ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

টেকনাফ সীমান্তে ইয়াবার ৫০ প্রবেশপথ

কক্সবাজারের টেকনাফের নাফ নদের তীর ইয়াবা পাচারের অন্যতম পয়েন্ট

অনলাইন ডেস্ক ::

কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী ইয়াবা খালাসের ৫০টি পয়েন্ট রয়েছে। এর মধ্যে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী পয়েন্টগুলোর মধ্যে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের ঘোলারপাড়া, দক্ষিণপাড়া, মাঝেরপাড়া সৈকত, সাবরাং কচুবনিয়া, হারিয়াখালী, কাটাবনিয়া, খুরের মুখ, আলীরডেইল, মুন্ডারডেইল, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মহেশখালীয়াপাড়া সৈকত, নোয়াখালীপাড়া, কুনকারপাড়া, বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর, শীলখালী, মাথাভাঙা, বড়ডেইল, উখিয়ার ইনানী, হিমছড়ি, দরিয়ানগর ইত্যাদি।এ ছাড়া নাফ নদের ইয়াবা খালাসের পয়েন্টগুলোর মধ্যে রয়েছে শাহপরীর দ্বীপ মিস্ত্রিপাড়া, জেটিঘাট, জালিয়াপাড়া, নোয়াপাড়া, সাবরাং, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, টেকনাফ পৌরসভার জালিয়াপাড়া, কায়ুকখালীপাড়া ঘাট, নাইট্যংপাড়া ঘাট, বরইতলী, কেরুনতলী, হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা, জাদিমুড়া, আলীখালী, দমদমিয়া, চৌধুরীপাড়া, হ্নীলা, মৌলভীবাজার, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের খারাংখালী, কাঞ্জরপাড়া, লম্বাবিল, উনচিপ্রাং, উখিয়ার থাইংখালী, পালংখালী, বালুখালী, ঘুমধুম, রেজুপাড়া ও তমব্রু।

মিয়ানমারে ইয়াবা কারখানা : সাম্প্রতিককালে দেশে ইয়াবার চাহিদা মাত্রাতিরিক্তহারে বেড়েছে। এদেশের ইয়াবার চাহিদার ভিত্তিতে মিয়ানমারে নতুন কারখানাও চালু হয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রের খবর, আগের ৩৭টি ইয়াবা কারখানার সঙ্গে নতুন করে আরো ৮টি কারখানা বেড়ে এখন মিয়ানমারে ইয়াবা কারখানার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৫টিতে। বাংলাদেশের বড় ইয়াবা কারবারিরা নিয়েছে মিয়ানমারের এসব ইয়াবা কারখানার ডিলারশিপ। মিয়ানমার থেকে প্রতিদিন এ দেশের ডিলারদের কাছে আসে অন্তত ৫০ লাখ ইয়াবা। আর এসব উৎপাদিত ইয়াবা নানা কৌশলে সীমান্তের নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশে। ইয়াবা পাচারকালে প্রশাসনের হাতে ধরা এড়াতে বহু কৌশল রপ্ত করে থাকে পাচারকারীরা।

কীভাবে আসে ইয়াবা : একসময় টেকনাফের নাফ নদের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ছোট ছোট নৌকায় রাতের আঁধারে অনুপ্রবেশ করত রোহিঙ্গারা। তখন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা তাদের হাতে ব্যাগে ব্যবহার্য জিনিসপত্রের সঙ্গে নিয়ে আসত ইয়াবা। ওই সময়ে ইয়াবার এত বেশি পরিচিতি বা প্রসার না ঘটায় এবং সীমান্তরক্ষীদের ম্যানেজ করে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে এপারে নিয়ে আসাতেই পাচারকারীরা তল্লাশির আওতামুক্ত থাকত। ফলে তাদের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা স্বাভাবিক ধারায় বিনা বাধায় সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢুকে পড়ত। পরে সেসব ইয়াবা এদেশের পাইকারি ও খুচরা কারবারিদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

২০০৫, ২০০৬ সালের দিকে মাদকদ্রব্য হিসেবে ইয়াবার নাম ব্যাপকহারে পরিচিতি পায়। ইয়াবা আটকে প্রশাসনের তৎপরতা বৃদ্ধি পেলে ইয়াবা কারবারিরা একটু নড়েচড়ে বসে। এরপর থেকে আর সহজভাবে সোজা পন্থায় আসেনি ইয়াবার চালান।

শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়ার আবুল হোসেন নামে এক জেলে বলেন, ‘নাফ নদের বিভিন্ন স্পটে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খুঁটি গেড়ে বসানো হতো বিহিঙ্গি জাল। কোনো কোনো জাল বসানো হতো নাফ নদের একেবারে মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি। তখন মিয়ানমারের ইয়াবা পাচারকারীরা নৌকায় এসে ইয়াবা ভর্তি বস্তা ফেলে দিত আগে থেকে চুক্তিবদ্ধ বিহিঙ্গি জালের ফাঁদে। জেলেরা জালসহ কূলে এসে খালাস করতো ইয়াবার বস্তা। এর পর নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে ইয়াবাগুলো পৌঁছে দিত প্রকৃত মালিকের কাছে।’

নাফ নদে পাচার কম, সাগরপথে বেশি : জেলেদের ইয়াবা পাচার সম্পৃক্ততা আঁচ করতে পেরে গত দুই বছর ধরে নাফ নদে কোনো ধরনের মাছ শিকার বা জাল ফেলা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। সে হিসেবে পুরনো ওই কৌশলে নাফ নদ দিয়ে ইয়াবা পাচার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। পাচারকারী নেয় ভিন্ন কৌশল। এবার এরা ইয়াবা পাচারের রুট পরিবর্তন করে নাফ নদের পরিবর্তে বঙ্গোপসাগর দিয়ে ইয়াবার চালান পাচার শুরু করে।

সম্প্রতি ইয়াবার বড় চালান পাচার হচ্ছে সাগরপথে মাছধরার ট্রলারে। খালাস হচ্ছে শাহপরীর দ্বীপ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত সৈকতের নিরাপদ পয়েন্টে। স্থানীয় ট্রলারমালিক ও জেলেরা অনেকে যোগ দিয়েছেন সীমান্তের বড় ইয়াবা কারবারিদের সঙ্গে। বাংলা চ্যানেল থেকে একটি বড় চালান নিয়ে সৈকতের সুবিধামতো পয়েন্টে পৌঁছে দিতে পারলে ট্রলার মালিক বা জেলেদের দেওয়া হয় চালানপ্রতি ২ থেকে ৫ লাখ টাকা। মাছ ধরার পরিবর্তে ট্রলার মালিক বা জেলেরা বেছে নিয়েছেন ইয়াবার চালান পাচার। বাধাহীন বিশাল সাগর ইয়াবা পাচারের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ রুট পাচারকারীদের কাছে। টাকার লোভে অনেক ট্রলারের মালিকও এখন ইয়াবার বড় গডফাদারে পরিণত হয়েছে।

কৌশল পাল্টে ইয়াবা ঢোকেছে টেকনাফ স্থল বন্দরের পণ্যবাহী জাহাজেও। বন্দরপথ ব্যবহার করে ইয়াবা পাচার অনেকটা নিরাপদ পাচারকারীদের কাছে। বন্দরে কাঠ, চাউল, আচারসহ বিভিন্ন পণ্যবাহী জাহাজে ইয়াবার বড় চালানগুলো ঢোকে পণ্যবাহী যানবাহনে করেই চট্টগ্রাম ও ঢাকায় পৌঁছে যায় নিরাপদে।

রোহিঙ্গা-ভিড়ে ঢুকেছিল শত কোটি ইয়াবা! : তিন দিন আগে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে মিয়ানমারের মংডুর হাচ্ছুরতা থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শিক্ষিত যুবক ওবায়দুল্লাহর সঙ্গে কথা হয়। তাঁর পরিবার মিয়ানমারে

সেনাবাহিনীর বর্বরতায় গত বছর অক্টোবর মাসে নাফ নদ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ইয়াবা প্রসঙ্গে রোহিঙ্গা ওই যুবক জানালেন, তাঁদের সঙ্গে একই এলাকার মুফিজ নামে এক ব্যক্তি ও তাঁর পরিবার এপারে চলে আসেন। মুফিজ ছিল মিয়ানমারের ইয়াবার বড় আড়তদার। কারখানা থেকে ইয়াবাগুলো এনে হাচ্ছুরতায় মুফিজের বাড়িতে গুদামজাত করা হত। সেখান থেকে বড় বড় চালান পাঠানো হত বাংলাদেশে। কিন্তু রাখাইনের পরিস্থিতি খারাপ হলে মুফিজরাও সপরিবারে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।

প্রতিবেশী হওয়ায় তাঁরা একদিন রাতে একসঙ্গে নাফ নদ পাড়ি দেন। তবে একসঙ্গে নাফ নদ পাড়ি দিতে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন পরিস্থিতি। পালিয়ে আসার মুহূর্তে মুফিজের বাড়িতে থাকা প্রায় ৫০ বস্তা ইয়াবা ভরা হয় তিনটি নৌকায়। ওই ৫০ বস্তা ইয়াবার পরিমাণ এক কোটির কম ছিল না। আরো দুটি নৌকাসহ ৫টি নৌকায় তাঁরা ১৩ রোহিঙ্গাসহ শাহপরীর দ্বীপ মিস্ত্রিপাড়া ঘাটে পৌঁছলে একজন যুবক ও তার দল এসে তাঁদের গ্রহণ করে ইয়াবার বস্তাসহ বাড়িতে নিয়ে যায়। ভোরে ওবায়দুল্লাহ ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেও মুফিজ ও তাঁর পরিবার ওই বাড়িতেই ছিলেন। তবে বাংলাদেশি ওই যুবকের পরিচয় জানেন না ওবায়দুল্লাহ। তাঁর মতে, ওই যুবকের সঙ্গে মুফিজের ইয়াবা কারবারের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের হতে পারে। নয়তো এত বিপুল পরিমাণ ইয়াবা তাঁর কাছে গচ্ছিত রাখা হয়ে কেন?

ওবায়দুল্লাহর ভাষ্যমতে, মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে ঢোকেছিল কয়েক কোটি ইয়াবা। ওই সময় রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় কোনো ধরনের তল্লাশি না থাকায় ইয়াবা পাচার অনেকটা সহজ ছিল। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ব্যাগে বা তাদের জিনিসপত্রে সাধারণ মানুষতো দূরের কথা সততা দেখিয়ে হাত দিত না প্রশাসনের লোকেরাও। তাই শেষ মুহূর্তে কী পরিমাণ ইয়াবা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ঢোকে পড়েছিল তা আন্দাজ করা মুশকিল।

প্রশাসনের যোগসাজশের অভিযোগ : ইয়াবা কারবারিদের বড় চালান বিভিন্ন সময়ে নির্বিঘ্নে পাচারে বা খালাসে সহযোগিতা দিয়েছে প্রশাসনের কিছু অর্থলোভী অসাধু লোক। তারা পাচারকারীদের কাছ থেকে বড় অংকের টাকা নিয়ে রাতের আঁধারে সীমান্তে ইয়াবা পাচারে সহযোগিতা করত। বিশেষ করে সীমান্তে বিজিবি ও পুলিশের কিছু অসাধু সদস্যদের সঙ্গে ইয়াবা গডফাদারগণের সখ্যতার অভিযোগ নতুন কিছু নয়। যার কারণে সীমান্তে ইয়াবা প্রতিরোধ প্রায় কঠিন হয়ে পড়ে।

থানা পুলিশের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ইয়াবা কারবারি এবং ইয়াবা মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারের পরিবর্তে তাদের কাছ থেকে মাসিক মাসোহারা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। পুলিশকে টাকা দিয়ে সীমান্তের ইয়াবার বড় গড ফাদাররা চলাফেরাসহ ইয়াবা কারবার চালিয়ে আসছে নির্বিঘ্নে। এমন অভিযোগও রয়েছে, অনেক সময় বিজিবি ও পুলিশের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তারা ইয়াবার বড় চালান জব্দ করেও পুরো হিসাব না দিয়ে অল্প স্বল্প জব্দ দেখিয়ে বড় অংশ গায়েব করে ফেলেন।

টেকনাফ সীমান্তে কক্সবাজার ডিবি পুলিশের একটি দলের এরকম ৭ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করে মাত্র ১০ হাজার ইয়াবা জব্দের মামলা দায়েরের  চাঞ্চল্যকর একটি ঘটনার তদন্ত হচ্ছে উচ্চ পর্যায়ে। ইয়াবা গায়েবের সুবিধার্থে অনেক সময়ে পাচারকারীকে হাতেনাতে ধরে ছেড়ে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। সীমান্তের সচেতন মহলের মতে, সীমান্তে দায়িত্বরত বিভিন্ন স্তরের প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব এবং কিছু গডফাদারের সাথে তাদের সখ্যতার কারণে ইয়াবা কারবার অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছে। কালের কন্ঠ

পাঠকের মতামত: