাকে বলি আমি ধৈর্য, নির্মমতা কতদূর হলে জাতি হবে নির্লজ্জ।

‘আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার। বুকের ব্যথা বুকে চাপায়ে নিজেকে দিয়েছি ধিক্কার।’

এবার আসি মূল আলোচনা বা বিশ্লেষণে :

বিকৃত মানসিকতা ছাড়াও বিশেষ করে পারিবারিক বিরোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা ও স্বার্থের দ্বন্দে¦ বলি হচ্ছে শিশু থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সী নারীরা। এ রকম ঘৃণ্য অপরাধ করার ব্যাপারে যে মনস্তাত্ত্বিক শক্তি দরকার, অপরাধীদের এই শক্তির জোগানদাতা কে? এই প্রশ্নটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ??

বিকৃত যৌনাকাঙ্খা, যৌনাচার ও বিকৃত মানসিকতা ছাড়াও অধিকাংশ গণধর্ষণ মামলায় বা একক ধর্ষণের পেছনে অপরাধীদেরকে শক্তি জোগায় তার রাজনৈতিক পরিচিতি কিংবা আর্থিক শক্তির জোর। ধর্ষণ অপরাধের প্রণোদিক আর্থিক শক্তিরও পেছনে সাহস জোগায় অবৈধ টাকা ও রাজনৈতিক ক্ষমতা।

আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।

যদিও জানলাম ধর্ষক সোহেল আটক হয়েছে। কিন্তু এখানে আমাদের সংশয় আছে। কারণ অধিকাংশ সময় দেখা যায়, ধর্ষকরা রাজনৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে এসব অপকর্ম করে নির্ভয়ে পার পায়। আবার অধিকাংশ ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের ঘটনার সাথে রাজনীতি জড়িয়ে যায়। যার দরুন অনেক সময় এসব অপরাধের শাস্তি দেবার ক্ষমতা স্থানীয় প্রশাসনের থাকেনা।

আরো দেখা যায়, ধর্ষক বা ধর্ষকগোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাবান রাজনৈতিক শক্তির অংশীদার। ধর্ষক ভাবে, তার অপরাধ যাই হোক না কেন ক্ষমতা আর টাকার জোরে সে প্রচলিত আইন ও আদালতকে তার নিজের পক্ষে ব্যবহার করতে পারবে। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় ধর্ষক বা ধর্ষকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, আর্থিক ক্ষমতার কাছে মাথা নত করে থানা, পুলিশ, তদন্ত কর্মকর্তা, প্রশাসন, আদালত, সাক্ষী, ধর্ষণ আলামত পরীক্ষাকারী চিকিৎসক ও হাসপাতাল। ফলে অপরাধীরা এক ধরণের দায়মুক্তি পেয়ে যায়।

আমাদের প্রত্যাশা, এ ধর্ষণের বিচারটিতে যেনো কোনো হেলাফেলা করা না হয়। বঙ্গমাতা আপনার কাছে আহবান, দ্রুত বিচারকার্যের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করুন। আপনার স্বপ্নের এ সোনার বাংলাকে কলংকিত হতে রক্ষা করুন। এখনই উপযুক্ত সময়।

হে অগ্নিকণ্যা, আপনার সুশাসনের চূড়ান্তরুপ আমরা আগেও দেখেছি, এখনও দেখতে চাই হে বাংলার মাতা।

নারীরা আজ কোথায়ও নিরাপদ নয়। পরিবারের সদস্য, শ্বশুরালয়, কর্মস্থলের সহকর্মী ও গৃহকর্তা-কর্ত্রী কারো কাছেই যেন নিরাপদ নয় নারী-সমাজ। আমরা এক সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে প্রতিনিয়ত বিচরণ করছি। ধর্ষণের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান থাকলেও সে বিধান কার্যত বাস্তবায়ন হচ্ছেনা ধর্ষকের ক্ষেত্রে। একজন খুব সহজেই মুক্ত হওয়ার পর আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে ধর্ষকগোষ্ঠী। এভাবে সহসা বিনা বিচারে ধর্ষণকারীরা পার পেয়ে যাওয়ার ফলে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনা।

এ ধরনের পাশবিকতায় আমাদের সামাজিক নিরাপত্তার সংকট কতোটা প্রকট, তার ইঙ্গিত দেয় সাম্প্রতিক ভারতে ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক, অবর্ণনীয় স্বরণকালের ধর্ষণ অপরাধের মাইলফলক, সর্বোচ্চ বিকৃত মানসিকতার ইতিহাসের আঁতকে ওঠা লোমহর্ষক ধর্ষণের শিকার ৮ বছরের শিশু আসিফার ওপর ঘটে যাওয়া পাশবিকতা..!!!

বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হওয়ায় ধর্ষণ অপরাধ আরো প্রকট বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সমাজপতিরা ধর্ষকের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেন। আবার অনেক সময় রক্ষকই ভক্ষকের ভুমিকা নেয়। তাই ঘটনার শিকার দরিদ্র পরিবারগুলো সামাজিক বাধ্যবাধকতা মানতে গিয়ে এমন নির্মমতার বিচার চাওয়ারও সাহস দেখান না। উল্লেখ্য ঘটনার ধর্ষণটিতেও সহজে অনুমেয় এর পরিবারও বিড়ম্বনার শিকার হবেনই।

নারী ও শিশু নির্যাতনের কঠোর আইন বাংলাদেশে বিদ্যমান আছে। কিন্তু সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নেই। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, আইনের শাসনের অকার্যকারিতা, প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ প্রভৃতি কারণে নারী ও শিশু ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এই জন্যই দিনে দিনে শিশু ও নারী ধর্ষণ বেড়েই চলেছে।

আর প্রতিনিয়ত এতটা নৃশংসতা আমাদের মানবিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এধরণের জঘণ্যতার শিকার নারীরা, আমাদেরই মা-বোনেরা, তোমরা আমাদের ক্ষমা করো…! তোমাদের জন্য আমরা কিছুই করতে পারছি না। আমরা কি পারি না ধর্ষণের অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করার জন্য আন্দোলন করতে! তবেই হয়তো আমাদের প্রতিদিন পত্রিকায় পাতায় দেশ ও বিদেশের কোথাও না কোথাও ঘটে যাওয়া এ ঘৃণ্য অপরাধের সংবাদ আর পড়ার সুযোগ হবে না বা আস্তে আস্তে কমে যাবে! আর ধর্ষিতার নয়, ধর্ষকের ছবি প্রকাশ করে ভাইরাল করতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, আমাদেরকে আরো আরো বেশি মানবিক হতে হবে। যা আমাদের শিখাবে নিজ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। আর সেটা যদি শিখতে পারি তাহলে এরকম নির্মম নৃশংসতার শিকার হতে হবেনা আমাদের মা-বোনদের।

কাজেই, আসুন আমরা একত্রিত হই, একসুরে বলি, ‘ধর্ষণ অপরাধে সামাজিক আন্দোলন চাই ও দৃষ্টান্তমূলক আইনের প্রয়োগ চাই।’ রাষ্ট্র গড়ে তুলুক মানবপাচার ও মাদকের মতো! ধর্ষণের বিরুদ্ধেও জিরো টলারেন্স।

কলাম লেখক: মাহবুবা সুলতানা শিউলি

মেম্বার, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ

কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

ইমেইল::mahbubasheulz82@gmail.com

পাঠকের মতামত: