ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে তিন চাকার দৌরাত্ম্য

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে নৈরাজ্য থামছেই না। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক সরকার মহাসড়কগুলোতে তিন চাকার (ত্রি-হুইলার) যানবাহন চলাচল একেবারেই নিষিদ্ধ করলেও ব্যস্ততম চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে এসব যানবাহন চলছেই। এতে প্রতিনিয়ত ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। এ মহাসড়কে দূরপাল্লার ও ভারী যানবাহনগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে তিন চাকার এসব যান। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও এসব যানবাহনের অদক্ষ চালক ও মালিকদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আবার স্থানীয় যাত্রীরাও গন্তব্যে যাওয়ার জন্য এই বাহনকে ব্যবহার করে চলছেন। এতে সড়ক দুর্ঘটনা আরো বাড়ার আশঙ্কা করছেন সচেতন মহল।

সচেতন মহলের মতে, সারাদেশে যেসব মহাসড়ক রয়েছে, এর মধ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ছিল বেশ নিরাপদের। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে নিরাপদ মহাসড়কটি হয়ে ওঠে মৃত্যুফাঁদে। মূলতঃ তিন চাকার যানবাহনের পাশাপাশি দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসসহ বিভিন্ন ভারী যানবাহনের বেপরোয়া গতি, ফিটনেসবিহীন যান এবং অদক্ষ চালকের কারণে সড়কে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে।

গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়ার ৩৯ কিলোমিটার অংশের প্রায় ২০ কিলোমিটার অংশে সরেজমিন দেখা যায় এই নৈরাজ্য। এ সময় মহাসড়কের বানিয়ারছড়াস্থ চিরিঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সামনে ছাড়া সড়কের অন্য কোথাও দেখা মেলেনি নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত এ সংস্থার সদস্যদের। মূলত হাইওয়ে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে দেদার চলছে তিন চাকার এসব যানবাহন।

বেলা একটার দিকে মহাসড়কের বরইতলী নতুন রাস্তার মাথা এলাকায় কথা হয় সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশারচালক আবদুল জলিলের সঙ্গে। এ সময় তাঁর কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়, উচ্চ আদালতের নির্দেশে সরকার মহাসড়কে তিন চাকার যেকোনো ধরনের যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করেছে, বিষয়টি জানেন কী-না।

এমন প্রশ্নের উত্তরে অটোরিকশাচালক আবদুল জলিল বলেন, ‘এটা তো কয়েকবছর ধরে শুনে আসছি, মহাসড়কের তিন চাকার যানবাহন ওঠতে দেওয়া হবে না। এ নিয়ে মাঝে-মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে হাইওয়ে পুলিশ অভিযানে নামে। এর পরেও তো দেখছি ঠিকই এসব যানবাহন মহাসড়কে চলাচল করছে। তাই আমিও মহাসড়ক দিয়ে যাত্রী আনা-নেওয়া করছি।’

এর আগে মহাসড়কের ইসলামনগর এলাকায় কথা হয় ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক-টমটম চালক রমিজ উদ্দিনের সঙ্গে। এ সময় তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, ‘বুধবার হারবাংয়ে কাভার্ড ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে টমটমের চার যাত্রী নিহত হয়েছে। এর পরও কেন মহাসড়কে টমটম নিয়ে বের হয়েছেন।?’

এর জবাবে রমিজের ভাষ্য,‘ হাইওয়ে পুলিশ বা প্রশাসনের কেউ যদি আমাদের নিষেধ করতো তাহলে তো আমি টমটম নিয়ে মহাসড়কে আসতাম না। অন্যরা চালাচ্ছেন দেখে আমি নিজেও বের হয়েছি টমটম নিয়ে। এতে দোষের কি আছে?’

সরেজমিন দেখা যায়, দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস ও পণ্যবোঝাই ভারী যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমানে চলছে তিন চাকার যান বিশেষ করে ইজিবাইক-টমটম, সিএনজি চালিত অটোরিকশা, নছিমন-করিমন, মাহিন্দ্র। এছাড়া একেবারে স্বল্প আকৃতির চার চাকার যানবাহনও যাত্রী পরিবহন করছে বেশি। এর মধ্যে লেগুনা, ছারপোকা, ম্যাজিক গাড়ি অন্যতম। চার চাকার এসব যানবাহনে চলাচলও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মূলত গত ১১ সেপ্টেম্বর দুপুরে বরইতলী নতুন রাস্তার মাথায় দুপুরে স্টার লাইন পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় যাত্রীবাহী ছারপোকার। এ দুর্ঘটনায় একসঙ্গে তিন নারীসহ প্রাণ হারায় সাতজন যাত্রী। আহত হয় অন্তত ১০ জন। এর পরের দিন বুধবার সকালে হারবাং ইনানী রিসোর্টের সামনে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকে (মোড়) প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের কাভার্ড ভ্যানের সঙ্গে যাত্রীবাহী ইজিবাইক-টমটম এর মুখোমুখি সংঘর্ষে এক নারীসহ চারজনের প্রাণ ঝরে যায়। একদিনের ব্যবধানে দুটি ভয়াবহ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন অসংখ্য যাত্রী।

সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে বানিয়ারছড়াস্থ চিরিঙ্গা হাইওয়ে পুলিশের ইনচার্জ ও সার্জেন্ট নূর-এ আলম পলাশ কয়েকটি সমস্যার কথা তুলে ধরেন। বিশেষ করে তিনটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে হাইওয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তার মতে।

এর মধ্যে রয়েছে প্রথমত: চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া অংশে রয়েছে ৩৯ কিলোমিটার এলাকা। এই এলাকায় মহাসড়ক লাগোয়া অভ্যন্তরীণ সড়ক, উপ-সড়ক রয়েছে অন্তত অর্ধশতাধিক। এসব অভ্যন্তরীণ সড়ক, উপ-সড়কে চলাচল করে তিন চাকার যানবাহন। বিশেষ করে সিএনজি অটোরিকশা, মাহিন্দ্র, ইজিবাইক-টমটম উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এসব যানবাহন এক সড়ক থেকে অন্য সড়কে যাতায়াতের জন্য হুট করে উঠে পড়ে মহাসড়কে। এ কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে।

দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি রোধে উচ্চ আদালতের নির্দেশে সরকার মহাসড়কে এসব যানবাহন চলাচল একেবারে নিষিদ্ধ করেছে। এই নির্দেশনা আমরাও মানার আপ্রাণ চেষ্টার অংশ হিসেবে প্রতিনিয়ত মহাসড়কে অভিযানও জোরদার করা হচ্ছে। এ ধরনের অসংখ্য যানবাহন প্রতিদিন ধরে মামলা দিচ্ছি বা জরিমানা করছি। কিন্তু একেবারে অল্পসংখ্যক জনবল নিয়ে অর্ধশতাধিক সড়ক, উপ-সড়কের কানেক্টিভিটিংয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে পাহারা দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এজন্য হাইওয়ে পুলিশে আগে জনবলের সংখ্যা আনুপাতিক হারে বাড়াতে হবে। তা না হলে যতই আমরা ওজর-আপত্তি করি না কেন তা কোন কাজে আসবে না।’

তাঁর মতে তৃতীয় কারণ হলো, ‘মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে উচ্চ আদালতের যে একটি রায় রয়েছে তা কী সত্যিকার অর্থে এসব যানবাহনের কোনো চালক জানেন বা অবগত আছেন? যদি তারা এই ধরনের নির্দেশনার বিষয়টি জানতেন তাহলে তারা কোনোভাবেই মহাসড়কে এই যানবাহন নিয়ে উঠতেন না। এমনকি যেসব সাধারণ যাত্রী এই বাহন ব্যবহার করে গন্তব্যে যাচ্ছেন তাঁরাও তো বিষয়টি ভালোভাবে জানেন না। তাই সবপক্ষকে নিয়ে বিশেষ কাউন্সেলিং করার প্রয়োজন রয়েছে। এটি সম্ভব হলেই যেমন সকলের মাঝে সচেতনতা বাড়বে, তেমনি করে কমে আসবে সড়ক দুর্ঘটনা।’

ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মা ও চালকসহ প্রাণে বেঁচে যাওয়া কালের কণ্ঠের নিজস্ব প্রতিবেদক আসিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘স্মার্ট জাতীয়পত্র নেওয়ার জন্য গত বুধবার সকালে চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রাইভেট কারযোগে চকরিয়ার দিকে রওনা দিই। আমাদের বহনকারী গাড়িটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতির কাছে মিডওয়ে-ইন রেস্টুরেন্টের কাছে যেতেই সামনে থাকা স্টার লাইন পরিবহনের বেপরোয়া গতির একটি যাত্রীবাহী বাস হুট করে রংসাইড দিয়ে ওই রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ছিল। বাসটি যে রেস্টুরেন্টে যাত্রাবিরতির জন্য ঢুকবে সেই সংকেত পর্যন্ত দেয়নি চালক। এমনকি রেস্টুরেন্টের নিজন্ব কোনো সংকেতধারীও ছিল না সেখানে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের কারচালক নিয়ন্ত্রণ হারায়। মুহূর্তেই আমাদের কারটি মহাসড়ক থেকে ছিটকে গিয়ে কয়েকদফা গড়াগড়ি খেয়ে প্রায় ২০ ফুট দূরের খাদে ধানক্ষেতে গিয়ে পড়ে।’

তিনি বলেন, ‘আল্লাহর অশেষ রহমত ছিল বিধায় সেদিন এত বড় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আমরা তিনজন (মা ও চালকসহ) প্রাণে বেঁচে যাই। স্মরণকালের ভয়াবহ এই পরিণতির শিকার হতে হয়েছে স্টার লাইন পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসের বেপরোয়া গতি

এবং অদক্ষ চালকের কারণে। শুধু স্টার লাইন পরিবহন বলে কথা নয়, এসি এবং নন এসি গুটিকয়েক পরিবহন ছাড়া অন্যসব যাত্রীবাহী

পরিবহনের বেপরোয়া গতির অসম প্রতিযোগিতার পাশাপাশি অদক্ষ চালকের কারণেও দুর্ঘটনার বাড়ার অন্যতম কারণ বলে আমি মনে করি।’

চকরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খোন্দকার মো. ইখতিয়ার উদ্দীন আরাফাত বলেন, ‘নিয়মিত দাপ্তরিক কর্ম সম্পাদনের পাশাপাশি মহাসড়কে নৈরাজ্য ঠেকাতে চেষ্টা করি সময় দিতে। এরই অংশ হিসেবে মাঝে-মধ্যে অভিযানও চালাই মহাসড়কে। এ সময় উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক তিন চাকার কোনো যান মহাসড়কে দেখলেই মামলা দিই এবং জরিমানা করি।’

তিনি বলেন, ‘চলতি সপ্তাহে একদিনের ব্যবধানে পর পর দুটি ভয়াবহ ও মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় একসঙ্গে ১১ জনের প্রাণহানির পর উপজেলা প্রশাসনের গঠিত ১১ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান হিসেবে অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে ইতোমধ্যে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছি।’

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান বলেন, ‘সম্প্রতি উপজেলার মাসিক আইনশৃঙ্খলা কমিটির এক সভায় একদিনের ব্যবধানে দুটি ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় বিপুলসংখ্যক প্রাণহানির বিষয়ে শোকপ্রকাশ এবং এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এ সময় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ মতামত পাওয়া গেছে। তাছাড়া প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অচিরেই এসব

পদক্ষেপ দৃশ্যমান হবে। তবে ১১ সদস্যের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিশদভাবে বিশ্লেষণ করে সেই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বেশকিছু সুপারিশ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।’

পাঠকের মতামত: