ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগে শাস্তি হচ্ছে, তবুও কমছে না অপরাধ

প্রতি মাসে ১ হাজার জনের সাজা কঠোর তদারকি, চলছে মোটিভেশন

অনলাইন ডেস্ক ::

আইনজীবীর সহকারী বৃদ্ধ সমরকৃষ্ণ চৌধুরীকে ইয়াবা ও অস্ত্র বিক্রেতা সাজিয়ে বোয়ালখালী থানা পুলিশের গ্রেপ্তারের সংবাদটি চট্টগ্রাম তথা দেশজুড়ে সম্প্রতি সমালোচনার ঝড় তুলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিরীহ সমরকৃষ্ণের ছবিটি ভাইরাল হলে পুলিশের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে।

গত ১২ জুলাই তিনি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে তাকে গ্রেপ্তার করা থেকে থানা হাজতে নির্যাতন এবং পরে ক্রসফায়ার দেওয়ার জন্য চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন। ১৭ জুলাই পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জে যোগ দেওয়া উপ–মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) খন্দকার গোলাম ফারুক এক মতবিনিময় সভায় পুলিশের কেউ অপরাধ করলে ছাড় না দেওয়ার ঘোষণা দেন। সমরকৃষ্ণ চৌধুরীকে অস্ত্র ও ইয়াবার মামলায় ‘ফাঁসানোর’ বিষয়টি তিনি তদন্ত করে দেখবেন বলে জানিয়েছিলেন ওই দিন।

গত বৃহস্পতিবার অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে একজন বোয়ালখালী থানার এসআই আরিফুর রহমানকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, এসআই আরিফকে বোয়ালখালী থানা থেকে ক্লোজড করে পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়েছে। পটিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের সুপারিশের ভিত্তিতে জনস্বার্থে ক্লোজড করা হয়েছে। মামলা দায়ের, তদন্ত, চার্জশিট প্রদান, নিরীহ লোকজনকে গ্রেপ্তার, ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিকে গ্রেপ্তার না করাসহ প্রতি পদে পুলিশ বাণিজ্য করছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ১৬ থানার প্রত্যেকটিতেই পুলিশের অনিয়ম–দুর্নীতি রয়েছে। ঘুষ–দুর্নীতির অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গুরুতর অপরাধের কারণে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এরপরও অপরাধ প্রবণতা তো কমছেই না, বরং বাড়ছে। সমপ্রতি পুলিশের বেশ কয়েকটি অপকর্ম বিষয়টিকে আবারও আলোচনায় এনেছে। নানা অপরাধে পুলিশের এক শ্রেণীর সদস্যের জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় ম্লান পুলিশ বিভাগের অনেক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।

সদর দফতরের কঠোর হুঁশিয়ারি এবং নজরদারির পরও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না পুলিশের একটি শ্রেণীর এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা। বিশেষ করে যেসব পুলিশ সদস্য দিনে–রাতে জননিরাপত্তায় টহল দিচ্ছেন, তাদের অনেকেই সাধারণ মানুষের জন্য বেশি নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে নিত্য অভিযোগ উঠছে, তারা মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে অর্থ আদায় করছেন।

পুলিশের এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দুই–একজন প্রকাশ্যে অভিযোগ করলেও বেশিরভাগ মানুষই হয়রানির ভয়ে মুখ খুলতে চান না। তবে পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তাদের মতে, অভিযোগ যে কারো বিরুদ্ধে উঠতে পারে। তার সত্যতা কতটুকু, সেটি প্রশ্নবিদ্ধ।

সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এডমিন) মো. মাসুদ উল হাসান বলেন, অপরাধ একটি রোগ। এতে যে কেউ সংক্রমিত হতে পারে। যেকোনো কমিউনিটিতে যে কেউ অপরাধ করতে পারে। পুলিশের কেউ কেউ অপরাধে জড়ায়। অপরাধ প্রমাণের পর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।

তবে পুলিশ সদস্যদের এ ধরনের নৈতিক অবক্ষয় চলতে থাকলে আইনের ভিত্তি ভেঙে পড়ার পাশাপাশি সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা নেমে আসবে বলে মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন এ প্রসঙ্গে বলেন, যাদের আইন রক্ষা করার কথা তারা যদি আইন ভঙ্গ করেন তাহলে সমাজে প্রচণ্ড রকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে এবং সমাজে অন্যায় অপরিসীমভাবে বেড়ে যাবে।

তবে সিএমপির শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, অবক্ষয় রোধ এবং ইমেজ রক্ষায় কঠোর তদারকির পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদের মোটিভেশনের কাজও চলছে।

পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যমতে, নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় প্রতি মাসে প্রায় এক হাজার পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তাকে সাজা দেওয়া হচ্ছে। বছরে প্রায় ১২ থেকে ১৫ হাজার পুলিশের অপরাধজনিত বিচার এবং শাস্তি হচ্ছে। পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও হচ্ছে। কিন্তু তারপরও পুলিশের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কমছে না। সমপ্রতি কিছু পুলিশ সদস্যের অপরাধ প্রবণতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। কিছু সংখ্যক পুলিশ অপরাধে জড়ালেও পরোক্ষে এর দায় চাপছে পুলিশ বাহিনী এবং সরকারের ওপর। অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে, পুলিশের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ও মেধাবীদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। তবেই যোগ্য লোকেরা পেশার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারবেন।

জানা গেছে, পুলিশের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পর শুধু যে বিভাগীয় মামলায় সাজা হচ্ছে তাই নয়, কঠোর অপরাধের বিচারের জন্য পুলিশ বিভাগ থেকেই অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও হয়। প্রতিদিনই পুলিশ সদর দফতরে পুলিশের বিভিন্ন অপরাধের কারণে অভিযোগ জমা পড়ে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ৫ বছরে পুলিশের বিরুদ্ধে ৭২১টি ফৌজদারি মামলা দায়ের হয়েছে। এই মামলাগুলোতে ৭৯৮ জন পুলিশ সদস্য অভিযুক্ত।

সদর দফতর সূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা–১৯৮৫ অনুযায়ী অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এছাড়া সদর দফতরে পুলিশের বিরুদ্ধে আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ,সন্ত্রাসীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগসূত্র রয়েছে এমন অভিযোগে এক হাজারেরও বেশি সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গুরুতর অভিযোগে চাকরিচ্যুত ও বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে কনস্টেবল ও এএসআই পর্যায়ের সদস্য বেশি। এছাড়া বিভিন্ন অভিযোগে লঘুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অনেকের নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য বেতন স্কেলে দক্ষতাসীমা অতিক্রম বন্ধ, বেতন স্কেল নিম্ন ধাপে অবনমিতকরণ এবং কর্তব্যে অবহেলায় সরকারের আর্থিক ক্ষতির সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ বেতন হতে আদায় করা হচ্ছে।

আইনজীবীর সহকারী সমরকৃষ্ণ চৌধুরীর ঘটনা প্রসঙ্গে জানা যায়, গত ২৭ মে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে নগরের জহুর হকার্স মার্কেটের সামনে থেকে তাকে বোয়ালখালী থানা পুলিশ তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ ওঠে। পর দিন ২৮ মে ইয়াবা অস্ত্র উদ্ধারের মামলা দিয়ে জেলে পাঠায়। গত ১০ জুলাই অস্ত্র মামলা ও ২৪ জুন ইয়াবার মামলায় জামিন পান। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সঞ্জয় দাশের সঙ্গে বিরোধের জেরে বোয়ালখালী থানা পুলিশ সমরকৃষ্ণ চৌধুরীকে তুলে নিয়ে মাদক ও অস্ত্র দিয়ে মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ করে আসছে তার পরিবার।

গত ১২ জুলাই ইয়াবা কেনাবেচার সময় হাতেনাতে এক পুলিশ সদস্যকে নগরীর বহদ্দারহাট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে নগর গোয়েন্দা(ডিবি) পুলিশ। তার নাম মো. রিদোয়ান। রিদোয়ান বর্তমানে সাময়িক বরখাস্ত। এর আগে বাকলিয়ার সাবেক এএসআই রিদোয়ান ইয়াবাসহ ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে গ্রেপ্তার হলে তাকে পুলিশ বাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয়। পরে কারাগার থেকে জামিনে এসে তিনি ফের ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন।

১৭ জুলাই সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারী বাসস্ট্যান্ড থেকে ১৫ হাজার ইয়াবাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা হলো আজিজুর রহমান, মো. নুরুল ইসলাম ও মো. জসিম উদ্দিন। সীতাকুণ্ড থানার ওসি মো. ইফতেখার হাসান বলেন, কঙবাজার থেকে ইয়াবা নিয়ে তারা ঢাকায় যাচ্ছিল বলে স্বীকার করেছে। তাদের পায়ের গোড়ালির কাছে কৌশলে ইয়াবার প্যাকেট বাঁধা ছিল। তারা অঙ্গীভূত আনসার সদস্য। দুজন এখন আনসার হিসেবে চাকরি করেন না। একজন নগরীর কোতোয়ালী থানার সোনালী ব্যাংকের শাখায় দায়িত্ব পালন করেন।

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি চার হাজার ইয়াবাসহ এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব –৭। আগ্রাবাদ পাঠানটুলির মদিনা ইলেকট্রনিঙ নামের একটি দোকান থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে মোহাম্মদ আফাজ উল্লাহ (৪২) হালিশহর থানার এসআই। বাকি দুজন হলেন খোরশেদ আলম ও শহীদ। এ ঘটনার পর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

গত বছর নভেম্বরে তিন হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয় এক পুলিশ সদস্য। তার নাম ইমাম উদ্দিন। তিনি রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্সের(আরআরএফ) কনস্টেবল। তার বাড়ি কঙবাজার জেলায়। নগরীর পতেঙ্গা থানা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।

সূত্র মতে, সাধারণ মানুষের কাছে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের চেয়েও কোনো একটি মামলায় ‘অজ্ঞাত আসামি’ স্থানে নাম ঢুকিয়ে দেওয়া অনেক বেশি আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের কাছে ‘অজ্ঞাত’ এখন মামলার একটি ধারা বলেই বিবেচিত হচ্ছে। ৫৪ ধারা ও অজ্ঞাত আসামি নিয়ে পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহারের কাছে অসহায় সাধারণ মানুষ। নগরীর কয়েকটি থানার ভারপ্রাপ্ত ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এ ধরনের গ্রেপ্তারের কথা অস্বীকার করেননি। তবে ‘গ্রেপ্তার বাণিজ্যের’ বিষয়ে তাদের জানা নেই বলে জানিয়েছেন।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হলেও এসব মামলায় প্রতিকার পাওয়া যায় না। তদন্তে দুর্বলতা, পক্ষপাতিত্ব ও অযথা কালক্ষেপণের কারণে প্রকৃত অপরাধীর সাজা হয় না। আইনের ফাঁক–ফোকর গলিয়ে তারা ঠিকই বের হয়ে যায়।

তবে পুলিশের বিরুদ্ধে এখন আদালতে অভিযোগ জমা পড়ছে আগের চেয়ে বেশি। বিষয়টিকে ভালো লক্ষণ বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ একটা সময় মনে করত পুলিশি নির্যাতন, হয়রানি তাদের কপালের লিখন। সেই হতাশা দূর হচ্ছে, জনসচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন,পরের যন্ত্রণা মনে করে আগে মানুষ পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চাইত না। কিন্তু কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, সে সাধারণ মানুষ হোক, পুলিশ কিংবা অন্য যেকোনো পেশার লোক হোক না কেন। তবে পুলিশের দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিকভাবে পুলিশকে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।আজাদী

পাঠকের মতামত: