ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

মাদকের গডফাদার, পৃষ্ঠপোষক কারবারিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড

নিউজ ডেস্ক ::
দেশ থেকে মাদক নির্মূল করতে সরকার নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে দেশজুড়ে পুলিশ ও র‌্যাবের জোরালো অভিযান শুরু হয়েছে। পুলিশ ও র‌্যাবের এনকাউন্টারে কজন শীর্ষ মাদক কারবারিসহ প্রায় দেড় শ জন মারা গেছে। গ্রেপ্তার হয়েছে ১৫ হাজারের মতো। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, এনকাউন্টারে যারা মারা গেছে তারা সবাই মাদক কারবারি। নিরপরাধ কাউকে ধরা হয়নি। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এনকাউন্টারের বিরোধিতা করছে। তবে অভিযান থেমে নেই। এরই মধ্যে ৯০ দশকের করা মাদকবিরোধী আইন সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে মাদক আইনে যে সাজা রয়েছে, তাতে মাদক কারবারিরা সহজে জামিন পেয়ে যাচ্ছে। খসড়া আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি রাখা হয়েছে ‘মৃত্যুদণ্ড’। বিদ্যমান আইনের কয়েকটি ধারাও সংশোধন করা হচ্ছে। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কাজ করছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে আইন সংশোধন করা হবে। যার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড।

আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধন করার প্রস্তাব করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—মাদকের লাইসেন্স, পারমিট এবং পাস দেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশকে যাছাইয়ের ক্ষমতা দেওয়া এবং লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে বিনা ওয়ারেন্টে তল্লাশি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে পুলিশের এসব প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে নিজেদের দেখতে চাচ্ছে তারা।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে বলেছেন। সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে। মাদক মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মাদক আইনও দ্রুত সংশোধন করা হবে। সবার সঙ্গে আলোচনা করেই তা করা হচ্ছে।’

পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন) মোখলেসুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। যেভাবেই হোক দেশ থেকে মাদক নির্মূল করা হবে। মাদকবিরোধী আইন সংস্কার করা হচ্ছে। পুলিশের পক্ষ থেকে কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবগুলো রাখলে পুলিশের পক্ষে কাজ করা সহজ হবে। আশা করি অল্প সময়ের মধ্যে আইনটি সংস্কার করা হবে।

যাচাই-বাছাই কমিটির প্রধান ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর) আতিকুল হক কালের কণ্ঠকে জানান, আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছিল। প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই করে দুই পক্ষেরই কিছু প্রস্তাব রাখা হয়েছে। আগামী সোমবার মন্ত্রীর কাছে খসড়াটি পেশ করা হবে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও আমরা মিলে দেশ থেকে মাদক নির্মূল করব। পুরনো আইন দ্রুত সংস্কার করা হচ্ছে। পুলিশ ও আমাদের বেশ কিছু প্রস্তাব ছিল। যাচাই-বাছাই কমিটি খসড়া প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদক কারবার ও সেবন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। যুবসমাজ ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েছে। এমনকি সংসদ সদস্যরা পর্যন্ত এ কারবারে জড়িয়ে পড়েছেন। প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের নির্দেশ দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ র‌্যাব-পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারাও মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। সরকারের নির্দেশে পুলিশ-র‌্যাবসহ সব কটি গোয়েন্দা সংস্থা মাদক কারবারি ও গডফাদারদের তালিকা তৈরি করেছে। এসব তালিকায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণির মাদক কারবারির নাম রয়েছে। ওই তালিকা ধরেই পুলিশ ও র‌্যাব বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে। মাদক কারবারিরা গ্রেপ্তার হলেও আইনের ধারা দুর্বল থাকায় তারা জামিন নিয়ে সহজে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। মূলত ৯০ দশকে করা আইন দিয়ে মাদক মামলা হচ্ছে। এ আইনটি সংস্কার করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১২ সদস্যের একটি যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির প্রধান করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আতিকুল হককে। এ ছাড়া কমিটিতে পুলিশ, র‌্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তারা রয়েছেন।

সূত্র মতে, পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মাদকের লাইসেন্স, পারমিট ও পাস দেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশকে যাচাইয়ের ক্ষমতা দিতে। লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি চালানোসহ আরো কয়েকটি প্রস্তাব দেয় কমিটির কাছে। এত দিন এই কাজগুলো ডিএনসি করে আসছিল। এ ছাড়া ডিএনসিও কিছু প্রস্তাব দিয়েছে কমিটির কাছে। তারা নিজেদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে দেখতে চায়। এ নিয়ে কমিটির সদস্যরা যাচাই-বাছাই করে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৯৯০ সালে বিদ্যমান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনটি প্রণয়ন করা হয়। মাদকের ধরন, সেবনকারীদের অভ্যাস ও চোরাচালানকারীদের কৌশল পরিবর্তনের কারণে ছয় বছর ধরে আইনটি সংস্কারের প্রক্রিয়া চলছে। যাচাই-বাছাই কমিটি ২৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মতামত নিয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশন, আন্তর্জাতিক নার্কোটিকস কন্ট্রোল বোর্ড, বিভিন্ন সময় আদালতের পর্যবেক্ষণ, নির্দেশনাসহ চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়া হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮-এর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। খসড়ায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আমাদের আপত্তি ছিল।’ তিনি বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে বিজিবি, কোস্ট গার্ড ও পুলিশের সহায়তাকারী হিসেবে আনসার-ভিডিপি কাজ করছে। এ অবস্থায় সম্পূর্ণ নতুন একটি বাহিনী তৈরি করলে মাঠপর্যায়ের অন্যান্য বাহিনী নিরুৎসাহিত হতে পারে। মাদক কারবারিরা সবার অগোচরে মাদক কারবার করে। ফলে ইউনিফরমধারী বাহিনীর পরিবর্তে সাদা পোশাকে মাদকবিরোধী অভিযান বেশি ফলপ্রসূ হয়। তিনি আরো বলেন, মদের বিক্রয়কেন্দ্র, মদপানের অনুমোদন ইত্যাদি দেওয়ার এখতিয়ার ডিএনসির। এ ক্ষেত্রে আমরা বলেছি, পুলিশের বিশেষ শাখার মাধ্যমে যাচাই করে লাইসেন্স দিতে হবে। একই সঙ্গে মাদক আইনে লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি বা পরিদর্শনের ক্ষমতাও আমরা চেয়েছি।

১৯৯০ সালের মাদক আইনে ৫৬টি ধারা ও ২১টি সংজ্ঞা ছিল। যাচাই-বাছাই কমিটির খসড়া প্রস্তাবে ৬৩টি ধারা, ৪৩টি সংজ্ঞা করা হয়েছে। নতুন আইনে গডফাদার ও মাদকে অর্থলগ্নিকারী, কারবারিদের শাস্তি দিতে ইয়াবা ট্যাবলেটকে ‘ক’ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। এত দিন শীর্ষ মাদক কারবারি, পৃষ্ঠপোষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ১০ বছর। এ ছাড়া সরকারি চাকরিতে যোগদানের আগে ‘ডোপ টেস্ট’ বা মাদক সেবনকারী কি না, তা পরীক্ষা করা হবে। মাদকাসক্তদের পুনর্বাসন করে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার বিষয়টিও থাকছে খসড়া আইনে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে মাদকসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অপরাধে যাতে তাৎক্ষণিক শাস্তি প্রদান করা যায়, এ জন্য আইনে শাস্তির ধারায় প্রয়োজনীয় উপধারা সংযোজন করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য তফসিল প্রয়োজন অনুযায়ী সংশোধন করা এবং সিসা সেবনে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া এত দিন সন্দেহভাজন কিংবা অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেত প্রমাণের অভাবে। অর্থাৎ সঙ্গে মাদক না পাওয়া গেলে কাউকে আইনের আওতায় আনা যেত না। খসড়া আইনে এই বিষয়টি সংস্কার করা হয়েছে। আইনটি পাস হলে এখন সন্দেহভাজন কিংবা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রমাণ ছাড়াই গ্রেপ্তার করা যাবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘খসড়া প্রস্তাবটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে পেশ করা হবে আগামী সোমবার। তারপর মন্ত্রণালয় বৈঠক করে তা পাশ করবে। পরে সেখান থেকে প্রস্তাবটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সংস্কার করা আইনটি চলতি মাসেই পাস হতে পারে বলে আমরা আশা করছি।’

পাঠকের মতামত: