ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

চট্টগ্রাম-১২ পটিয়া আসনের মনোনয়ন নিয়ে অস্বস্তি আ. লীগ-বিএনপিতে

পটিয়া প্রতিনিধি ::

বিভক্তি ও কোন্দলের কারণে পটিয়ায় অস্বস্তিতে রয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির স্থানীয় নেতারা। এর পরও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বেশ সরগরম হয়ে উঠেছে স্থানীয় রাজনীতি। উপজেলাটি চট্টগ্রাম-১২ সংসদীয় আসন। বিগত দুই মেয়াদে এখানে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। ফলে আসনটি ধরে রাখতে চায় দলটি। অন্যদিকে আসনটি পুনরুদ্ধারে তৎপর বিএনপি।

এ ছাড়া নির্বাচনী মাঠে আছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাতীয় পার্টি (জাপা) ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)।

আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মনোনয়ন চান একাধিক নেতা। আওয়ামী লীগ পটিয়ায় এত দিন সুসংগঠিত থাকলেও গেল রমজান মাস থেকে দলে বিভক্তি দৃশ্যমান হয়। অন্যদিকে বিএনপিতেও তিনটি ধারা লক্ষ করা যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগে বর্তমান সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর পাশাপাশি মনোনয়ন আলোচনায় আছেন তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতির (বিজিএমইএ) প্রথম সহসভাপতি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মো. নাছির, সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং চট্টগ্রাম জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি চেমন আরা তৈয়ব ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (ঢাকা বিভাগ) মুহাম্মদ বদিউল আলম।

আর বিএনপির মনোনয়ন আলোচনায় আছেন সাবেক সংসদ সদস্য গাজী শাহজাহান জুয়েল, সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সহসভাপতি ইদ্রিস মিয়া ও দলের একই শাখার সহসভাপতি এনামুল হক এনাম।

জাতীয় পার্টির মনোনয়ন চান সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও সামশুল আলম মাস্টার। এলডিপি থেকে দলটির কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক এম এয়াকুব আলী নির্বাচন করতে চান। সিপিবির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম ও ইসলামী ফ্রন্ট থেকে গাজী মনজুরুল করিম রেফায়ী প্রার্থী হবেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

আওয়ামী লীগ : আগামী নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের হ্যাটট্রিক জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু রমজান মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পটিয়ায় এক ইফতার মাহফিলে দলের ভেতরকার কোন্দল প্রকাশ্যে চলে আসে। মূলত আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী মো. নাছির আয়োজিত এ ইফতার মাহফিলকে কেন্দ্র করেই এ বিরোধের সূত্রপাত। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান ও পটিয়া আওয়ামী লীগের একটি অংশ ওই অনুষ্ঠানে বর্তমান সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়। এর পাঁচ দিন পরেই সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরী উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত ইফতার মাহফিলে তাঁর বিরুদ্ধে দেওয়া বক্তব্যকে বিভ্রান্তিকর ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত দাবি করে নৌকাকে ফুটো করার ষড়যন্ত্র থেকে নেতাকর্মীদের বিরত থাকার আহ্বান জানান। তিনি গত সপ্তাহে পটিয়ায় আরেকটি সভায় নিজ দলের মধ্যে নৌকার বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তাদের বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।

সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরী বলেন, ‘বিগত নয় বছরে পটিয়ায় দুই হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন হয়েছে। কিছু চলমান রয়েছে। আমি জনগণের সেবক হয়ে আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে পটিয়াবাসীকে এক মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে যাইনি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে পটিয়াবাসী অবশ্যই আমার কাজের মূল্যায়ন করবেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকতে পারে; কিন্তু প্রতিহিংসা থাকতে পারে না।’ জনসম্পৃক্ত নয় এমন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিলে নিশ্চিত আসনটি হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা থাকবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সংসদ সদস্য বলেন, ‘আমার বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখবেন এবং আমি পটিয়াবাসীকে নিয়ে আবারও এই আসন তাঁকে উপহার দিতে পারব, ইনশাআল্লাহ।’

মো. নাছির বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে পটিয়ায় অপরাজনীতি চলছে। দলের তৃণমূল ও দীর্ঘদিনের ত্যাগী প্রবীণ নেতাকর্মীরা অবহেলিত। তারা পটিয়ায় আওয়ামী লীগের নতুন প্রার্থী চায়।’ আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের একাধিক নেতার নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এসব নেতা আমার সঙ্গে মাঠে কাজ করছেন। যদি সভানেত্রী আমাকে পটিয়া থেকে মনেনায়ন দেন, তাহলে আমি আপামর জনতার রায় নিয়ে নৌকাকে বিজয়ী করতে পারব। আমি নির্বাচিত হলে এ পটিয়াকে ডিজিটাল শহরে রূপান্তর করব।’

চেমন আরা তৈয়ব বলেন, ‘আওয়ামী লীগের একজন তৃণমূলের কর্মী হিসেবে আমি সার্বক্ষণিক মাঠে কাজ করছি। বর্তমান সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে নারীর ক্ষমতায়নের যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন একজন কর্মী হিসেবে আমি তাঁর প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে তৃণমূলে নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করছি। আগামী দিনে সুযোগ পেলে আমার পটিয়ায় নারীসমাজের উন্নয়নসহ সামগ্রিক উন্নয়নে কাজ করব।’

চেমন আরা তৈয়ব সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে পটিয়া ছাড়াও সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও চন্দনাইশে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘কাজে সন্তুষ্ট হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে সন্দ্বীপে অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করেন।’

বিএনপি : ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে এ আসনে বিজয়ী হন বিএনপির প্রার্থী। যোগ্য প্রার্থী পেলে আসনটি পুনরায় জিতে নেওয়া যাবে বলে মনে করে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা। তবে মনোনয়ন ঘিরে দলের ভেতরকার কোন্দল নিয়ে আওয়ামী লীগের চেয়েও বেশি অস্বস্তিতে রয়েছে বিএনপি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পটিয়া বিএনপির মাঠপর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, একসময় ছাত্রদলের রাজনীতি করে উঠে আসা গাজী মুহাম্মদ শাহজাহান জুয়েল শুধু পটিয়ার সাবেক সংসদ সদস্যই নন, তিনি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকও। কিন্তু বর্তমান সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর অবস্থান রহস্যজনক। স্থানীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ, শাহজাহান জুয়েল বেশির ভাগ সময় বিদেশে থাকেন। মাঝেমধ্যে দেশে এসে হাজিরা দিয়ে যান। অন্যদিকে জেলা বিএনপির সহসভাপতি এনামুল হক এনাম গত ৮-৯ বছরে আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে সার্বক্ষণিক অবস্থান করে তৃণমূল নেতাকর্মীদের নজর কেড়েছেন। এর মধ্যে একাধিক মামলায় বেশ কয়েকবার কারাবাস করতে হয়েছে তাঁকে। ২০০৯ সালে ইদ্রিস মিয়া বিএনপির টিকিটে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি আগে থেকেই আন্দোলন, সভা-সমাবেশে মাঠের নেতা। এই তিনজনকে ঘিরে পটিয়ায় বিএনপির রাজনীতি বিভক্ত।

গত বছরের মে মাসে পটিয়া উপজেলার ইন্দ্রপোল এলাকায় চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির কর্মী সম্মেলনে দুই পক্ষের সংঘর্ষ নিয়ে সেখানে দলের কোন্দল চরম আকার ধারণ করে। এ ঘটনার পর বিএনপি চেয়ারপাসনের বিশেষ তদন্ত কমিটির তদন্ত সাপেক্ষে সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান জুয়েলকে দল থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরে এই অব্যাহতি আদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হলে তিনি আবারও তাঁর পক্ষের নেতাকর্মী নিয়ে পটিয়ার রাজনীতিতে সক্রিয় হন।

গাজী শাহজাহান জুয়েল ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে টানা দুই মেয়াদে বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মনোনয়ন বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে অন্তরিন রাখা হয়েছে। এর ফলে এ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে সংশয় থাকলেও আমরা বসে নেই। তৃণমূল নেতাকর্মীদের সুসংগঠিত করে যাচ্ছি। আমি দুইবার সংসদ সদস্য থাকাকালে পটিয়ায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। দলীয় হাইকমান্ড আমাকে মনোনয়ন দিলে পটিয়ার জনগণের রায় নিয়ে হারানো আসনটি পুনরুদ্ধার করতে পারব।’

তাঁর বিদেশে অবস্থান করা প্রসঙ্গে শাহজাহান জুয়েল বলেন, ‘এটা এক ধরনের অপপ্রচার। দলীয় মনোনয়ন নিয়ে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী কয়েকজন রাজনৈতিক সহযোদ্ধা এ কাজ করছেন। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে সব ঠিক হয়ে যাবে, আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করব।’

বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা কমিটির সহসভাপতি ইদ্রিস মিয়া বলেন, ‘দুর্দিনে নেতাকর্মীদের পাশে থেকে মাঠে-ময়দানে চষে বেড়িয়েছি। হামলা-মামলাকে পরোয়া করিনি। অথচ সুসময়ে অনেকেই মনোনয়ন নিয়ে দলের সুবিধা ভোগ করেছেন। কিন্তু দুর্দিনে নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন না। আমি দলের হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেন ত্যাগী নেতাকর্মীদের মধ্য থেকে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করা হয়। অন্যথায় পটিয়ার আসনটি পুনরুদ্ধার করা কঠিন হবে।’

বিএনপির আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক এনামুল হক এনাম বলেন, ‘আমি মনে করি, বিএনপির হাইকমান্ড ত্যাগী নেতাকর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন করবেন। নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দেবেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘বিগত আট বছরে মামলা-হামলা, জেল সামলে এবং গুলিবিদ্ধ হয়েও পিছপা হইনি। বর্তমানে আমি নেতাকর্মীদের পাশে রয়েছি।’ বহিষ্কৃত কোনো নেতাকে পুনরায় মনোনয়ন দেওয়া হলে ভোটে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন এনাম। তিনি বলেন, ‘আমি আশাবাদী দল যদি আমাকে মনোনয়ন দেয়, তাহলে পটিয়ায় বিএনপির হারানো গৌরবকে ফিরিয়ে এনে আসনটি দলকে উপহার দিতে সক্ষম হব।’

জাতীয় পার্টি : জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পটিয়ায় বিগত সময়ে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। তিনি যখন সংসদ সদস্য ছিলেন তখন কর্ণফুলী তৃতীয় সেতু, পটিয়া পল্লী বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিলেন। তিনি বলেন, বিগত নির্বাচনে তাঁর নিশ্চিত বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তাই তিনি আশাবাদী যদি জাতীয় পার্টি তাঁকে পটিয়া থেকে মনোনয়ন দেয়, তাহলে তিনি লাঙলকে বিজয়ী করতে পারবেন।

এলডিপি : নবম সংসদ নির্বাচনেও মনোনয়ন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অবস্থায় ছিলেন বলে জানিয়েছেন এলডিপি নেতা মো. এয়াকুব আলী। তিনি বলেন, ‘এবার যদি ২০ দলীয় জোট আমাকে মনোনয়ন দেয়, তাহলে আমি আশাবাদী পটিয়ার এ আসনে আমরা বিজয়ী হতে পারব, ইনশাআল্লাহ।’

পাঠকের মতামত: