ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

নির্বাচনে যেতে খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ৩ শর্ত বিএনপির

নিউজ ডেস্ক  ::

কারাবন্দি দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির শর্তে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা জানিয়েছে বিএনপি। পাশাপাশি দলটির দাবি, নির্বাচনের আগে বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন করতে হবে। এ ছাড়া, নির্বাচনে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার দাবিও জানিয়েছে দলটি।

শুক্রবার (২০ জুলাই) বিকালে খালেদা জিয়ার সু-চিকিৎসা ও তার মুক্তির দাবিতে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে বিএনপির সিনিয়র নেতারা এসব দাবি উপস্থাপন করেন। দলীয় ব্যানারে আয়োজিত সমাবেশে অস্থায়ী মঞ্চে নেতারা বক্তব্য রাখেন। এতে অংশ নেন রাজধানী ঢাকাসহ আশেপাশের এলাকার বিএনপি নেতাকর্মীরা।

সমাবেশে নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি সম্বলিত ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুনসহ অংশ নেন। শুক্রবার দুপুরেই সমাবেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মিছিল নিয়ে জমায়েত হন নেতাকর্মীরা। বিএনপির নেতারা দাবি করেছেন, সমাবেশে লক্ষাধিক লোক সমাগম হয়েছে। নয়া পল্টন এলাকার আশেপাশে ফকিরাপুল মোড় থেকে নাইটিঙ্গেল মোড় পর্যন্ত এলাকা পরিপূর্ণ ছিল নেতাকর্মীদের অবস্থানে।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে দেশে কোনও নির্বাচন হবে না বলে মন্তব্য করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন করতে হলে এক নম্বর শর্ত– খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে। নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে, পাশাপাশি সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে। এ ছাড়া, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন করতে হবে।’

কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অস্থায়ী মঞ্চে শুক্রবার দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে সমাবেশ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় এবং সোয়া পাঁচটার দিকে শেষ হয়। বিএনপির সমাবেশকালে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের দু’টি সড়কে গাড়ি চলাচলও বন্ধ ছিল। এতে আশেপাশের এলাকায় দীর্ঘ যানজট তৈরি হয় এবং এ এলাকা দিয়ে যাতায়াতকারী সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে হয়।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘গণতন্ত্রের জন্য, মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য এবং সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য সমস্ত দল ও সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বর্তমান সরকারের দুঃশাসন যেভাবে বুকে চেপে আছে, তার থেকে মুক্তির জন্য জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন।’

গতকাল (১৯ জুলাই ) বৃহস্পতিবার ৮ বাম দলের সমন্বয়ে গঠিত জোটকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে অন্যান্য সব দলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।’ স্ব স্ব ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করে জগৎদল পাথরের ন্যায় বুকে চেপে বসে থাকা সরকারকে সরাতে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান মির্জা ফখরুল।

যদিও শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে এসে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী জানিয়েছেন, ড. কামাল হোসেন, বি চৌধুরীর নেতৃত্বে যে ঐক্যের চেষ্টা চলছে তা বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য নয়।

খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে জনগণ বাংলাদেশে কোনও নির্বাচন হতে দেবে না উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘বর্তমান সরকার অনির্বাচিত ও অবৈধ। এদের হাত থেকে দেশের মানুষ মুক্তি চায়। এরা দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে ভয়ের রাজ্য তৈরি করেছে। দেশের প্রতিটি মানুষ অনিরাপদ। মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চায়।’

কোটা সংস্কারের ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তুলে নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘এরপর মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। আন্দোলনকারীদের মায়েরা বলছেন– আমাদের চাকরি লাগবে না; ছেলেদের মুক্তি দিন।’

তিনি যোগ করেন, ‘আজকে দেশের কোনও মানুষই নিরাপদ নয়। দেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের দূতাবাস থেকেও বলা হচ্ছে, অন্যায় করা হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করুন।’

আগামী নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করুক তা আওয়ামী লীগ চায় না বলে দাবি করেন বিএনপির মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপক্ষ নির্বাচন হলে এবং বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগ তাতে ২০ আসনও পাবে না। তাই তারা আবারও ৫ জানুয়ারি মার্কা নির্বাচন করতে চায়।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে আজকে সরকার একটিমাত্র উদ্দেশে মিথ্যা মামলায় কারাগারে বন্দি করে রেখেছে। সরকার খালেদা জিয়াকে ভয় পায়, রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চায়। তারা খালেদা জিয়াকে আটকে রেখে ফের নির্বাচনের নামে সাজানো নাটক করতে চায়।’

দেশের মানুষ পরিবর্তন চায় মন্তব্য করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘দেশের মানুষ আইনের শাসন পাচ্ছে না। রাজনীতিবিদরা কথা বলতে পারছেন না। এই ধরনের অবস্থা চলতে পারে না। জাতীয় ঐক্যর মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তুলে এই সরকারকে বিদায় করতে হবে। ক্ষমতার জন্য নয়, বিএনপি আন্দোলন করছে দেশের মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনতে এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে।’

সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আগামীকাল (২১ জুলাই) সরকারি টাকা খরচ করে প্রধানমন্ত্রীর জন্য জনসভার আয়োজন করেছে আমলারা। পুলিশ যদি বিএনপিকে আগে সমাবেশের অনুমতি দিতো, তাহলে আগামীকাল অনুষ্ঠেয় শেখ হাসিনার জনসভা থেকে আমাদের জনসভা আরও বড় হতো।’

খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের অধীনে আগামীতে জাতীয় নির্বাচন হবে না। কারণ, তাদের অধীনে কোনও সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। আর তার প্রমাণ, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো।’

নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া ও দলীয় নেতাকর্মীদের মুক্তি দিতে হবে এবং সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে বলে দাবি করেন মোশাররফ। তিনি বলেন, ‘সোজা আঙুলে ঘি উঠে না। আমাদের আন্দোলনের মাধ্যমে এসব দাবি আদায় করতে হবে। আর আন্দোলনের জন্য দেশের মানুষ ও বিএনপি প্রস্তুতি নিচ্ছে। কারণ, দেশের মানুষ এই স্বৈরাচার সরকারের অবসান ঘটাতে চায়।’

সমাবেশে আসা সাধারণ নেতাকর্মীদের মুখেও ছিল দলনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি। তারা বলছেন, নির্বাচনের আগে অবশ্যই বিএনপির চেয়ারপারসনকে মুক্তি দিতে হবে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা কৃষিবিদ মেহেদী হাসান পলাশ বলেন, ‘দেশনেত্রীর মুক্তি ছাড়া নির্বাচনে যাওয়া সম্ভব নয়। আন্দোলনের মধ্যদিয়ে নেত্রীকে মুক্ত করে আনা হবে। বিএনপি গণতান্ত্রিক পন্থায় বিশ্বাসী, তাই কেন্দ্রীয় নেতারা যেভাবে আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন, সেভাবেই আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।’

বাঞ্ছারামপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল খালেক মনে করেন, ‘খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হলে আন্দোলন আরও জোরদার করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবিলম্বে নির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন আর হতে দেওয়া যাবে না।’

সরকারি বাংলা কলেজের ছাত্রদলের সভাপতি মো. আইয়ুব বলেন, ‘খালেদা জিয়া ছাড়া কোনও নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। সিনিয়র নেতাদের উদ্দেশে বলবো, কার্যকর কর্মসূচি দিন। খালেদা জিয়াকে মুক্তির আন্দোলন আরও তীব্র করতে হবে। আগে খালেদা জিয়ার মুক্তি, তারপর নির্বাচন।’

এদিকে, বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে নয়াপল্টনের আশপাশে বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের উপস্থিতি দেখা গেছে। সাদা পোশাকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতিও ছিল। এ ছাড়া, বিজয়নগর ম‌োড়ে রাখা ছিল প্রিজন-ভ্যান, জল-কামান, এপিসি। সন্ধ্যা ৬টার দিকে যখন সমাবেশ শেষ হয়, নেতাকর্মীরা কোনও গোলযোগ ছাড়াই নয়া পল্টন এলাকা ত্যাগ করেন।

গত ১৫ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে সমাবেশের এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ও সহ-প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলীমের সঞ্চালনায় বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্যে রাখেন– স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড আব্দুল মঈন খান, ভাইস-চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, জয়নুল আবেদীন ফারুক, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রমুখ।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ আদালত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সাজা দেওয়া হয়। এরপর থেকে তিনি রাজধানীর নাজিম উদ্দিন রোডে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি রয়েছেন।

পাঠকের মতামত: