ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

লামা ও আলীকদমে ব্যাহত হচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে বাঁশের বংশ বৃদ্ধি

লামা প্রতিনিধি ::

বছরের চলতি মৌসুম এলেই লামা, আলীকদমসহ পুরো পার্বত্যাঞ্চলে মজাদার সবজি হিসেবে বাঁশ কোড়ল (কচি বাঁশ) ব্যাপক হারে খাওয়া শুরু হয়। এতদঞ্চলের মানুষের খাদ্য তালিকায় বাঁশ কোড়ল যোগ হয়ে ক্রমেই এর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এক শ্রেণির অর্থলোভী উপজাতি এবং বাঙালী চলতি মৌসুমে বাঁশ কোড়ল সংগ্রহ ও বিক্রি করাকে তাদের পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তারা বাঁশ কোড়ল আহরনের নামে নির্বিচারে নিধন করছেন কচি বাঁশ। সবজি হিসেবে বাঁশ কোড়লের ব্যবহার নিয়ন্ত্রনে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর কোন উদ্যোগ না থাকায় লামা, আলীকদমসহ পার্বত্যাঞ্চলে ব্যহত হচ্ছে প্রাকৃতিক ভাবে বাঁশের বংশ বৃদ্ধি।
জানা গেছে, লামা ও আলীকদমসহ তিন পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়ে কয়েক প্রজাতির মূল্যবান বাঁশ জন্মে। এ গুলোর মধ্যে রয়েছে মুলি, দুলু , মিটিঙ্গা , কালী ও ছোটিয়া। বর্ষা মৌসুম বিশেষ করে জুন, জুলাই আগস্ট মাসে বাঁশের বংশ বৃদ্ধি হয়ে থাকে। এসময় আস্তে আস্তে বাঁশ বাগানগুলোতে জন্ম নিতে শুরু করে নতুন বাঁশ বা বাঁশ কোড়ল। সাধারণত বাঁশের বংশ বৃদ্ধির সময় বাঁশ আহরণ নিষিদ্ধ। অন্যান্য সময়ের তুলনায় নিষিদ্ধ সময়ে বাঁশ আহরন কিছুটা কম হলেও বাঁশ কোড়ল আহরণ থেমে নেই। বাঁশ কোড়ল উপজাতিদের খাদ্য তালিকায় মজাদার সবজির স্থান দখল করে আছে। উপজাতিদের পাশাপাশি বাঙালিরাও এখন দেদারছে বাঁশ কোড়ল সবজি হিসেবে খেতে শুরু করেছে। সৌখিন ভোজন রসিকদের তৃপ্ত করতে চলতি মৌসুমে পাহাড়ে জন্ম নেয়া কচি বাঁশ পরিণত বাঁশে রূপান্তরিত হওয়ার আগেই বাঁশ কোড়ল হিসেবে বাজারে চলে আসছে। লামা ও আলীকদমসহ তিন পার্বত্য জেলার হাঁট বাজারগুলোতে সাপ্তাহিক হাঁটের দিন প্রকাশ্যে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে বাঁশ কোড়ল। বাঁশ আহরণ বন্ধের মৌসুমে প্রকাশ্যে এভাবে বাঁশ কোড়ল বিক্রির বন্ধ কিংবা নিয়ন্ত্রনে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর নিরবতার ফলে প্রতি বছর বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় অর্ধকোটির বেশি বাঁশ উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে বলে স্থানীয়রা মনে করছেন।
উপজেলার গজালিয়া এলাকার হ্লাচিং নু মার্মা সপ্তাহে ২-৩ দিন স্থানীয় গজালিয়া বাজার ও লামা বাজারে বাঁশ কোড়ল বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। তিনি এক থেকে দেড়শ’ বাঁশ কোড়ল বাজারে আনেন। বাঁশ কোড়ল বিক্রেতারা জানান, পূর্বের ন্যায় এখন আর কাছা-কাছি এলাকায় বাঁশ কোড়ল পাওয়া যায়না। দুর্ঘম পাহাড়ের ঘনজঙ্গল এলাকার বাঁশ বাগান থেকে অনেক পরিশ্রম করে বাঁশ কোড়ল সংগ্রহ করতে হয়। প্রতি কেজি বাঁশ কোড়ল ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হয় বলে তারা জানান। আলীকদম বীরমনি তংচংগ্যা পাড়া এলাকার জগদীশ চন্দ্র তংচংগ্যা জানান, বাঁশ কোড়ল একটি মজাদার সবজি। আগে জুম চাষের জন্য পাহাড়ে আগুন দেয়ার পর বৃষ্টি হলেই এক প্রজাতির চিকন বাঁশ জন্মাত। যেগুলো সাধারণত বড় ধরনের কোন কাজে লাগে না। ওই সকল বাঁশের কোড়ল সংগ্রহ করা হত, যা বেশ মজাদার। বর্তমানে যে সকল বাঁশের কোড়ল সংগ্রহ করা হচ্ছে তাতে বাঁশের বংশ বৃদ্ধি ব্যহত হচ্ছে। লামা রুপসী পাড়ার শেখ আহমদ জানান, বাপ-দাদার আমল থেকে দেখে আসছেন তাদের পরিবারে বাঁশ কোড়ল সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ কোড়ল সংগ্রহের ফলে বাঁশের বংশ বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি তারা ভেবে দেখেন নাই। এক বেসরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিটি পরিবার সপ্তাহে এক বেলা খাবারের সময় ১০টি বাঁশ কোড়ল খেলে এক মাসে একটি পরিবার ৪০টি বাঁশ কোড়ল খাদ্য হিসেবে গ্রহন করে। তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসকারি ৫০ হাজার পরিবারও যদি সপ্তাহে এক বেলা হিসেবে নিয়মিত বাঁশ কোড়ল খেয়ে থাকে তা হলে বাঁশের গ্রোয়িং সিজনের ৩ মাসে অর্ধকোটির বেশি বাশ কোড়ল তারা সবজি হিসেবে খাচ্ছে। যা এতদাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে বাঁশের বংশ বৃদ্ধিতে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে, লামা বনবিভাগের আওতাধীন ১ লক্ষ ২ হাজার ৮৫৪ একর মাতামুহুরী রিজার্ভসহ লামা ও আলীকদমের বিস্তীর্ণ বনভুমিতে মূল্যবান বনজ সম্পদ মূলী বাঁশের উৎপাদন রেকর্ড পরিমানে হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে এলাকার হাজারো বাঁশ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। সে সাথে এলাকার বাঁশ ব্যবসায়ীরাও তাদের পেশা পরিবর্তন করে অন্য ব্যবসায় জড়িযে পড়েছেন।
লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন আহামদ জানান, বনবিভাগ প্রতি বছর মাতামুহুরী রিজার্ভ এলাকা বাঁশ মহাল নিলাম ইজারা দিয়ে থাকে। বাঁশ মহাল ইজারার চুক্তি অনুসারে জুন, জুলাই ও আগষ্ট তিনমাস বাঁশের বংশ বৃদ্ধির জন্য বাঁশ আহরণ ও চলাচল নিষিদ্ধ থাকে। এসময় বাঁশ শ্রমিকগণ বাঁশ অঅহরণ না করলেও ব্যাপক হারে বাঁশের করুল সবজি হিসেবে আহরণ করে বাজারে বিক্রি করেন। প্রধানত, একারণে বাঁশের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, প্রাকৃতিকভাবে বাঁশের বংশ বৃদ্ধির সময় সবজিতে বাঁশ কোড়লের ব্যবহার এখনই বন্ধ কিংবা নিয়ন্ত্রন করা না গেলে আগামীতে প্রাকৃতিকভাবে বাঁশের উৎপাদন ব্যাপক হারে হ্রাস পাবে।

পাঠকের মতামত: