ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

মানবপাচার আইন বিষয়ক কর্মশালায় অভিমত: আইনের ফাঁকফুকরে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়

বিশেষ প্রতিবেদক :আমাদের দেশে আইনের ফাঁকফুকরে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। মামলার দীর্ঘসুত্রিতায় বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হয়। সাক্ষি সুরক্ষা আইন না থাকায় সাক্ষিদের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগতে হয়। অনেক অপরাধের মামলা হয়না। মামলা হলে বিচার হয়না। বিচার হলে সাজা কার্যকর হয়না।
কক্সবাজারের গণমাধ্যমকর্মীদের নিয়ে ইয়ং পাওয়ার ইন সোস্যাল এ্যাকশান-(ইপসা) আয়েজিত মানবপাচার আইন সংক্রান্ত কর্মশালায় এসব কথা ওঠে আসে।
সভায় বলা হয়- দারিদ্রতা, সরকারিভাবে বিদেশে ভালো চাকরির সুযোগ কম হওয়া, মালয়েশিয়া ইস্যুতে জিটুজি বা অন্যান্য চুক্তির কার্যকরিতা না থাকা, ভিসার অধিক দাম, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারির অভাব ও মানুষের সচেতনতার অভাবে বিদেশে যেতে এই ঝুঁকিপূর্ণ পথকে বরাবরই উৎসাহিত করছে।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রচুরসংখ্যক শ্রমিক বিদেশে যাচ্ছে। কিন্তু তৃণমূলে অভিবাসী সেবাদানকারী নির্ভরযোগ্য কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকায় সঠিক তথ্য ও সহযোগিতা পেতে বিদেশগামীদের প্রায়ই মধ্যস্বত্বভোগীর উপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। পাচারকারীরা মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগে সর্বনাশ করতে দ্বিধাবোধ করে না।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএম এর সহযোগিতায় রবিবার (২৬ আগষ্ট) সকালে কক্সবাজার কেন্দ্রীয় বাসটার্মিনাল সংলগ্ন হর্টিকালচার সেন্টারের কনফারেন্স হলে সভায় মূখ্য আলোচক ছিলেন সিলেট আদালতের সহকারী জজ কক্সবাজারের রামুর কৃতি সন্তান শরীফুল হক।
তিনি বলেন, ‘মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২’ এর সংশোধিত ‘মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন বিধিমালা-২০১৭’ দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী একটি আইন। এ আইনের তেমন দুর্বলতা খোঁজে পাওয়া যায়নি। তবে অনেক আইনের ফাঁকফুকরের সুযোগে অপরাধীরা খালাস পেয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে যায়। এমনকি আসামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ায় সাক্ষিকে হত্যা করা হয়।
তিনি বলেন, কোন ভিকটিমের ছবি প্রকাশ করা যবেনা। এমন সংবাদ প্রকাশ করতে নেই যাতে ভিকটিমের মানসম্মানে আঘাত আসে। আইন মেনে সাংবাদিকতা করতে হবে।
সভায় মাল্টিমিডিয়া প্রেন্টেশনের মাধ্যমে মানবপাচারের ধরণ, কৌশল ও প্রতিকার ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন আইওএম এর ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার মাইকেল মন্ডল।
বক্তব্য রাখেন- আইওএম-এর কাউন্টার ট্রাফিকিং অফিসার এমি-এ নুরমিলা এস জারিজুনু, ইপসার উপপরিচালক খালেদা বেগম, প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর রজত বড়–য়া, জিশু বড়–য়া। সার্বিক তত্ত্বাবধান করেন কোঅর্ডিনেটর ওমর সাদেক।
মানবপাচারের সংজ্ঞায় বলা হয়- ভয় দেখিয়ে বা জোর করে অথবা কোনোভাবে জুলুম করে, হরণ করে, প্রতারণা করে, ছলনা করে, মিথ্যাচার করে, ভুল বুঝিয়ে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে, দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, অথবা যার উপরে কর্তৃত্ব আছে পয়সা বা সুযোগ-সুবিধার লেনদেনের মাধ্যমে তার সম্মতি আদায় করে শোষণ করার উদ্দেশ্যে কাউকে সংগ্রহ করা, স্থানান্তরিত করা, হাতবদল করা, আটকে রাখা বা নেওয়া।
নানাবিধ কারণে মানুষ নানাভাবে পাচারের শিকার হচ্ছে। চাকরির প্রলোভন, উন্নত জীবনের স্বপ্ন, নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা বা বসবাসের ভালো পরিবেশ দেওয়ার কথা বলে একশ্রেণির মানুষ এই ছলচাতুরি করে পাচারের সুযোগ নেয়।
মানবপাচারের ভয়াল এই থাবা থেকে বাংলাদেশও কোনোভাবে নিরাপদ নয়। আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর প্রচুরসংখ্যক মানুষ পাচারের শিকার হচ্ছে। কেউ বা পাচার হয়ে কিছুদিন পরে ফিরে আসছে, আবার কেউ চিরদিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে রয়েছে। অনেক সময় সামাজিক লোকলজ্জার ভয়েও পাচারের শিকারের পরিবার ঘটনাটি জানায় না।
প্রতিবছর কত মানুষ পাচারের শিকার হচ্ছে তার সঠিক তথ্য-উপাত্ত না থাকলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গত ৩০ বছরে প্রায় এক মিলিয়ন (বা ১০ লাখ) মানুষ বাংলাদেশ থেকে পাচারের শিকার হয়েছে।
আমাদের দেশ থেকে সীমান্তপথে ভারতে অথবা সাগরপথে মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে নিয়মিত পাচার হচ্ছে। মূলতঃ নারী ও শিশুরা বেশি সংখ্যায় পাচারের শিকার হচ্ছে। কারণ, আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থার আলোকে তারা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে বরাবরই স্বীকৃত। সাম্প্রতিককালে বিদেশে চাকরি দেওয়ার নামেও পাচারকারীরা নতুনভাবে এই ঘৃণ্য অপকর্মটি করে যাচ্ছে যা থামানো দরকার।
অপর্যাপ্ত বা ভুল তথ্য ও দালালের মিথ্যা আশ্বাসে পড়ে মানুষ যেমন বিভ্রান্ত হয়, তেমনি আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। নিরাপদ শ্রম অভিবাসন নিশ্চিতকরণে মানুষের দোরগোড়ায় সেবা নিশ্চিত করতে হলে তৃণমূল পর্যায়ে সঠিক সেবাদানকারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।
জানা যায়, অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষকে প্রলোভন দিয়ে একশ্রেণির অসাধু মানবপাচারকারী সাগরপথে মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাচ্ছে। আবার অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কেউবা ভূমধ্যসাগর বা অনুমোদিত নয় এমন ঝুঁকিপূর্ণ পথে ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে অর্থ ও জীবন দুটিই হারাচ্ছে।
সভায় বক্তারা বলেন- মানবপাচার রোধে প্রথমে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সর্বশক্তি দিয়ে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। সবার সদিচ্ছা আর সম্মিলিত উদ্যোগ মানব পাচারের মতো ঘৃণ্য আপরাধকে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলোপ করতে পারে।

পাঠকের মতামত: