ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

নৌকায় একাধিক, বিএনপিতেও পরিবর্তনের সুর

কক্সবাজার প্রতিনিধি ::
দুয়ারে কড়া নাড়ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাই প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে রাজনৈতিক দল গুলোর সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল ছাড়াও এ আসনে নৌকা পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে অন্তত অর্ধ ডজন প্রার্থী। তারা মাঠেও চষে বেড়াচ্ছেন।
অন্যদিকে বিএনপিতে মাঠ দখলে রেখেছেন সাবেক সাংসদ ও কেন্দ্রীয় বিএনপির মৎস্যজীবী বিষয়ক সম্পাদক লুৎফুর রহমান কাজল। পাশাপাশি মাঠে আছেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি অধ্যাপক আজিজুর রহমান।
অতীতের মত এবার বিএনপি জোটগতভাবে ফাঁকা মাঠ নাও পেতে পারে। কারণ এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী লড়ারও আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
দুই দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, কৌশলে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী লুৎফর রহমান কাজল। প্রায়ই বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জনগণের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। দলীয় নেতাকর্মীদেরও চাঙা রেখেছেন।
এদিকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেতে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন বর্তমান সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল, কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী কানিজ ফাতেমা আহমেদ, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইশতিয়াক আহমেদ জয়, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সরওয়ার কাবেরী, রামু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরওয়ার কাজল। এছাড়া মনোনয়ন পেতে চেষ্টা করছেন ব্যারিস্টার মিজান সাঈদ, জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল হক মুকুল।
এই আসন থেকে ২০০৮ সালে নৌকার মনোনয়ন দেওয়া হয় বর্তমান সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমলকে। সেই নির্বাচনে তিনি বিএনপির প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। যদিও সেই নির্বাচনে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল।
২০০৮ সালের নির্বাচনে কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু) আসনে ১ লাখ ২৬ হাজার ৪৭৮ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন বিএনপির প্রার্থী লুৎফুর রহমান কাজল। নৌকার প্রার্থী সাইমুম সরওয়ার কমল পান ৮৬ হাজার ৫৩৬ ভোট। আর ধানের শীষের বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) প্রার্থী মোহাম্মদ শহিদুজ্জামান পান ৬৩ হাজার ৬৮ ভোট। অন্যান্য তিনজন প্রার্থী পান মাত্র ১ হাজার ১০ ভোট।
পরে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ নির্বাচিত হন সাইমুম সরওয়ার কমল। যদিও সেই নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল কানিজ ফাতেমা আহমেদকে। বিদ্যুৎ বিল বকেয়ার অজুহাতে তাঁর হাতছাড়া হয়ে যায় সেইবারের মনোনয়ন।
এবার কমলের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে আছেন তাঁর বড় ভাই ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরওয়ার কাজল এবং ছোটবোন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সরওয়ার কাবেরী।
রামু উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নীতিশ বড়–য়া বলেন, ৭৫ পরবর্তী সময়ে সংসদ সদস্য আলহাজ¦ সাইমুম সরওয়ার কমল এ আসনে রেকর্ড পরিমান উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করেছেন। যা আগে কেউ দেখেনি। কক্সবাজার-রামু আসনে এমপি কমলের কোন বিকল্প নেই। তিনি বিগত ৫ বছর সংসদ সদস্য থাকাকালে এবং এর আগেও কক্সবাজার-রামুর প্রতিটি গ্রাম চষে বেড়িয়েছেন। তাই মনোনয়ন পেলে এমপি কমলের জয়ও সহজ হবে। সাধারণ মানুষ দলমত নির্বিশেষ তাকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করবে।
এদিক থেকে নৌকার মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে আছেন বর্তমান সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল, কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী কানিজ ফাতেমা আহমেদ ও জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইশতিয়াক আহমেদ জয়।
সম্প্রতি আনুষ্ঠানিক কর্মীসভা করে কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগ থেকে কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু) আসনের জন্য মোহাম্মদ নজিবুল ইসলামকে একক প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। ওই সভায় হাজারো নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।  সভায় প্রধান অতিথি জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌরসভার নবনির্বাচিত মেয়র মুজিবুর রহমান নজিবুল ইসলামের প্রতি শুভ কামনা জানিয়ে বলেন, নজিব আমার রাজনৈতিক বাগানের প্রথম ফুটন্ত ফুল।
পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উজ্জল কর বলেন, ঐক্যবদ্ধ কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের পক্ষে যেকোন কিছু মোকাবেলা করা সম্ভব। এর দৃষ্টান্ত উদাহরণ হলো, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কক্সবাজার পৌরসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনে নৌকার মুজিবুর রহমান বিপুল ভোটে জয় লাভ করে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তাই সংসদ নির্বাচনে নজিবুল ইসলামকে নৌকার মনোনয়ন দেওয়া হলে তিনিও বিপুল ভোটে জয়ী হবেন।
খুরুশকুল ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন বলেন, কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মেয়র মুজিবুর রহমানের আস্থাভাজন মোহাম্মদ নজিবুল ইসলামের পক্ষে আমরা ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। আগামী সংসদ নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন দেয়া হলে কক্সবাজার পৌরসভাসহ পাশ্ববর্তী ইউনিয়নগুলোতে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে আমরা নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত করব।
কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম বলেন, ‘কে মনোনয়ন পাবেন তা একমাত্র জানেন দলের সভানেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যাঁকেই মনোনয়ন দেবেন, তারপক্ষে কাজ করতে প্রস্তুত আছি। আমাদের উদ্দেশ্যে হলো নৌকাকে বিজয়ী করা। আর আমার বিশ^াস তিনি (প্রধানমন্ত্রী) একজন শক্তিশালী ও যোগ্য ব্যক্তির হাতে নৌকা তুলে দেবেন। কারণ এ আসনে (সদর-রামু) দলীয় প্রতীকের সাথে ব্যক্তি ইমেজও বিবেচনাযোগ্য।’
নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন প্রত্যাশী ইশতিয়াক আহমেদ জয় বলেন, ‘আমি জননেত্রী শেখ হাসিনার একজন কর্মী। তিনি যখন যে নির্দেশ দেবেন, তা পালন করে যাবো। আপাতত শেখ হাসিনার উন্নয়নের বার্তা প্রান্তিক মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তুলে ধরছি।
২০১৪ সালে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী কানিজ ফাতেমা আহমেদকে। কিন্তু বিদ্যুৎ বিল সমস্যার কারণে তিনি মনোনয়ন পাননি। তিনি এবারও নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন। কানিজ ফাতেমা আহমদের স্বামী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরীও এই আসন থেকে একাধিকার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। বর্তমানে মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী জেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান।
কানিজ ফাতেমা আহমেদ বলেন, ‘নেত্রীর প্রতি আমার শতভাগ বিশ^াস রয়েছে। তিনি  এ আসন থেকে আমাকেই মনোনয়ন দেবেন।’ তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এক মুহুর্তের জন্য দল ও জনগণকে ছেড়ে যায়নি। আজীবন মানুষের জন্য কাজ করে যাবো।
ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাইয়ের অবস্থান নিয়ে রামুতে বেশ সরগরম আওয়ামী রাজনীতি। রামু উপজেলা ও উপজেলার তৃণমূল আওয়ামী লীগ সাংসদ কমলের ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরওয়ার কাজলের নেতৃত্বাধীন। সোহেল সরওয়ার কাজলও নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি বলেন, বর্তমান সাংসদের (কমল) অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ। মানুষ এই নির্যাতনের হাত থেকে পরিত্রাণ চায়। তাই আমি মাঠে নেমেছি।’ নিজের পক্ষে সবচেয়ে বেশি জন সমর্থন আছে বলেও দাবী করেন তিনি।
বর্তমান সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, ‘গত দুইবার পার্লামেন্ট নির্বাচন করেছি। সব সময় জনগণের সাথে থেকেছি। উন্নয়নই আমার রাজনীতি। গত ৫ বছরে শিক্ষা থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তাই আমার বিশ^াস নেত্রী এবারও আমাকে মনোনয়ন দেবেন।’
তিনি আরও বলেন, তিনি মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। আর মনোনয়ন পেলে এ আসনে আওয়ামীলীগের নৌকা প্রতীকের বিজয় সুনিশ্চিত হবে। তাঁর বিরুদ্ধে তোলা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে সাংসদ কমল বলেন, ‘গত ৫ বছরে কোন নেতাকর্মী আমার কারণে মামলার আসামী হয়নি। যারা অভিযোগ করছে, তারা আমার চিহ্নিত রাজনৈতিক শত্রু। সুতরাং এসব অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই।’
জেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক ইউসুফ বদরী বলেন, সদর-রামু আসনে কেন্দ্রীয় বিএনপির মৎস্যজীবী বিষয়ক সম্পাদক লুৎফুর রহমান কাজলের বিকল্প নেই। নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। একাদশ নির্বাচনে তিনিই দলীয় মনোনয়ন পাবেন এমনটা প্রায়ই নিশ্চিত। ২০১৭ সালে দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া রোহিঙ্গাদের দেখতে এসে কাজলের বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়ে যান বলে দাবী করেন ইউসুফ বদরী।
২০১৪ সালে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি অধ্যাপক আজিজুর রহমান। কিন্তু দল নির্বাচনে না যাওয়ায় আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হয়নি তার।
অধ্যাপক আজিজুর রহমান বলেন, ‘দলের দুঃসময়ে আন্দোলন সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছি। দীর্ঘ সময় ধরে দলের জন্য ত্যাগ, জেল-জুলুম সহ্য করেছি। একারণে আমার বিশ^াস দল আমাকে মূল্যায়ন করবে। এছাড়াও কেন্দ্রের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে আমার।’
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কক্সবাজার পৌরসভা নির্বাচনে জামায়াতকে ছাড় দেয়নি বিএনপি। পৌর নির্বাচনের পর থেকেই বিএনপি-জামায়াতের মধুচন্দ্রিমায় ফাটল ধরে। এরফলে বিএনপির অনেক নেতাদের ধারণা এই আসনে এবার জামায়াতও প্রার্থী দেবে। জামায়াতের নির্দিষ্ট ভোটব্যাংক রয়েছে এ আসনে। সংসদ নির্বাচনে লড়ার সম্ভাব্য তালিকায় আছেন জেলা জামায়াতের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান, জেলা জামায়াতের সেক্রেটারী জেনারেল ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিএম রহিমুল্লাহ ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জামায়াতের শীর্ষ নেতা অ্যাড. সলিমউল্লাহ বাহাদুর।
এ আসনে জাতীয় পার্টি থেকে প্রার্থী হতে দৌড় ঝাঁপ চালাচ্ছেন জেলা জাতীয় পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য অ্যাড. মো. তারেক ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান।
জেলা নির্বাচন অফিসের তথ্য মতে, এ আসনে মোট ভোটার তিন লাখ ৬২ হাজার ৬৩৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৮৬ হাজার ৯৯ জন ও মহিলা ভোটার এক লাখ ৭৬ হাজার ৫৩৭ জন। কক্সবাজার সদর উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়নে ভোটার রয়েছে দুই লাখ ২২ হাজার ৮৩৫ জন। রামু উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে ভোটার সংখ্যা এক লাখ ৩৯ হাজার ৮১০।

পাঠকের মতামত: