ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

ইয়াবা-পুলিশ বেরিয়ে আসছে একে একে

বিশেষ প্রতিনিধি ::

ইয়াবাপাচারে ওতপ্রোতভাতে জড়িয়ে যাচ্ছে পুলিশ। বিষয়টি অনেকটা উদ্বেগের। গুটিকয়েক সদস্যের অপকর্মের ভার নিতে হচ্ছে পুরো পুলিশ বিভাগকে। এবার ইয়াবা বিক্রির অভিযোগ নগর গোয়েন্দা পুলিশের বিরুদ্ধে। নগরীর লালদিঘি পাড়ের একটি আবাসিক হোটেলে অভিযান চালায় কোতোয়ালী থানা পুলিশ। এসময় ইয়াবাসহ তিন ব্যক্তি হাতেনাতে ধরা পড়ে। এদের মধ্যে একজন পুলিশ কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম। এ ব্যাপারে গত ৩১ আগস্ট উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. নুরুজ্জামান বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কনস্টেবল জহির জানান, ইয়াবাগুলো নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আবদুল ওয়াদুদের। বিষয়টি অনেকটা গোপন রাখতে মামলায় তাদের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে। একইদিনে মিরসরাইয়ে একটি মিনি পিকআপ থেকে ২৯ হাজার ২৮৫ পিস ইয়াবাসহ চালক ও হেলপারকে

গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৭। গ্রেপ্তার দুইজন জানিয়েছিলেন ওই ইয়াবার মালিক নগর পুলিশ লাইনে থাকা এসআই বদরুদ্দোজা মাসুদ। পরে বদরুদ্দোজাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ এএসআই ওয়াদুদ এখনো বহাল তবিয়তে কর্মস্থলে রয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে নগর গোয়েন্দা পুলিশে কর্মরত থাকা এএসআই ওয়াদুদ মাঝখানে বদলি হয়েছিলেন কক্সবাজার জেলা পুলিশে। ১৩ দিনের মাথায় তদবির করে বদলি হয়ে ফের চলে আসেন নগর গোয়েন্দা বিভাগে।
শুধু আবদুল ওয়াদুদ নন, এভাবে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন পুলিশের একাধিক সদস্য। গত এক বছরে অন্তত দশ পুলিশ সদস্য ইয়াবা বিক্রির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে উদ্ধার করা ইয়াবা জব্দ তালিকায় কম দেখিয়ে আত্মসাৎ করেন পুলিশ সদস্যরা। এরপর আত্মসাৎ করা ইয়াবা মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে পুনরায় বিক্রি করেন তারা। পুলিশের অনেকে মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকলেও পুলিশ পরিচিতির কারণে থেকে যান ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। মাদক প্রতিরোধের দায়িত্ব যাদের, তাদের মাদক ব্যবসায় লিপ্ত হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগের বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মাহবুবর রহমান বলেন, সিএমপিতে যোগ দিয়েছি তিনমাস আগে। ইয়াবার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গত তিনমাসে তিনজন পুলিশ সদস্যকে হাতকড়া পরিয়েছি। কোনো কাজে পুলিশ ব্যর্থ হতে পারে, কিন্তু ইয়াবার সাতে জড়িত থাকতে পারে না। যে পুলিশ ইয়াবার সাথে জড়িত সে আমার নয়। ইয়াবা ব্যবসা করতে ইচ্ছে হলে চাকুরি ছেড়ে দিতে হবে। যেই হোক কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া আর যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে।
গত ৩১ আগস্ট শুক্রবার রাতে নগরের লালদিঘির পশ্চিম পাড়ে পুরাতন গীর্জা লেনের হোটেল আল ফালাহ-এর ৫ম তলার ৪০১ নম্বর কক্ষ থেকে ৮০০ পিস ইয়াবাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা হলেন : জহিরুল ইসলাম, পলাশ ভট্টাচার্য ও আনোয়ার হোসেন শাহিন। এদের মধ্যে জহিরুল ইসলাম চট্টগ্রাম আদালতে কর্মরত। নগর গোয়েন্দা পুলিশ থেকে বদলি হয়ে দুই তিনমাস আগে আদালতে পোস্টিং হয় জহিরের। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কনস্টেবল জহির জানান, বিক্রির জন্য ইয়াবাগুলো তার কাছে রেখেছেন ওয়াদুদ। এই আবদুল ওয়াদুদ নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই)। গোয়েন্দা পুলিশের তিন নম্বর বিশেষ টিমে কর্মরত। এ ঘটনায় একই দিন রাতে কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেছেন অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া বক্সিরহাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মো. নুরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী মাদক বিক্রির জন্য জড়ো হয়েছেন সংবাদ পেয়ে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে তিনজনকে ইয়াবাসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে জহির জানিয়েছেন ইয়াবাগুলো ওয়াদুদ নামে একজনের। ওয়াদুদ তাকে বিক্রি করতে দিয়েছেন।
গত ৩১ আগস্ট শুক্রবার রাতে মিরসরাইয়ের নিজামপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বাসার ফার্নিচার বহনকারী একটি ট্রাকের ফাইল কেবিনেট থেকে ২৯ হাজার ২৮৫টি ইয়াবা উদ্ধার করে র‌্যাব। ওই কেবিনেট থেকে ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ থেকে চট্টগ্রাম নগর পুলিশে বদলি হয়ে আসা এসআই বদরুদ্দোজার নাম, বিপি নম্বর ও মোবাইল নম্বরসহ সিল লাগানো একটি ডায়েরি উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ট্রাকটির চালক ও সহকারীকে গ্রেপ্তারের পরদিন এসআই বদরুদ্দোজাকেও গ্রেপ্তার করে মিরসরাই থানা পুলিশ। মিরসরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইরুল ইসলাম বলেন, ‘ইয়াবা উদ্ধারের পর থেকে এসআই বদরুদ্দোজাকে খুলশী থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। আমরা প্রাথমিকভাবে ইয়াবা পাচারের সাথে তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছি।’
গত ১৮ আগস্ট কক্সবাজার থেকে মোটরসাইকেলে ইয়াবা নিয়ে যাওয়ার সময় মিরসরাইয়ের বারৈয়ারহাট এলাকা থেকে ৩১ হাজার ৮০০ ইয়াবাসহ এএসআই আবুল বাশারকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। আবুল বাশার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা গোয়েন্দা পুলিশে কর্মরত ছিলেন।
গত ৩১ মার্চ বিকালে নগরের আগ্রাবাদ লাকী প্লাজার পশ্চিম পাশে জ্যোতি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে থেকে সিএনজি অটোরিকশাসহ নুরুচ্ছফা মামুন ও সাইফুল কবির শাকিল নামে দুইজনকে গ্রেপ্তার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এদের মধ্যে নুরুচ্ছফা মামুন সিএনজি ট্যাক্সি চালক। ট্যাক্সিচালকের সিটের নিচ থেকে তিন হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার দু’জনই জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ কনস্টেবল কামরুজ্জামান কামরুলের কাছ থেকে ইয়াবা কিনে নিয়ে নগরের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে তারা। তিনজনের বিরুদ্ধেই নগরের ডবলমুরিং থানায় মামলা দায়ের করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। গত ২ এপ্রিল বিকালে এ মামলায় পুলিশ কনস্টেবল কামরুজ্জামান কামরুলকে গ্রেপ্তারও করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। কামরুজ্জামান কামরুল নগরের দামপাড়া পুলিশ লাইনে কর্মরত। পুলিশ লাইনে বসেই ইয়াবা বিক্রি করতেন কামরুল।
গত ৩০ জুলাই রাতে নগরের পশ্চিম বাকলিয়ার তুলাতলী হাফেজনগর এলাকার হাজী গোফরান উদ্দিন মুন্সীর বাড়িতে অভিযান চালায় র‌্যাব। ওই বাড়ির নিচ তলার একটি বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন বাকলিয়া থানার চাক্তাই ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই খন্দকার সাইফ উদ্দীন।
র‌্যাব-৭ এর সহকারী পরিচালক এএসপি মিমতানুর রহমান জানান, বাসাটি থেকে ১৪ হাজার ১০০ ইয়াবা উদ্ধার এবং বাড়ির মালিকের ছেলে মিল্লাতকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া বাসা থেকে এসআই সাইফের ব্যবহার করা পুলিশের পোশাক, হ্যান্ডকাপের কভারসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও বই উদ্ধার করা হয়েছিল। এ ঘটনার পর তাকে বরখাস্ত করা হয়। মামলা দায়ের হওয়ার পর থেকে পলাতক রয়েছেন সাইফ। তাকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
গত ১২ জুলাই নগরের চান্দগাঁও থানার বহদ্দারহাট বারইপাড়া এলাকা থেকে ইয়াবাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এদের মধ্যে একজন পুলিশের সাময়িক বরখাস্ত হওয়া এএসআই রিদওয়ান। ২০১৬ সালের ২৬ নভেম্বর নগরের নিউমার্কেট মোড় থেকে ইয়াবাসহ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। ২০১৭ সালের ২৮ নভেম্বর নগরের কর্ণফুলী থানার মইজ্জ্যারটেক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিটের (ডিবি) সহকারী উপ-পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন। তার কাছ থেকে এক হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। একই বছরের ২৬ আগস্ট নগরের ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ চৌমুহনী এলাকা থেকে এসআই আফাজ উল্যাহ ও তার দুই সহযোগী মো. খোরশেদ আলম ও শহীদ উল্লাহকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। নগরীর হালিশহর থানায় কর্মরত ছিলেন এসআই আফাজ।

পাঠকের মতামত: