ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

বন্যামুক্ত করতে প্রস্তাবিত পথে নদীর গতি পরিবর্তন চায় লামাবাসী

লামা প্রতিনিধি ::

মুষলধারে বৃষ্টি নামলেই উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের সৃষ্ট বন্যার আশংকায় শংকিত হয়ে পড়েন বান্দরবানের লামা পৌর শহরবাসী। রাতে না ঘুমিয়ে পাহারা দিয়ে বসে থাকতে হয়; কখন বন্যার পানি তলিয়ে দেবে বসতঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ। টানা দুই আড়াই ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই পাহাড়ি ঢলের পানিতে প্লাবিত হয় উপজেলা প্রশাসনসহ শহরের বিভিন্ন পাড়া মহল্লার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। আর তখন রাত জেগে ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মূল্যবান জিনিসপত্র সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয় স্থানীয়দের। একবার নয়, প্রতি মৌসুমে ৪-৫ বার এমন দুর্ভোগ পোহাতে হয় পৌর শহরের প্রায় ৪০ হাজার বাসিন্দাকে। ধীরে ধীরে এ বন্যা স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ ধারণ করতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। স্থানীয়দের ভাষায়ম চীনের দুঃখ হোয়াং হো নদী আর লামাবাসীর দুঃখ মাতামুহুরী নদী। তারা বলেন, লামা শহরকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করতে ইতিপূর্বেকার প্রস্তাবিত পথে মাতামুহুরী নদীর গতি পরিবর্তনের বিকল্প নেই। প্রস্তাবিত পথে নদীর গতি পথ পাল্টানোর দাবী জানিয়ে স্থানীয়রা বিভিন্ন সময় ‘ত্রাণ চাইনা, লামাকে বন্যা মুক্ত করতে নদীর গতি পরিবর্তন চাই’ এ শ্লোগানে মানববন্ধন কর্মসূচী পালনসহ প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করেন। দ্রুত এ প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকাবাসী।

জানা যায়, প্রতি বর্ষা মৌসুমে মাত্র কয়েক ঘণ্টা মুষলধারে বৃষ্টি নামলেই উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মাতামুহুরী নদীর দু’কূল উপচে বন্যার সৃষ্টি করে। এতে শহরের সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর পানিতে তলিয়ে যায়। এছাড়া পলি পড়ে হাজার হাজার একর জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়। চলতি বর্ষায় এক মাসের মাথায় দুইবার লামা শহর এলাকা প্লাবিত হলে জনজীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। এতে সরকারি হিসেব মতে প্রায় ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়।

স্থানীয়রা সামান্য বৃষ্টিতে লামা বন্যায় প্লাবিত হওয়ার ৩টি কারণ চিহ্নিত করেছেন। তাদের মতে, যুগ যুগ ধরে পাথরের বেষ্টনি দিয়ে গড়ে উঠা পাহাড়গুলো থেকে নিয়ম বহির্ভূত উপায়ে পাথর আহরণ ও অবাধে পাহাড় কাটার ফলে বর্ষা মৌসুমে ব্যাপক হারে পাহাড়ে ধসের সৃষ্টি হয়। আবার ধসে পড়া পাহাড়ের মাটি ও বালি বৃষ্টির পানির সাথে পাহাড়ি ঝিরি বেয়ে মাতামুহুরী নদীতে পড়ার কারণে অস্বাভাবিকভাবে নাব্য হারিয়েছে মাতামুহুরী। যার ফলে সামান্য বৃষ্টিতে মাতামুহুরী পরিপূর্ণ হয়ে দু’কূল উপচে বন্যার সৃষ্টি করে।

সম্প্রতি পাহাড়ে জুম চাষের কারণে অগ্নিসংযোগ এবং অব্যাহতভাবে বৃক্ষনিধনের ফলে পাহাড়গুলো ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। ফলে ন্যাড়া পাহাড়গুলো বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা হারায়। এ কারণে দ্রুত বৃষ্টির পানি সাথে পাহাড়ের মাটি বেয়ে নদীতে নেমে তলদেশ ভরাট হয়ে সৃষ্টি করে বন্যার। অপরদিকে, লামা বাজারের পশ্চিম পাশে অবস্থিত সুখী এবং দুখী নামের দুটি পাহাড়ের মধ্য দিয়ে মাতামুহুরী নদীটি প্রবাহিত। পাহাড়ি ঢলের পানি এ দু’ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে দ্রুত প্রবাহিত হতে না পেরে ফেঁপে উঠে বন্যার সৃষ্টি করে লামা শহর প্লাবিত করে বলে অনেকে মনে করেন।

জানা গেছে, বিগত সরকারের আমলে বন্যার কবল থেকে লামা শহরকে রক্ষার জন্য মাতামুহুরী নদী গতি পরিবর্তনের একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। লামা বাজার থেকে এক মাইল উত্তরে অবস্থিত মাতামুহুরী ও বমু নদীর সঙ্গমস্থলে স্থানটি নির্ধারণ করা হয়। এ স্থানে অবস্থিত একটি পাহাড়ি ঝরনা কেটে দিলেই গতি পরিবর্তন সম্ভব। এ বিষয়ে প্রবীণ ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়দর্শী বড়ুয়া জানান, প্রস্তাবিত পথে গতি পরিবর্তনের ফাইলটি দীর্ঘ বছর ধরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের হিমাগারে পড়ে আছে। সরকারের মন্ত্রী এবং উচ্চ পদস্থ কর্তা ব্যক্তিরা একাধিকবার নদীর গতি পরিবর্তনের এলাকাটি সরেজমিন পরিদর্শন করে লামাবাসীকে বন্যার হাত থেকে রক্ষার আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।

লামা বাজারের ব্যবসায়ী পলাশ কান্তি দাশ জানান, বাজারেই তার বাসা। মুষলধারে বৃষ্টি নামলে বন্যার আশংকায় মা, বাবা ও ভাই বোনদের নিয়ে বসে থাকেন কিংবা পরিবারের মূল্যবান জিনিসপত্র সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, মাতামুহুরী নদীর গতি পরিবর্তন বাস্তবায়িত হলে লামা শহর যেমন বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেতো, তেমনি নদীর বর্তমান অংশটুকু বাঁধ দিলে প্রায় তিন মাইল এলাকা জুড়ে সৃষ্টি হত মনোরম প্রাকৃতিক লেক। যা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখত এবং মৎস্য চাষের মাধ্যমে এতদাঞ্চলের মাছের পুরোপুরি চাহিদা মিটিয়ে অন্যত্র বিক্রি করাও সম্ভব হত। ব্যবসায়ী পলাশ কান্তি দাশ, ঔষধ ব্যবসায়ী দিলীপ কান্তি দাশসহ আরো অনেকের মতে শীঘ্রই লামা শহরকে বন্যার কবল থেকে রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যস্থা গ্রহণ করা না হলে, আগামী বর্ষা মৌসুমগুলোতে লামায় পাহাড়ি ঢলে আরও ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়ে তা স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিতে পারে। তাই ত্রাণ চায় না, লামা শহরকে বন্যামুক্ত করতে প্রস্তাবিত মাতামুহুরী নদীর গতি পথ পাল্টাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপির সুদৃষ্টি কামনা করেন তারা।

এ বিষয়ে লামা পৌরসভার মেয়র মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, প্রতি বর্ষা মৌসুমে ৪-৫ বার লামা শহর পানির নীচে তলিয়ে যায়। এতে ব্যবসায়ীসহ সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতি সাধিত হয়। তাই লামা শহরকে বন্যামুক্ত করতে মাতামুহুরী নদীর প্রস্তাবিত গতি পরিবর্তন প্রকল্প বাস্তবায়ন অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। আর এ প্রকল্প বাস্তবায়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপির হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

পাঠকের মতামত: