ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

লামায় অবাধে বালু উত্তোলনে ভাঙ্গছে নদীর পাড়, বিলীন হচ্ছে বসতবাড়ি ও ফসলের জমি: ক্ষতি শত কোটির টাকার গ্রামীণ অবকাঠামোর

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, লামা (বান্দরবান) প্রতিনিধি ::

বান্দরবানের লামায় অনুমোদিত কোনো বালুমহাল নেই। নেই বালু উত্তোলনে প্রশাসনের অনুমতি। তারপরেও বর্তমান সরকার দলীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় মাসের পর মাস উপজেলার শতাধিক স্থান থেকে ড্রেজার ও সেলু মেশিন দিয়ে চলছে অবাধে বালু উত্তোলন। অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে বিস্তৃর্ণ এলাকা নদীভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। এতে করে অনেকেই হচ্ছেন ভূমিহীন ও বিলীন হচ্ছে বিস্তৃর্ণ ফসলের জমি।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের বগাইছড়ি, মালুম্যা, ফাঁসিয়াখালী খাল, লাইল্যারমার পাড়া, সাপেরগারা, হারগাজা ও কুমারী, সরই ইউনিয়নের হাছনাভিটা, পুলু খাল, আমতলী, ডলু খাল, আজিজনগর ইউনিয়নের চাম্বি বাজার, ছিয়ততলী বাজার, মিশন পাড়া, আমতলী মুসলিম পাড়া, কিল্লাখোলা এবং ফাইতং ইউনিয়নের হেডম্যান পাড়া, ফাইতং বাজারের আশপাশ হতে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। যার ফলে প্রতিবছর ভাঙ্গছে খালের দু’পার। বালু তোলার কারণে গত কয়েক বছরের ভাঙ্গনের উপজেলার প্রায় ৭০টি বাড়ী সম্পূর্ন বিলীন ও ভাঙ্গনের ঝুঁকিতে রয়েছে নদী-খাল পাড়ের ৩শত থেকে ৪শত বসতভিটা সহ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, মন্দির ও রাস্তাঘাট। ফাঁসিয়াখালী হতে দৈনিক প্রায় ২শত গাড়ি, আজিজনগর হতে ৭০ গাড়ি, ফাইতং হতে ৫০ গাড়ি ও সরই হতে প্রায় ১৫০ গাড়ি বালু তোলে পাচার করছে কয়েকটি সিন্ডিকেট।

ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের মালুম্যা এলাকার অনেকের সাথে কথা হলে জানা যায়, পাচারকৃত বালুর গাড়ি হতে সরকার কোন রাজস্ব পায়না। ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি নুর হোসেন, কক্সবাজার ডুলহাজারা এলাকার বালুর ইজারাদার এমরান ও নাছির এর তত্ত্বাবধানে চলে এইসব অবৈধ বালুর ব্যবসা। সংশ্লিষ্ট সকল প্রশাসনকে এরাই ম্যানেজ করেন। তারা রানা ও মিনহাজ নামের দুইজন লোক দিয়ে সকল বালু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে গাড়ি প্রতি ১৪০ টাকা টেক্স বা চাঁদা নেয়। বগাইছড়ি ও ডুলহাজারা সড়কে হিন্দু পাড়া বসে বালুর গাড়ি হতে চাঁদা তোলে রানা ও মিনহাজ। এছাড়া ফাঁসিয়াখালীর বগাইছড়ি উত্তর মালুম্যার আলতাজ মিয়া, দক্ষিণ মালুম্যার রেজাউল, উত্তর মালুম্যার শাহজাহান ও সিরাজ সরাসরি বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত।

এই বিষয়ে নুর হোসেন বলেন, চাঁদা নেয়ার বিষয়টি আমি জানিনা। মালুম্যা ও বগাইছড়ি বড় ব্রিজের নিচ পর্যন্ত লামা উপজেলার অংশ হলেও তিনি চকরিয়ার অংশ বলে দাবী করেন। ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড মেম্বার মো. হোসেন মামুন বলেন, মালুম্যা ও বগাইছড়ি ব্রিজের নিচ অংশ লামা উপজেলায় পড়েছে। তারা জোর করে বালু উত্তোলন করে। দ্রুত বালু পাচার বন্ধে প্রশাসনের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

ফাসিয়াখালী ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের মেম্বার নাসির উদ্দিন বলেন, গত কয়েক বছরে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের ফলে আমার পৈত্রিক ভিটা সহ ১২টি বাড়ি সম্পূণ বিলীন হয়ে গেছে। সামনের বর্ষা মৌসুমে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাপের গারা মসজিদ, বৌদ্ধ মন্দির সহ খালপাড়ের আরো ২৫ থেকে ৩০টি বসত ভিটা নদী গর্ভে হারিয়ে যেতে পারে।

ফাঁসিয়াখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র আব্দু রহিম, ছাত্রী ফারজানা ও আসমাউল হোসনা বলেন, বালুর গাড়ির জন্য আমরা স্কুলে যেতে পারিনা। অসম্ভব ধূলাবালি রাস্তায়। আমাদের ইউনিফর্ম নষ্ট হয়ে যায়। বালুর গাড়ি রাস্তাঘাট সব নষ্ট করে ফেলেছে।

ফাঁসিয়াখালীর লাইল্যারমার পাড়ার মসজিদের পাশে খালের মাঝে বালু উত্তোলন করে পাচারের উদ্দেশ্যে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। পুরো খাল জুড়ে রয়েছে বালুর স্তূপ। নদী গর্ভে বিলীন হওয়া বাড়ির মালিক মনর আলী এখনও আরেকটি বাড়ী করতে পারেনি বলে জানান। দুই বছর পূর্বে তার বাড়ি খালের ভাঙ্গনের কারণে বিলীন হয়ে যায়।

ফাঁসিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যান জাকের হোসেন মজুমদার বলেন, বালু নৈরাজ্যের কারণে ইউনিয়নের শত কোটি টাকার রাস্তাঘাট, ব্রিজ ও কালভার্ট নষ্ট হয়ে গেছে। রাস্তা তৈরি করে ২ মাস ঠিক রাখা যায়না। বালু পাচারকারীরা অনেক প্রভাবশালী ও বেপরোয়া। প্রশাসন চাইলে বালু পাচার বন্ধ করে দিতে পারে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়মানুযায়ী নদীর তীরের ২ হাজার ৫০০ ফুটের মাঝ থেকে বালু উত্তোলনের নিয়ম থাকলেও এসব নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেনা কেউ। নদীর তীরবর্তী এলাকায় সেলু ইঞ্জিন চালিত ড্রেজার দিয়ে যত্রতত্র গর্ত করে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলে ভাঙ্গনের কবলে পড়ে সময়-অসময়ে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে শতশত একর আবাদী জমিসহ বসতভিটা। ওই সব এলাকার বাসিন্দারা ভাঙ্গন আতঙ্কে থাকলেও ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারছে না। একইভাবে সরই, ফাইতং ও আজিজনগর ইউনিয়নের সরকারদলীয় কয়েকটি সিন্ডিকেট অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে।

এ ব্যাপারে লামা উপজেলার দায়িত্বরত কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক সাইফুল আশ্রাব জানান, গত মাসের আমরা ফাঁসিয়াখালীতে বালু তোলার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছি। সামনে জড়িতদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে মামলা করা হবে।

লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূর-এ জান্নাত রুমি বলেন, লামা উপজেলার কোথাও বালু উত্তোলনে সরকারী ইজারা দেওয়া হয়নি। বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ বেআইনী। যে সব ব্যক্তিরা বালু উত্তোলন করছে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পাঠকের মতামত: