ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

লামায় নিয়ম না মেনে নদীর দু’পাড়ে তামাক চাষ

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, লামা ::

বান্দরবানের লামা উপজেলার মাতামুহুরী নদী, লামা খাল, বমু খাল, পোপা খাল সহ সকল ছড়া-খাল-নদীর দুই ধারে ব্যাপক ভাবে চাষ হচ্ছে বিষাক্ত তামাকের। এই অঞ্চলের শতকরা ৯০ শতাংশ আবাদী জমি এখন তামাক চাষের দখলে। কৃষি বিভাগের উদাসীনতা ও সংশ্লিষ্টদের নজরদারী এবং সঠিক পরামর্শের অভাবে প্রতি বছরই তামাক চাষ বেড়েই চলেছে। নদী-খালের ৫০ ফুটের মধ্যে তামাক চাষ করার নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও তা উপেক্ষা করে নদীর দু’পাড়ে তামাক চাষ করছে কৃষকরা। সরেজমিনে গিয়ে নদীর দুই পাড়ে অবাধে বিষাক্ত তামাক চাষ লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে বৃটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোং লিঃ এর চাষীরা আইনটি মেনে চললেও অন্য কোম্পানীর চাষীরা তা মানছেনা।

তামাক চাষে যেমন এক দিকে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে তেমনি মারাত্মক ভাবে ক্ষতি হচ্ছে কৃষকদের। তামাক চাষে প্রচুর পরিমাণ পানির দরকার আর এই পানির যোগান দিচ্ছে লামার নদী-খাল-ছড়া গুলো। কৃষকরা সেলুমেশিন বসিয়ে নদী থেকে অবাধে পানি উত্তোলন করছে ফলে নদী গুলো পানি শূণ্য হয়ে পড়েছে। তাছাড়া তামাক চাষে যে পরিমাণ রাসায়নিক সার, বিষ ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে ঐ সব জমি অন্য ফসল চাষের জন্য অনু-উপযোগী হয়ে পড়ছে এবং এই সব কীঠনাশক বৃষ্টির পানির সাথে মিশে নদীতে পড়ছে। ফলে পানি দূষিত হচ্ছে এবং জলজ প্রাণীর বসবাসের অনুউপযোগী হয়ে উঠছে। সম্প্রতি নদীতে বিষক্রিয়ায় মাছ মরে ভেসে থাকতে দেখা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে সব জমিতে তামাক চাষ করা হচ্ছে সে সব জমিতে ভবিষ্যতে অন্য কোন ফসল চাষ করা যাবে না। শুধু তাই নয় তামাক চাষে কৃষকরাও ভুগছে নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুকিতে। কিন্তু কৃষকরা এসব কথা মাথায় না রেখেই শুধু স্বল্প সময়ে বেশি লাভের আশায় বিপদ-জনক জেনেই চাষ করছে তামাকের।

কৃষকদের সাথে কথা বললে তারা জানায়, বিক্রয়ের নিশ্চয়তা থাকায় ও নানাবিধ সুবিধা থাকায় তারা বিপদ জেনেও তামাকের চাষ করছে। তারা আরও জানায় এই সব জমিতে অন্য কোন ফসল হয় না, তার থেকে তামাক চাষে তারা ব্যাপক ভাবে লাভবনা হচ্ছে। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা নুরে আলম এর সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে তিনি জানায়, বিষয়টি নিয়ে তারাও মাথা ঘামাচ্ছে। অন্য ফসলের তুলনায় তামাক লাভ জনক হওয়ায় কৃষকরা তামাকে ঝুঁকছে। তাই কৃষকদের বলে তামাক চাষ বন্ধ করা যাচ্ছে না।

সূত্র জানায়, ১৯৯১ সাল থেকে প্রায় ২৭ বছর যাবৎ তামাক চাষ হয়ে আসছে এই এলাকায়। বিএটিবি, আকিজ ট্যোবাকো, ঢাকা ট্যোবাকো, আবুল খায়ের ট্যোবাকো, আলফা ট্যোবাকো ও সমিতি ট্যোবাকো সহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি দীর্ঘদিন যাবৎ অত্র জনপদে তামাক চাষ ও বিস্তারে চাষীদের উদ্বুদ্ধ করছে। স্থানীয় কৃষকদের থেকে পাওয়া তথ্য মতে এবছর লামায় সবকয়টি তামা

ক কোম্পানির সহায়তায় ৯ হাজার ৩ শত হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। এছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে আরো প্রায় ২ হাজার একর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। লামা উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে লামা উপজেলায় আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার ৫শত হেক্টর।

২০১১ইং সালে উপজেলা চাষী স্বার্থরক্ষা কমিটির তামাক চাষ বন্ধ ও ন্যায্য দাম পাওয়ার বিষয়ে বান্দরবান জর্জ কোর্টে তামাক চাষের বৈধতা নিয়ে রিট করলে আদালত তামাক চাষ নিয়ন্ত্রনে রাখতে আদালত সর্বমোট ১ হাজার হেক্টর চাষের অনুমতি দেয়। কিন্তু বাস্তবতা এর বিপরীত। সমগ্র জেলা ঘুরে দেখা যায় এক ফসলি, দুই ফসলি ও তিন ফসলি জমি সহ সরকারী রিজার্ভ, নদীর দু’পার তামাক চাষের দখলে। এমনকি কৃষি অফিস সহ সরকারি নিজস্ব জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে।

লামা পৌরসভার কৃষক নুরুল আমিন, মংক্যহ্লা মার্মা, রশিচন্দ্র ত্রিপুরা, নীলকান্ত বড়–য়া, মংবাচিং মার্মা সহ একাধিক কৃষকের সাথে কথা বলে জানা যায়, কৃষি পন্য চাষ করে তেমন কোন সহায়তা পাওয়া যায়না। তাই আমরা আগে ধান ও শস্য চাষ করলেও বর্তমানে তামাক চাষে করছি। তামাক কোম্পানীর ফিল্ড অফিসাররা চাষাবাদে হাতে কলমে আমাদের শিক্ষা দেয় এবং নানাবিধ সহায়তা করে। সে তুলনায় কৃষি বিভাগের সহায়তা অপ্রতুল।

উপজেলা কৃষি অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাজে অবহেলা, দায়িত্ব পালনে অনিহা, কৃষকের সাথে দূরত্ব, সরকারের কৃষি উন্নয়নে গৃহীত নানান প্রকল্প কৃষককে অবহিত না করা, সার ডিলারদের সাথে সখ্যতা তৈরি করে সার বাণিজ্য, কৃষি উপকরণ বিতরণে পক্ষপাতিত্ব, কৃষকদের সাথে নিয়মিত কৃষি সমাবেশ না করা, বীজ বিতরণে অনিয়ম, পন্য বিপননে অসহযোগিতা সহ ব্যাপক দুর্নীতির কারণে সিংহভাগ আবাদি জমি আজ তামাকের দখলে চলে গেছে বলে জানায় তারা।

তামাকের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির বিষয়ে লামা হাসপাতালে আবাসিক মেডিকেল অফিসার মো. শফিকুর রহমান মজুমদার বলেন, তামাক গ্রহণে মানুষের ক্যান্সার, হার্টের বিভিন্ন রোগ, স্ট্রোক, শ্বাসকষ্ট ও পায়ে পচন এবং ধুয়াবিহীন তামাক জর্দা ও সাদাপাতা ব্যবহারের ফলে খাদ্যনালীতে ক্যান্সারসহ নানা শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত হতে পারে। বাংলাদেশে প্রতি বছর তামাকের কারণে প্রায় এক লক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করে। এছাড়া ৩ থেকে ৪ লক্ষ লোক তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে অসুখ ও অক্ষমতাজনিত কুফল ভোগ করে।

মরণ চাষ তামাক নিয়ে বান্দরবান কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আলতাব হোসেন বলেন, যেভাবে তামাক চাষের আবাদ বাড়ছে তা যথারীতি অত্র জনপদের জন্য হুমকি সরুপ। ধান ও শস্য চাষে কৃষকদের ফিরিয়ে আনতে সরকার কর্তৃক স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ, কৃষি উপকরণ সহজলভ্য সহ নানান পদক্ষেপ সরকার ইতিমধ্যে গ্রহণ করেছে।

পাঠকের মতামত: