নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :: চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনা থামছে না। একের পর এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে সকলকে। শুধুমাত্র একদিনের ব্যবধানে দুর্ঘটনায় অকালেই ঝরে গেছে চার নারীসহ ১১ জনের প্রাণ। আহত হয়েছে শিশু, নারীসহ ১৪ জন। যেন মৃত্যু ফাঁদ হয়ে উঠেছে দেশের দক্ষিণ প্রান্তের ব্যস্ততম চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক। যে সড়ক দিয়ে প্রতিদিন দেশি–বিদেশি পর্যটকসহ হাজার হাজার যাত্রী–সাধারণ যাতায়াত করে থাকেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকার মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন চলাচল একেবারে নিষিদ্ধ করলেও তা মানছেন না সংশ্লিষ্টরা। সরকারের নেওয়া এই সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে স্থানীয় হাইওয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করে মহাসড়কে চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে সিএনজি চালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক টমটম, মাহিন্দ্রসহ আরো হরেক রকমের ত্রি–হুইলার বাহন। এমনকি লেগুনা–ছারপোকার মতো ৪ চাকার ছোট যানবাহনগুলো মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ হলেও পাল্লা দিয়েই যাত্রী আনা–নেওয়া করছে প্রতিদিন।
অভিযোগ রয়েছে, মহাসড়কে এ ধরনের ছোট যানবাহন চলাচল একেবারে নিষিদ্ধ এবং আইন অমান্য করলে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে সরকারের। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য মহাসড়কের নিরাপত্তায় নিয়োজিত হাইওয়ে পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু নানা কারণে এই নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারছে না হাইওয়ে পুলিশ। প্রতিদিন মহাসড়কে এ ধরনের যানবাহন চলাচল করছে। মূলত ছোট যানবাহনগুলো মহাসড়কে উঠার কারণেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে প্রতিনিয়িত। আবার কেউ কেউ মহাসড়কের ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকগুলোকে (মোড় বা টার্নিং) এই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন। গতকাল বুধবার সকাল পৌনে ১১টার দিকে ভারী বর্ষণ হচ্ছিল। এ সময় মহাসড়কের চকরিয়ার বরইতলী নতুন রাস্তার মাথা থেকে যাত্রীবোঝাই করে হারবাংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ব্যাটারি চালিত একটি ইজিবাইক টমটম। এটি হারবাং স্টেশনের কাছে ইনানী রিসোর্টের সামনে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকে পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা প্রাণ–আরএফএল গ্রুপের পণ্যবাহী দ্রুতগামী
একটি কাভার্ড ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলে দুইজনসহ মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় চারজন নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে এক নারীও ছিলেন। আহত হন শিশুসহ আরো চার যাত্রী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রসঙ্গে স্থানীয় কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ব্যাটারি চালিত তিন চাকার ইজিবাইক টমটমটি যিনি চালাচ্ছিলেন মূলত তিনি একজন রিকশা চালক। রিকশা বাদ দিয়ে টমটম চালাচ্ছেন কয়েক মাস আগে থেকে। মহাসড়কে গাড়ি চালনার কোন প্রশিক্ষণ তার নেই। তাছাড়া টমটমটি যখন ইনানী রিসোর্টের সামনে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকে পৌঁছে তখনই চালক নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং বিপরীত দিক থেকে আসা কাভার্ড ভ্যানের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে পতিত হয়। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
একইভাবে গত মঙ্গলবারের ভয়াবহ দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বরইতলী নতুন রাস্তার মাথা এলাকার মামুনুর রশীদ নামের এক ব্যক্তি জানান, মহাসড়কে চার চাকার ছারপোকা গাড়ি নিষিদ্ধ থাকলেও রহস্যজনক কারণে এসব গাড়ি প্রতিদিন চলাচল করছে। একইভাবে মঙ্গলবার পৌনে বারোটার দিকে যাত্রীবোঝাই করে চিরিঙ্গা থেকে লোহাগাড়ার দিকে বেপরোয়াভাবে যাচ্ছিল ছারপোকা গাড়িটি। পথিমধ্যে বরইতলী নতুন রাস্তার মাথায় ছারপোকা গাড়িটি পৌঁছলে বিপরীত দিক থেকে বেপরোয়াভাবে আসা স্টার লাইন পরিবহনের যাত্রীবাহী অপর একটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ছারপোকা গাড়িটি দুমড়ে–মুচড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলে কয়েকজন এবং তিন নারীসহ ছারপোকার সাতজন যাত্রী নিহত হন। আহত হন দুই গাড়ির অন্তত ১০ জন যাত্রী।
মহাসড়ক লাগোয়া স্থানীয় কয়েকজন সচেতন বাসিন্দা জানান, চট্টগ্রাম–কঙবাজার মহাসড়কের চকরিয়ার ২৯ কিলোমিটার অংশের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য নিয়োজিত রয়েছে বানিয়ারছড়াস্থ চিরিঙ্গা এবং মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি। এছাড়াও চিরিঙ্গা সদরের জন্য রয়েছে থানা ট্রাফিক সার্জেন্টের নেতৃত্বে পুলিশ। কিন্তু হাইওয়ে পুলিশের সংশ্লিষ্টরা অর্থপূর্ণ উদারতায় দায়সারা দায়িত্ব পালন এবং সরকারের নির্দেশনা যথাযথভাবে পরিপালন না করায় মহাসড়কে ছোট ছোট যানবাহনগুলো চলাচল করছে।
তাদের অভিযোগ, ফাঁড়ির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মহাসড়কে ছোট যানবাহনগুলো চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ করলেও অধস্তন কর্মকর্তারা অনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করেন। তা না হলে সরকারের কঠোর নির্দেশনা সত্ত্বেও কিভাবে ছোট যানবাহনগুলো মহাসড়কে উঠতে পারে। এজন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
এ ব্যাপারে বানিয়ারছড়াস্থ চিরিঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ও সার্জেন্ট নূর–এ আলম পলাশ বলেন, ‘সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক মহাসড়কে যাতে তিন ও চার চাকার ছোট যানবাহনগুলো উঠতে না পারে সেজন্য আমাদের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। অতি সম্প্রতি সরকারের কঠোর নির্দেশনার পর হাইওয়ে পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে।’
তাহলে গতকাল কিভাবে ব্যাটারি চালিত তিন চাকার ইজিবাইক টমটম মহাসড়কে দুর্ঘটনার শিকার হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে নূর–এ আলম বলেন, ‘মহাসড়ক লাগোয়া অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সড়ক–উপ–সড়ক রয়েছে। সেই সড়ক দিয়ে এসে হুট করে মহাসড়কে উঠে পড়ে এসব যানবাহন। আর এতেই দুর্ঘটনা ঘটছে।’
এ নিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের জনবল একেবারে স্বল্প সংখ্যক। তাই মহাসড়কের এই বিশাল অংশের পুরোটাই একচোখে পাহারা দেওয়াটা বেশ কষ্টকর। আর এর সুযোগ নিচ্ছে তিন ও চার চাকার ছোট ছোট যানবাহনগুলো। তবে এ থেকে পরিত্রাণ পেতে আরো বেশি কঠোর হবো আমরা। যাতে কোন অবস্থাতেই এ ধরণের যানবাহন মহাসড়কে উঠতেই না পারে।’
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) চকরিয়া শাখার সভাপতি সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘একদিনের ব্যবধানে পর পর দুটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসগুলো যেমন বেপরোয়া, তেমনিভাবে নিষিদ্ধ হলেও ৩ ও ৪ চাকার ছোট যানবাহনগুলো অবাধে চলাচল করছে মহাসড়কে।’
তিনি অভিযোগ করেন, সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত হাইওয়ে পুলিশ কঠোরভাবে পালন না করায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এজন্য সংশ্লিষ্টদের আরো কঠোর হতে হবে এবং যাত্রী–সাধারণকেও বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে। পাশাপাশি তিন ও চার চাকার নিষিদ্ধ ছোট যানবাহনগুলোর চালকসহ সংশ্লিষ্টদের সরকারের নির্দেশ মানতে হবে। তবেই পরিত্রাণ পাওয়া যাবে এই দুর্ঘটনা থেকে। তা না হলে মহাসড়কে এভাবেই চলতে থাকবে নৈরাজ্য।
এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান পর পর দুটি ভয়াবহ দুর্ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘মহাসড়কের চকরিয়ায় এ ধরণের দুর্ঘটনার কারণ বের করতে ইতোমধ্যে ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খোন্দকার মো. ইখতিয়ার উদ্দীন আরাফাতকে কমিটর প্রধান করা হয়েছে। এছাড়াও কমিটিতে স্বাস্থ্য বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্টদের সদস্য করা হয়েছে। এই কমিটি খুব অল্প সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেবে।’
পাঠকের মতামত: