ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

মাতামুহুরী নদী থেকে উদ্ধার হওয়া চকরিয়া গ্রামার স্কুলের ৪ ছাত্রের জানাযায় শোকাহত মানুষের ঢল

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::

চকরিয়া গ্রামার স্কুলের প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গনে রেখে গেছে অজস্র স্মৃতিপট। বই-খাতা নিয়ে আর কোন দিন স্কুলে আসবে না এমশাদ, অরভি, ফারহান, তূর্ণ ভট্রাচর্য্য ও মেহেরাব।স্কুলের প্রিয় সহপাঠীদের দেখাও হবে না। স্কুলে হেসে খেলে দুষ্টুমি ও পড়ায় মনোনিবেশে তাদের আর দেখা মিলবে না। তারা আজ ওপারের মানুষ-ওখানের ছাত্র।

চকরিয়ায় উপজেলার মাতামুহুরী নদীর চিরিংগা ব্রীজের নিচে জেগে উঠা চরে ফুটবল খেলে গোসল করতে গিয়ে নিহত হয়েছে চকরিয়া গ্রামার স্কুলের ৫ মেধাবী কৃতি ছাত্র।নিহত ছাত্রের মধ্যে ৪ ছাত্র দশম শ্রেণীর ও এক ছাত্র অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিল।স্কুল ছুটির শেষে মাতামুহুরী নদীর জেগে উঠা চরে শনিবার ১৪ জুলাই ফুটবল খেলতে যান তাদের সহপাঠীসহ ওই ছাত্ররা।যে বালির মাঠে তারা হেসে-খেলে খেলতে গিয়েছিল রবিবার (আজ) সেখানে আজ চুপচাপ করে শুয়ে আছে।

তারা আর কখনও খেলবে না, পড়বে না। হাসবে না, দুরন্তপনা তাদের আর ছুঁবে না।মাতামুহুরী নদীতে আট ঘন্টা ধরে ফায়ার সার্ভিসের দমকল বাহিনীর সদস্য, ডুবুরি ও স্থানীয়রা প্রশাসনের সার্বিক সহয়তায় অভিযান চালিয়ে নিহত ৫ ছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয় শনিবার রাত ১২টায়।উদ্ধার হওয়া ছাত্রের লাশগুলো একে একে আনা হলে তাদের বসতঘরে স্বজনের গণবিদারী কান্নারোল।

১৫জুলাই (রবিবার) সকাল ১১টায় চকরিয়ায় মাতামুহুরী নদীর জেগে উঠা চরে ও মাতামুহুরী নদীতে ডুবে যাওয়া ৪ ছাত্রের তাদের জীবনের শেষ ফুটবল খেলার মাঠে চার জনের জানাযা নামাজ একত্রে অনুষ্ঠিত হয়।এতেই মাতামুহুরী নদীর সদ্য জেগে উঠা বালির মাঠে সবার জানাযার জন্য লাইন করা হলে তাদের স্বজনদের আর্তনাদে এক বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়।কোমলমতি চার ছাত্রদের লাশের চেহেরা দেখে হাজার হাজার জনতা সবাই নির্বাক, শোকাহত। নিহত শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও স্বজনদের বিলাপে পুরো এলাকা শোকে শোকাতুর হয়ে গেছে। অন্যদিকে  তুর্ণ ভট্রাচার্য (১৭)এর মরদেহ সৎকার করা হয়েছে।

নিবার পাঁচ ছাত্র পানিতে ডুবে নিহত হওয়ার দুর্ঘটনার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে শোকের শহরে পরিণত হয়েছে চকরিয়া উপজেলার সদর। পুত্র সন্তান হারানোর বেদনায় কাতরাচ্ছে মা-বাবা। তাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে এলাকার বাতাস।বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তারা।ভাবতেও পারেননি এ ভাবে নিরবে চলে যাবে তাদের প্রিয় সন্তানেরা।

উল্লেখ্য যে, মাতামুহুরী নদীতে সদ্য জেগে উঠা বালু চরে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলে নদীতে গোসল করতে নামে পৌরশহরে অবস্থিত চকরিয়া গ্রামার স্কুলের ৫ মেধাবী ছাত্রের সলিল সমাধি হয় শনিবার দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে।এতে নিহত হয়, চকরিয়া গ্রামার স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র ও আনোয়ার শপিং কমপ্লেক্সের মালিক আনোয়ার হোছাইনের দু’পুত্র আমিনুল হোছাইন এমশাদ (১৭) ও তার ছোট ভাই একই স্কুলের ৮ম শ্রেণীর ছাত্র আফতাব হোছাইন মেহেরাব (১৫), একই স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র ও মানিকপুর তর্দরূপ ভট্ট্রাচার্য্যের পুত্র তুর্ণ ভট্রাচার্য (১৭), গ্রামার স্কুলের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলামের পুত্র ও ১০ম শ্রেণির ছাত্র সাঈদ জাওয়াদ আরভি (১৭) ও চিরিংগা সরকারী হাসপাতাল পাড়ার মোহাম্মদ শওকতের পুত্র ১০ম শ্রেণির ছাত্র ফারহান বিন শওকত (১৭)।তাদের বাড়িতে নিহত ছাত্রদের একনজর দেখতে হাজার হাজার মানুষ ভীড় জমেছিল।

জানা গেছে, মূলত নিহত ছাত্ররা চিরিংগা ব্রীজের নিচে জেগে উঠা বালু চরে চকরিয়া গ্রামার স্কুলের একদল ছাত্র ও ক্ষুদে ফটবলার বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলতে যায়। তাদের মধ্যে একদল আর্জেন্টিনা সার্পোটার ও অপরদল ব্রাজিল সাপোর্টার হয়ে ২২জন শিক্ষার্থী দুই দলে বিভক্ত হয়ে ফুটবল খেলেন। খেলে শেষে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে মাতামুহুরী নদীতে গোসল করতে নামে ওই ক্ষুদে ফটবলার।তৎমধ্যে ৬জন ছাত্র নদীতে গোসল করতে নেমে নিখোঁজ হয়ে যায়। একজনকে তাদের সহপাঠিরা মুমুর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে চকরিয়া একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।ঘটনার ৮ঘন্টা পর স্থানীয় লোকজন ও ফায়ার সার্ভিস ডিফেন্স ষ্টেশনের একদল ডুবুরি নদীতে জাল ফেলে নিখোঁজ হওয়া ৫ ছাত্রের লাশ এক এক করে মৃতবস্থায় উদ্ধার করেন।

এদিকে জানাযা অংশ নিতে আসা শোকার্ত মানুষের ভীড়ে ২ ঘণ্টা পূর্বে থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যান চলাচল প্রায়ই বন্ধ হয়ে যায়। পুরো কক্সবাজার জেলায় শোকাহত লকাধিক্ষ মানুষ চার ছাত্রের জানাযায় অংশ নেয়ার জন্য ছুটে আসে মাতামুহুরী বালুর চরে।বর্তমানে পুরো জেলায় চলছে শোকের মাতম।জানাযা নিহতের পরিবারে চলছে কান্নার আহাজারী। তাদের পিতা-মাতা কিছুক্ষণ পরপর অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন। তাদেরকে শান্তনা দেওয়ার জন্য ছুটে আসে পুরো উপজেলার হাজার হাজার নারী-পুরুষ।

চার ছাত্রের জানায় অংশ নেন চকরিয়া উপজেলা প্রশাসন, চকরিয়া পৌর প্রশাসন, চকরিয়া থানার কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।

জানাযার নামাজের পূর্বে শোকাতদের উদ্যেশ্য বক্তব্য রাখেন, চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইলিয়াছ, চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আলহাজ্ব জাফর আলম, চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান, চকরিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফাঁসিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী, চকরিয়া পৌরসভার মেয়র মো: আলমগীর চৌধুরী, চুনতি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবু নঈম, চকরিয়া গ্রামার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও নিহত ছাত্র অরভির পিতা রফিকুল ইসলাম প্রমূখ।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী, কক্সবাজার জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম লিটু, চকরিয়া নিউজ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম, কাকারা ইউপি চেয়ারম্যান শওকত ওসমানসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানবৃন্দ, চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক নুরুল আখের,বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ও কলেজের অধ্যক্ষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেরনেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক ও শোকাহত জনতা।নিহত ছাত্রদের জানাযায় ইমামতি করেন চিরিংগা সোসাইটি জামে মসজিদের খতিব মাওলানা কফিল উদ্দীন ফারুখী।

পাঠকের মতামত: