ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

লামার অসংখ্য ঝর্ণা-পাহাড়-নদী ও বিনোদন স্পট হাতছানি দিচ্ছে পর্যটকদের

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, লামা ::

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব নৈসর্গিক সৃষ্টি বান্দরবানের লামার পাহাড়ি ঝর্ণা। লামা উপজেলায় দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে এমন ৫টি পাহাড়ি ঝর্ণা রয়েছে। এছাড়া নয়নরঞ্জন ও বিষ্ময়কর প্রাকৃতিক প্রাচুর্য সমৃদ্ধ লামা উপজেলায় অসংখ্য পর্যটন স্পট দৃশ্যমান। যা দেখে হৃদয়-মন জুড়ে সৃষ্টি হয় শিহরণ। বর্ষায় জলধারার অবিরাম পতনে সৃষ্ট নিক্কন ধ্বনিসমেত অপরূপ দৃশ্য না দেখলে কল্পনায়ও সে ছবি আঁকা অসম্ভব। ঝর্ণার প্রকৃত সৌন্দর্য্য দেখা মিলে বর্ষায়। তখন ভরা যৌবনে থাকে ঝর্ণা গুলো।

রুপের রাণী খ্যাত লামার নদী, পাহাড়, পাথর, জলপ্রপাত ও সবুজ প্রকৃতির অপূর্ব এক সমন্বয়। এমন ভ্রমণরাজ্য বিরল। ষড়ঋতুর প্রত্যেকটি ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন রুপ নেয় প্রকৃতি। প্রতিটি ঝর্ণা, পাহাড়, খাল, নদী ও ছবির মত পাহাড়ি বাঙ্গালীর গ্রামগুলো যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা। লামায় বেড়ানোর জায়গার যেন শেষ নেই। উঁচু-নিচু পাহাড়ে ঘেরা লামার সবুজ প্রকৃতি নিমিষেই পর্যটকের মন কেড়ে নেয়। তাই দেরি না করে এখনই পরিকল্পনা করে ফেলুন আর ঘুরে আসুন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি লামা উপজেলায়। পর্যটকরা এই স্থান সমূহকে বিনোদন স্পট হিসেবে গড়ে তুলে ধরতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

লামা উপজেলার দৃষ্টিনন্দন স্থান সমূহ ঃ কেয়াং ঝিরি (হিমখোলা) ঝর্ণা, নুনারঝিরি ঝর্ণা, আইম্মারা ঝিরি ঝর্ণা, মিরিঞ্জা ঝর্ণা, মিজঝিরি ঝর্ণা, মাষ্টার পাড়া সূড়ং, মিরিঞ্জা পর্যটন, সুখিয়া-দুখিয়া ঘেরা মাতামুহুরী নদীর অববাহিকা, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন সরই, সাবেক বিলছড়ি বৌদ্ধ বিহার, লামা ভিউ পয়েন্ট, সৃজনশীল রাবার বাগান (ফাঁসিয়াখালী), আঁকা-বাঁকা লামা-চকরিয়া সড়ক, নৃ-গোষ্ঠী মার্মা-ত্রিপুরা-মুরুং দের জীবন বৈচিত্র।

১। কেয়াং ঝিরি (হিমখোলা) ঝর্ণা ঃ উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড বেগুনঝিরি এলাকায় কেয়াং ঝিরি ঝর্ণাটি অবস্থিত। স্থানীয়রা এই ঝর্ণাটিকে হিমখোলা ঝর্ণাও বলে। উপজেলা সদর হতে প্রথমে রিক্সা বা টমটম করে বিলছড়ি মিশনঘাট পৌঁছে মাতামুহুরী নদী পার হয়ে মেরাখোলা যেতে হবে। সেখান হতে স্থানীয় গাইড নিয়ে প্রায় ২ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পায়ে হেঁটে ঝর্ণাতে পৌঁছাতে হবে। যাওয়ার পথে সবুজ পাহাড় ও মাতামুহুরী নদীর সৌন্দর্য যে কোন মানুষকে আকৃষ্ট করবে।

২। নুনারঝিরি ঝর্ণা ঃ লামা সরকারি মাতামুহুরী কলেজের পশ্চিমপাশে নুনারঝিরি এলাকায় এই ঝর্ণাটি অবস্থিত। কলেজ সংলগ্ন মেইন রোড হতে নুনারঝিরি রাস্তা দিয়ে প্রথমে প্রায় ১ কিলোমিটার গাড়িতে ও তারপর আধা কিলোমিটার হেঁটে ঝর্ণাটি পৌঁছানো হবে। অবস্থানগত দিক থেকে এই ঝর্ণাটি সদর ইউনিয়নে ১নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। নুনারঝিরি ঝর্ণাটির কিছুটা উপরে আরো ২টি ঝর্ণা রয়েছে।

৩। আইম্মারা ঝিরি ঝর্ণা ঃ লামা বাজারের পশ্চিম পাশে দুখিয়া-সুখিয়া পাহাড়ের পাদদেশে এই ঝর্ণাটি অবস্থিত। অবস্থানগত দিক থেকে জায়গাটি সদর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডে পড়েছে। লামা বাজার নদীর ঘাট হতে নৌকা করে দুখিয়া পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে নেমে প্রায় আধা কিলোমিটার হেঁটে ঝর্ণাটিতে পৌঁছাতে হয়। বড় বড় পাথরের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত স্বচ্ছ পানি আপনাকে যে প্রশান্তি দেবে, তা সরজমিনে না গেলে বুঝিয়ে বলা অসম্ভব। বাহিরের পর্যটকরা যাওয়ার সময় গাইড বা নৌকার মাঝিকে সাথে নিলে ভাল হয়।

৪। মিজঝিরি ঝর্ণা ঃ আইম্মারা ঝিরি ঝর্ণা হতে মাতামুহুরী নদী হয়ে নৌকায় করে আরো ৩/৪ কিলোমিটার নিচে গেলে এই ঝর্ণাটির দেখা মিলবে। মিঝঝিরি ঝর্ণায় যেতে মাতামুহুরী নদীর বৈচিত্রময় সৌন্দর্য আপনাদের মুগ্ধ করবে। অবস্থানগত দিক থেকে ঝর্ণাটি গজালিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত।

৫। মিরিঞ্জা ঝর্ণা ঃ লামা-চকরিয়া সড়কে যাওয়া আসার পথে মিরিঞ্জা পাহাড়টির দেখা মিলবে। অবস্থানগত দিক থেকে সম্পূর্ণ পাহাড়টি ৩নং ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে অবস্থিত। অনেক বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে পাহাড়টির অবস্থান। মিরিঞ্জা পাহাড়ে ঐবক পাড়া, মিরিঞ্জা টপ, বাগান পাড়ার নিচে বেশ কয়েকটি ঝর্ণা দেখা যায়। বিশেষ করে বর্ষাকালে ঝর্ণা গুলো বেশী পরিলক্ষিত হয়। পাহাড়ে গাছ না থাকায় শুস্ক মৌসুমে ঝর্ণা গুলো তার চিরচেনা যৌবন হারায়। বিশাল বিশাল পাথরের বেস্টিত ঝর্ণা গুলো। যে সকল ভ্রমণ পিপাসু মানুষ চ্যালেঞ্জ নিয়ে ঘুরতে ভালবাসেন তাদের অধিক আনন্দ দিবে মিরিঞ্জার ঝর্ণা গুলো। বর্ষাকালে চকরিয়া হতে গাড়িতে করে লামায় আসার পথেও মিরিঞ্জা পাহাড়ের কয়েকটি ঝর্ণা আপনাদের দৃস্টিগোছর হবে।

৬। মাস্টার পাড়া সূড়ং ঃ রুপসীপাড়া ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড মাস্টার পাড়া এলাকায় জনৈক নূর আলমের পাহাড়ের মধ্যে এই সূড়ংটি অবস্থিত। এই সূড়ংটি এখনো মানুষের কাছে প্রায় অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। এমনকি স্থানীয় অনেকে জানেনা বিষয়টি। পাহাড়ের নিচ দিয়ে প্রায় ৫ ফুট প্রস্থ ও ২০০ ফুট লম্বা এই সূড়ংটি। কোন প্রকার যতœ না থাকায় পাহাড়ের মাটি চাপা পড়ে প্রবেশ পথটা কিছুটা ছোট হয়ে গেছে। হামাগুড়ি দিয়ে ভিতরে যাওয়া যায়। ৫/৬ ফুট ভিতরে গেলে তারপর জায়গাটা খোলামেলা। ভিতরে অসংখ্য বাদুর ও বড় বড় সাপ থাকতে পারে বলে স্থানীয়রা জানান।

৭। মিরিঞ্জা পর্যটন ঃ লামায় সরকারি পৃষ্টপোষকতায় পরিচালিত একমাত্র পর্যটন। লামা-চকরিয়া সড়কের মিরিঞ্জা টপ নামক স্থানে পর্যটনটি অবস্থিত। উপজেলা সদর হতে ৭ কিলোমিটার, চকরিয়া হতে ২২ কিলোমিটার দূরে ও সমুদ্র পৃষ্ট হতে প্রায় ২ হাজার ২৫০ ফুট উপরে এর অবস্থান। যেখানে দাঁড়িয়ে পাহাড়, সমুদ্র ও দিগন্ত একসাথে দেখা সম্ভব। যে কোন ধরনের যানবাহন দিয়ে মিরিঞ্জা পর্যটনে আসা যায়। আকাশের ভেলার মত ভাসমান মেঘ আপনাকে ঘিরে ধরবে। মিরিঞ্জায় দলবল নিয়ে রান্না করে খাওয়ার পাশাপাশি বনভোজন করার সু-ব্যবস্থা রয়েছে। পরিবার নিয়ে অনেকক্ষণ সময় কাটানোর মত একটি আদর্শ জায়গা। তবে খাওয়ার ব্যবস্থা নিজেরা করলে ভাল হয়।

৮। সুখিয়া-দুখিয়া ঘেরা মাতামুহুরী নদীর অববাহিকা ঃ নদী আর পাহাড়ের যে অপূর্ব সমন্বয় তা সুখিয়া-দুখিয়া ঘেরা মাতামুহুরী নদীর অববাহিকা না দেখলে কখনও বুঝা যাবেনা। মাতামুহুরী নদী পাহাড়ি খর¯্রােতের নদী হলেও এই অংশের পানি সবসময় স্থির। বর্ষায় ঘোলা ও শুস্ক মৌসুমে স্বচ্ছ পানি আপনাকে আকৃষ্ট করবে। এখানে ভ্রমনে নৌকায় একমাত্র বাহন হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। নদীর দু’পাশে পিকনিকের অসংখ্য স্পট রয়েছে।

৯। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন (সরই) ঃ অরণ্য রানী লামা বাংলাদেশের বিশাল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অবিনাশী আধার। নান্দনিক পাহাড়ী পথ আর নদীর চিরন্তন উৎস ভ্রমণ পিয়াসীদের মনে আনন্দের নাচন তোলে। লামার সরই ইউনিয়নের পাগলী খালের পাশে দুর্গম পাহাড়, ছায়াঘন বন-বনানী পরিবেষ্টিত অসংখ্য বন্য পশুপাখির বিচিত্র ডাকে মুখরিত এক স্থানে ১৯৮৯ সালে ১০ একর পাহাড়ী ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের শাখা।

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের আধ্যাত্মিক পুরুষ গুরুজী শহীদ আল বোখারী মহাজাতকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই শাখাটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রত্যন্ত ও দুর্গম পাহাড়ের ভাজে-ভাজে যেন বেজে ওঠে অন্য আরেক রোমাঞ্চকর মুর্ছনা। শুরু হয় পাহাড়ের নির্জন স্তব্ধতার মিছিলের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়ে মৌন-মহান অন্তরদর্শন অন্বেষার ধ্যান কর্মসুচি। আধ্যাত্মিক সাধনার স্থান হিসেবে গড়ে ওঠার কারণে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “বোধিছড়া”। মূল ভবনের দক্ষিণে রয়েছে ধ্যান করার জায়গা ও ভাস্কর্য। উত্তর পাহাড়ে রয়েছে আগন্তুক অতিথিদের থাকার জন্য ৩টি গেষ্ট হাউস।

এখানে পাহাড়ের অরণ্যচারী সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া ভূমি সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। হাজারো সামর্থ্যবান ও দানশীল অনুসারীগণ সহ সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় “কোয়ান্টাম কসমো স্কুল এন্ড কলেজ”। নান্দনিক সৌন্দর্যের কারনে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন একটি সমগ্র দেশের মানুষের কাছে জ্ঞান পিপাসার স্থানের পাশাপাশি পর্যটন স্থান হিসেবেও পরিচিত।

১০। সাবেক বিলছড়ি বৌদ্ধ বিহার ঃ প্রায় ১৫০ বছরের পুরাতন এই বৌদ্ধ বিহারটি কয়েক প্রজন্মের মানুষের কাছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে এখানে তিন ব্যাপী সাংগ্রাই মেলায় সারা দেশের বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের সাথে ভ্রমণ পিপাসু মানুষের ঢল নামে। লামা পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের সাবেক বিলছড়ি এলাকায় এই বৌদ্ধ বিহারটি অবস্থিত। লামা বাজার হতে সিএনজি, রিক্সা, টমটম বা নিজস্ব গাড়িতে করে ২০ মিনিটের মধ্য সেখানে যাওয়া সম্ভব।

১১। লামা ভিউ পয়েন্ট ঃ মিরিঞ্জা পাহাড়ের সর্বোচ্চ উচু হতে দাঁড়িয়ে লামা-আলীকদম উপজেলার দিকজোড়া দিগন্ত দেখা যায়। সেই স্থানটিকে লামা ভিউ পয়েন্ট হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।

১২। সৃজনশীল রাবার বাগান ঃ লামা উপজেলার সরই, ফাঁসিয়াখালী ও ফাইতং ইউনিয়নে বেশ কিছু ব্যক্তি মালিকানাধীন রাবার বাগান সৃজন হয়েছে। প্রতিটি বাগানের আয়তন প্রায় কয়েকশত একর হতে হাজার একর পর্যন্ত। ছোট ছোট পাহাড়ে রাশি রাশি গাছের সারি আপনাকে ক্ষণিক সময়ের জন্য হলেও আকৃষ্ট করবে। এছাড়া সকালে রাবার গাছ হতে কস সংগ্রহের দৃশ্য কল্পনার চেয়েও সুন্দর।

১৩। আঁকা-বাঁকা লামা-চকরিয়া সড়ক ঃ শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোন ছবি বলে মনে হবে এই সড়কটি। দুই লাইনের চকরিয়া-লামা সড়ক পাহাড়ের অকৃত্তিম রুপ আপনার সকল তুলে ধরে মুহুর্তে মনের সকল জরা দূর করে আপনাকে চাঙ্গা করে তুলবে।

১৪। নৃ-গোষ্ঠী মার্মা-ত্রিপুরা-মুরুং দের জীবন বৈচিত্র ঃ পাহাড়ের সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত আরেক বিস্ময়। প্রতিটি নৃ-গোষ্ঠীর জীবন যাত্রা ভিন্ন। সকলের আলাদা ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবন ধারনের চিত্র আপনাদের বিস্মিত করবে।

ভ্রমণ পিপাসুদের লামায় অবস্থানকালে রাত্রী যাপনের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি মানসম্মত আবাসিক হোটেল। হোটেল সী-হিল, হোটেল মিরিঞ্জা, হোটেল প্রিজন, জেলা পরিষদ গেস্ট হাউজ ও একতা মহিলা সমিতি ডরমেটরী। যেখানে খুব স্বল্প খরচে ভাল থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া উন্নতমানের খাবারের বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে কুটুমবাড়ি রেস্টুরেন্ট, হোটেল মেহমান, হোটেল জব্বারিয়া, হোটেল মধুবন, হোটেল আমিরাবাদ ও বিছমিল্লাহ ভাতঘর।

পাঠকের মতামত: