ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

আওয়ামী লীগে অস্বস্তি অনৈক্য বিএনপিতে

বান্দরবান প্রতিনিধি ::

জাতীয় সংসদের ৩০০তম নির্বাচনী এলাকা পার্বত্য বান্দরবান জেলা। অন্য দুটি পার্বত্য জেলার মতো বান্দরবানেও একটি আসন। আগামী নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভেতরে ভেতরে তৎপরতা থাকলেও অন্যদের সেটা নেই। বিশেষ করে বিএনপি নির্বাচন করবে কি না সেটা নিশ্চিত না হওয়ায় মাঠ সংগঠনের নেতাকর্মীরা করণীয় ঠিক করতে পারছে না।

মাঠপর্যায়ের রাজনীতির খোঁজ-খবর নিয়ে যতটা জানা যাচ্ছে সেটা হলো—একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী। আর বরাবরের মতো বিএনপির সমস্যা সেই অনৈক্য। এটি দূর না হলে বিএনপির হয়ে নির্বাচন করতে পারেন এলাকার বাইরের  কেউ এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছেন দলের কেউ কেউ।

আওয়ামী লীগ : দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় এলাকায় অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং কর্মসংস্থান আওয়ামী লীগের বড় ভরসা। জনগণ তাদের পক্ষেই আছে—এমন বিশ্বাসে ভর করে অনেকটা নির্ভার দলটি। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বীর বাহাদুর উশৈসিং। এর আগে প্রথম দফায় উপমন্ত্রী, দ্বিতীয় দফায় প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রচার শুরু না করলেও এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নানা উপলক্ষ ঘিরে প্রচারে আছেন বীর বাহাদুর। তবে দলের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী থাকতে পারেন এমন আশঙ্কাও ভাবাচ্ছে তাঁকে। কারণ ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীর কারণে ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে জয় ধরে রাখতে তাঁকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। সে সময় মনোনয়ন না পেয়ে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামায় দলের বান্দরবান জেলা শাখার সাবেক সভাপতি প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাকে বহিষ্কার করা হয়। এখনো তাঁর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়নি। তবু প্রসন্ন কান্তি আবারও দলীয় মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন।

অবশ্য জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুর রহিম চৌধুরী প্রসন্ন কান্তির মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পাঁচটি নির্বাচনে (১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন বয়কট করে আওয়ামী লীগ) বীর বাহাদুর বিজয় অর্জন করেছেন। এবারও তাঁর জনসমর্থন তুঙ্গে। কাজেই তাঁকে মনোনয়ন না দিয়ে অন্য কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার কোনো কারণ নেই।

যদিও এবার প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যার সারথি হয়েছেন দলের জেলা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী মজিবুর রহমান। দীর্ঘদিনের প্রার্থী বদলাতে তিনিও মরিয়া। দশম সংসদ নির্বাচনে বীর বাহাদুরের পক্ষে ছিলেন কাজী মজিব। প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাকে ঠেকাতে প্রাণপণ তৎপর ছিলেন তিনি। এখন দক্ষ এই সংগঠক নেমেছেন প্রসন্ন তঞ্চঙ্গ্যার পক্ষে।

দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রসন্ন-মুজিব ঐক্য আওয়ামী লীগকে দারুণভাবে ভাবাচ্ছে। এই বিরোধ দূর করার জন্য কেন্দ্র উদ্যোগ নিয়েছে। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ এবং সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমদকে দেওয়া হয় সমঝোতার দায়িত্ব। কিন্তু এখনো সমঝোতার কোনো প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে গত মাসে বিশেষ বর্ধিতসভা ডেকে সাংগঠনিক দিক থেকে বীর বাহাদুরকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয় জেলা কমিটি। ওই বর্ধিত সভায় প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা এবং কাজী মজিবকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দিয়ে সম্মিলিতভাবে তাঁদের প্রতিহত করার অঙ্গীকার করে দলীয় নেতাকর্মীরা।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইসলাম বেবী বলেছেন, ‘বিশ্বাসঘাতকদের বের করে দেওয়ার পর আওয়ামী লীগ কর্মীরা আরো ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী হয়েছে।’ তিনি বীর বাহাদুরের আমলে বান্দরবানে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিবরণও দেন।

মোহাম্মদ ইসলাম বেবী বলেন, ‘থানচি উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহের পাশাপাশি দুর্গম এলাকাগুলোতে সোলার প্যানেল স্থাপন করে বিদ্যুৎ পৌঁছানো হয়েছে বীর বাহাদুরের প্রচেষ্টায়। কাজেই তাঁর বিজয় অর্জন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করাটাও হবে বোকামি।’

অবশ্য জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও গতবারের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা দাবি করেন, বীর বাহাদুরের আমলে উন্নয়নের নামে পুকুরচুরি হয়েছে। জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের পরিবর্তে নিজপক্ষের লোকেরা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। জনগণ এসব হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। তাই ভোটে দাঁড়ালে নিশ্চিত ফেল করবেন বীর বাহাদুর। তিনি দাবি করেন, বীর বাহাদুরের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে। নানা জরিপ-সমীক্ষায় ভাটা পড়ার তথ্য বেরিয়ে আসায় দলের নিশ্চিত আসন টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগপ্রধান বান্দরবান আসনে এবার নতুন প্রার্থী দিতে পারেন।

প্রসন্ন এমনও দাবি করেছেন, ‘আমি যতটা জানি, দলের সভানেত্রী এবার নতুন মুখ খুঁজছেন।’ দলের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য গত কয়েক মাসে বেশ কবার তিনি ঢাকায় গিয়ে লবিং করেছেন বলেও জানান। বিগত দিনে দলের জন্য তাঁর অবদান এবং এলাকায় জনসমর্থন থাকায় তিনিই মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন—এমন প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছেন প্রসন্ন। তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন না পেলে দলের পক্ষে নিশ্চিত আসনটি ধরে রাখতে আবারও প্রার্থী হওয়ার কথাও আমাকে ভাবতে হচ্ছে।’

২০১৫ সালে জেলা ছাত্রলীগের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে বিরোধে জড়িয়ে সাধারণ সম্পাদকের পদ হারান কাজী মজিবুর রহমান। একই কারণে দল থেকেও বহিষ্কৃত হন এই দক্ষ সংগঠক। সেই থেকে দলে ফিরে আসার চেষ্টার পাশাপাশি বর্তমান নেতৃত্বকে ওলট-পালট করে দিতে মরিয়া তিনি। স্থানীয় অনেকেই বলেছে, বাঙালি ভোটারদের মধ্যে তাঁর কিছুটা সমর্থন থাকায় প্রথম দিকে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার তোড়জোড় ছিল কাজী মজিবের। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে বোঝা গেল, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার চেয়ে তাঁর প্রধান লক্ষ্য সাধারণ সম্পাদক পদটি ফিরে পাওয়া। তাই এখনই মুখোমুখি বিরোধে নামতে চান না তিনি।

কাজী মজিবের ঘনিষ্ঠজনরা বলেছে, নির্বাচনের আগে লক্ষ্য পূরণ না হলে তিনি প্রসন্ন কান্তির পক্ষেই মাঠে নামতে পারেন।

বিএনপি : প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে এখনো নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারেনি বিএনপি।

দলের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, স্থানীয় দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে অনৈক্য না কাটলে কৌশল হিসেবে বান্দরবানে বহিরাগত কোনো নেতাকে প্রার্থী করতে পারে বিএনপি।

নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বোমাং রাজবাড়ির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে রাজপুত্র সাচিং প্রু জেরি ও রাজপুত্রবধূ মিসেস মাম্যাচিং কোনোভাবেই এক হতে পারছেন না। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন রাজপুত্র কে এস প্রু চৌধুরী। তিনি রাজপরিবারের ভিন্ন অংশের সমর্থক হওয়ায় অং শৈ প্রু চৌধুরী (পরে তিনি সার্কেল চিফ নিযুক্ত হন) সমর্থন দেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী বীর বাহাদুরকে। ১৯৯৬ সালে বিএনপির প্রার্থী হন সাচিং প্রু জেরী। সে সময় মিসেস মাম্যাচিংয়ের অবস্থান ছিল দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে। ২০০১ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পান মিসেস মাম্যাচিং। মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে সাচিং প্রু হন ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বীর বাহাদুরের কাছে মাত্র ৮৫৩ ভোটে হেরে যান মাম্যাচিং। ২০০৮ সালে মনোনয়ন পেয়ে যান সাচিং প্রু জেরী। কিন্তু এবারও তিনি নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারেননি। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে।

মাম্যাচিং ও জেরীর দ্বন্দ্ব মেটাতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বারবার চেষ্টা করেও সফল হননি। তার পরও দলের স্থানীয় নেতারা আশাবাদী—মাম্যাচিং-জেরীর গ্রুপিংয়ের অবসান ঘটিয়ে একক প্রার্থী দিতে পারবে বিএনপি।

মাম্যাচিং গ্রুপের অন্যতম কাণ্ডারি এবং জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাবেদ রেজা বলেন, ‘ম্যাডাম খালেদাকে জেলে রেখে আমরা সংসদ নির্বাচনে যাব না। আমাদের দলের কেউ গেলে আমরা তাঁকেও প্রতিহত করব।’ তিনি বলেন, ‘আমরা গ্রুপিং মানি না। ম্যাডাম জেলে থাকায় আমরা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে কাজ করছি। দল যাকে ধানের শীষ মার্কায় মনোনয়ন দেবে আমরা তার পক্ষেই কাজ করব।’

জাবেদ রেজা বলেন, ‘আমরা এখনো আশাবাদী দলের স্বার্থ বিবেচনা করে তাঁরা (মাম্যাচিং-জেরী) একই প্লাটফরমে আসবেনই। যদি তা না হয়, তাঁদের দুজনকে বাদ রেখে বান্দরবান আসনে এবার নতুন কোনো প্রার্থীকে নামানো হবে।’

নির্বাচন করা না করা নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে চাইছেন না সাচিং প্রু জেরী এবং মিসেস মাম্যাচিং। তাঁরা দুজনই বলছেন, দল যাঁকেই মনোনয়ন দিক, কাজ করবেন ধানের শীষের পক্ষেই। তৃতীয় কোনো প্রার্থী আসার ব্যাপারে সরাসরি মন্তব্য করতে না চাইলেও এই দুই নেতার ঘনিষ্টজনরা আভাস দিয়েছেন, নিজে মনোনয়ন না পেলে স্থানীয় অন্য প্রার্থীকে সমর্থন করার চেয়ে এই আসনে তৃতীয় কোনো প্রার্থী চান দুজনই।

অন্যান্য দল : জাতীয় পার্টির কোনো কোনো অংশের সভাপতি থাকলেও সাধারণ সম্পাদক নেই। বামপন্থী দলগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। ‘নামে আছে, কাজে নেই’ অবস্থা তাদের।

খাগড়াছড়িতে মূল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) বেশ শক্তিশালী হলেও বান্দরবানে তাদের অবস্থা ভালো না। উল্লেখ্য, সম্প্রতি ইউপিডিএফ ভেঙে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে আরেকটি সংগঠন হয়েছে। ইউপিডিএফের বান্দরবান জেলা সভাপতি ছোটন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা একবার প্রার্থী হয়েছেন। আরেকবার তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে গেছে।

সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) মাঝে মাঝেই প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে মাঠে নামে। ২০০৮ সালে কে এস মং প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনে জনসংহতির কোনো প্রার্থী ছিল না। দলটি সমর্থন দিয়েছিল সাবেক শান্তিবাহিনী নেতা আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাকে। এবার জনসংহতি সমিতি অনেকটা নিশ্চুপ।

দলের নেতা কে এস মং এবং জলিমং বলেন, ‘হাই কমান্ড যে নির্দেশনা দেবে, আমরা তা-ই অনুসরণ করব।’

পাঠকের মতামত: