ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

চকরিয়ায় পাহাড়ে ২০ হাজার পরিবারের ঝুঁকিতে বসবাস

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :
কক্সবাজারের চকরিয়ায় পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করছে অন্তত লাখো মানুষ। এসব পাহাড়ে কম করে হলেও ২০ হাজার ঝুঁকিপূণ বসতি রয়েছে। ভারি বর্ষণে যে কোন সময় ভয়াবহ পাহাড় ধস এবং ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। কোথাও উঁচু পাহাড়ের টিলায় এবং পাদদেশে বসতি স্থাপন করে চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন এসব পরিবার।
উপজেলার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের বাসিন্দা সাঈদুল হক চৌধুরী জানান, বর্ষা মৌসুমের প্রথমদফার লাগাতার ভারী বর্ষণে বার আউলিয়া নগর গ্রামে অসংখ্য পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব পাহাড়ের পাদদেশ বা উঁচুতে কোন বসতি না থাকায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। অবশ্য পাহাড় ধসে পড়ার ঘটনায় এলাকার মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এর পরও পাহাড়ের উঁচুতে এবং পাদদেশে বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করা অন্তত তিন শতাধিক পরিবার চরম ঝুঁকির মধ্যেই রয়েছে। তাদেরকে সরিয়ে না নিলে যে কোন মুহূর্তে বড় ধরণের বিপর্যয় ঘটতে পারে।
এ বিষয়ে লক্ষ্যারচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা কাইছার বলেন, ‘পাহাড় ঘেরা বার আউলিয়া নগর গ্রামটি কাকারা ইউনিয়নেরই অংশ। তবে সেখানে লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের কয়েকশ ভোটার পরিবার-পরিজন নিয়ে পাহাড়ি জায়গায় বসতি নির্মাণ করে রয়েছেন। এসব পরিবারকে অনেক আগে থেকেই তাগাদা দেওয়া হয়েছে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে দূরে থাকতে, কিন্তু কে শোনে কার কথা। বিষয়টি ইতিমধ্যে আমি উপজেলা পরিষদের মাসিক আইন-শৃঙ্খলা ও সমন্বয় সভায় উত্থাপন করেছি।’
কৈয়ারবিল ইউনিয়নের ইসলাম নগর গ্রামের মোহাম্মদ ইলিয়াছ জানান, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক লাগোয়া ইসলাম নগর নামের পুরো গ্রামটিতে পাহাড় আর পাহাড়। সংরক্ষিত বনভূমির এসব পাহাড়ে লোক সমাগম ঘটে বিগত ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় হ্যারিকেন কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানার পর। এর পর থেকে এখানে পাহাড়ের ওপর এবং পাদদেশে ব্যাপক সংখ্যক বসতি গড়ে উঠে। কিন্তু যেভাবে চারিদিকে ভয়াবহ পাহাড় ধস এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে তা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এখন ঘোর বর্ষাকাল, এই সময় লাগাতার ভারী বর্ষণ শুরু হলে ইসলাম নগর পাহাড়ি এলাকায়ও পাহাড় ধসের মতো বড় ধরণের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
কৈয়ারবিল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মক্কী ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের ইসলাম নগর পাহাড়ি এলাকায় কম করে হলেও দুই হাজার বসতি রয়েছে। সেখানে চরম ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের উুঁচ-নিচু টিলা এবং পাদদেশে বসবাস করছে প্রায় তিন হাজার মানুষ। পাহাড়ে বসবাসে চরম ঝুঁকি থাকলেও মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় এসব মানুষ পাহাড় ছাড়তে চাচ্ছেন না। তাদেরকে ইতিমধ্যে অনেকবার সতর্ক করা হয়েছে। পাশাপাশি এসব বিষয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও অবহিত করা হয়েছে।’
ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. নুরুল আমিন জানান, ডুলাহাজারা ইউনিয়নের বেশির ভাগ এলাকাই পাহাড়ি। সেখানে যুগ যুগ ধরে বসবাস করছে এখানকার মানুষ। এখানে পাহাড় ধসের তেমন ভয় না থাকলেও রয়েছে বড় বড় গাছ পড়ে প্রাণহানির আশঙ্কা। এর পরেও যেসব এলাকার মানুষ চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পাহাড়ের উঁচুতে এবং পাদদেশে বসবাস করছেন তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে।
একইভাবে খুটাখালী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামও পাহাড় বেষ্টিত। সেখানেও ব্যাপক ঝুঁকির মুখে পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করছেন অন্তত ১০ হাজার মানুষ। এ বিষয়ে খুটাখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুর রহমান জানান, সম্প্রতি পার্বত্যাঞ্চলে ভয়াবহ পাহাড় ধস এবং ব্যাপক সংখ্যক প্রাণহানির ঘটনার পর স্থানীয় চৌকিদারদের মাধ্যমে খুটাখালী ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী লোকজনকে দফায় দফায় সতর্ক করা হয়েছে। প্রয়োজনে তাদেরকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
বরইতলী ইউনিয়নের পহরচাঁদা গ্রামের গিয়াস উদ্দিন আজম জানান, বরইতলী ইউনিয়নের পহরচাঁদাসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম বড় বড় পাহাড় বেষ্টিত। পাহাড়ের ঢালু, উঁচু টিলা ও পাদদেশে ব্যাপক বসতি রয়েছে এখানে। তাছাড়া এসব গ্রামে চলছে ব্যাপকভাবে পাহাড় নিধন। এই অবস্থায় লাগাতার ভারী বর্ষণ শুরু হলে বড় ধরণের বিপর্যয় ঘটবে এখানে।
বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জালাল আহমদ সিকদার বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের এক তৃতীয়াংশ মানুষ পাহাড়ে বসবাস করেন। পাহাড়ে বসবাস যে ঝুঁকিপূর্ণ তা জানার পরও এখানকার মানুষেরা এসব জায়গা ছাড়তে নারাজ। প্রয়োজনে তারা মরতে পারবেন, এরপরও কোন অবস্থাতেই ঝুঁকিপূর্ণ হলেও পাহাড় ছাড়বেন না। এই অবস্থায় ঝুঁকির মধ্যে বসবাসকারী অন্তত ১০ হাজার মানুষকে পাহাড় ধস এবং প্রাণহানির বিষয়টি জানানোর মাধ্যমে সতর্ক করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসনকেও এসব বিষয় অবহিত করেছি।’
বিএমচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বিএমচর ইউনিয়নের সিংহভাগ গ্রামই বড় বড় পাহাড়ে ঘেরা। এসব পাহাড় ব্যক্তি মালিকানাধীনও। পাহাড় বেষ্টিত এসব গ্রামে কম করে হলেও বসবাস করছে ১৫ হাজার মানুষ। তন্মধ্যে বড় বড় পাহাড়ের উঁচুতে অবস্থান করায় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন হাজারো পরিবার। কিন্তু পাদদেশ থেকে উপরে উঠার মতো তেমন কোন সুযোগ না থাকায় চলাফেরা করতে হয় চরম ঝুঁকিতে। তার উপর ভারী বর্ষণ শুরু হলে চলাফেরা তো বন্ধ থাকে, কোনভাবেই যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয় না। এই অবস্থায় ভয়াবহ পাহাড় ধস হলে বড় ধরণের বিপর্যয়ের সম্মুখিন হতে হবে এখানকার বাসিন্দাদের।’
সরজমিন উপজেলার পাহাড় বেষ্টিত বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, পাহাড়ি এসব গ্রামে চলাচলের জন্য ইট বা কার্পেটিং কোন ধরণের সড়ক নেই। বৃষ্টি হলেও মারাত্মকভাবে পিচ্ছিল হয়ে উঠে পাহাড়ি এসব রাস্তা। তাছাড়া উঁচু পাহাড়ে বসবাসকারী লোকজন উঠা-নামা করার সময় পড়ে গিয়ে হাত-পা ভেঙে যায়। এই অবস্থায় লাগাতার ভারী বর্ষণ শুরু হলে বন্দি থাকা ছাড়া কোন উপায়ান্তর নেই বলে জানালেন বসবাসকারী অনেকে।
বিএমচর পাহাড়িয়া পাড়ার গৃহবধূ তসলিমা বেগম বলেন, ‘আমাদের বাড়ি ভিটে পাহাড়ের ওপরে হলেও এখানে টিউবওয়েল নেই। তা প্রতিদিন একশ ফুট নিচে গিয়ে টিউবওয়েল থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করে আনতে হয়। অন্যান্য সময় তেমন সমস্যা না হলেও বর্ষা মৌসুমে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে পড়ায় নিচ থেকে পানি আনতে কি যে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।’
কাকারার বারআউলিয়া নগর গ্রামের দিনমজুর জামাল উদ্দিন বলেন, ‘বিকল্প কোন জায়গা না থাকায় ঝুঁকি হলেও পাহাড়ের উঁচু টিলাতে বসবাস করতে হচ্ছে পরিবার-পরিজন নিয়ে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার হারবাং, বরইতলী, কৈয়ারবিল, লক্ষ্যারচর, কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, বমু বিলছড়ি, ফাঁসিয়াখালী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী, বিএমচর ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের অন্তত লক্ষাধিক মানুষ পাহাড়ি এলাকায় চরম ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশ্রাব আহমেদ বলেন, ‘চকরিয়ার বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং অবৈধভাবে বসবাসকারীদের বিরুদ্ধে শীঘ্রই অভিযান পরিচালনা করা হবে। ইতোপূর্বেও এখানকার অনেক এলাকায় পাহাড় নিধনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে মামলা দেওয়া হয়েছে এবং জরিমানাও আদায় করা হয়েছে। যেসব এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রয়েছে তাদের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে যৌথ অভিযান চালানো হবে। লাগাতার ভারী বর্ষণের সময় কাটা পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে যায়। এতে একসময় পাহাড় ধসে পড়ে। সামনে ভারী বর্ষণ হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।’ বিশেষ করে পাহাড় নিধনকারীদের একটি তালিকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চকরিয়াকে দেওয়া হয়েছে। ওই তালিকা অনুযায়ী পূণরায় অভিয়ান চালানো হবে।
এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরুদ্দিন মো: শিবলী নোমান বলেন, ‘উপজেলার যেসব ইউনিয়নগুলোতে পাহাড়ি এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে মানুষ বসবাস করছে তাদেরকে স্ব স্ব ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে সতর্ক করা হয়েছে। এর পরেও যেসব এলাকা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ তা শনাক্ত করে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেওয়া হবে।’ তিনি আরো বলেন, যারা পাহাড় নিধন করে তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পাঠকের মতামত: