ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

ফুলছড়ির সংরক্ষিত বনাঞ্চলে শত শত অবৈধ বসতি!

সেলিম উদ্দীন, ঈদগাঁও, কক্সবাজার প্রতিনিধি, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফুলছড়ি রেঞ্জের বিশালায়তনের বনভূমির সিংহভাগই এখন ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। আগেকার মতো সেই চোখ জুড়ানো সবুজের সমারোহ নেই। যেদিকে চোখ যায় দেখা যাবে শুধুই ন্যাড়া পাহাড়।

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল দখলে নিয়ে গড়ে ওঠা শত শত অবৈধ বসতি। এতে পরিবেশের ওপর যেমন মারাত্মক প্রভাব পড়ছে, তেমনি ভয়াবহ অস্থিত্ব সংকটের মুখে পতিত হয়েছে বন্যপ্রাণীগুলো।

সংরক্ষিত বনাঞ্চল দেখভাল এবং বনভূমি রক্ষার জন্য বনবিভাগ নামের একটি সরকারি সংস্থা থাকলেও তা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, খোদ বনকর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এখানকার বনাঞ্চল দিনদিন বৃক্ষশূন্য হওয়ার পাশাপাশি সংরক্ষিত বনাঞ্চল অবৈধ বসতি গড়ে ওঠার পেছনে বনবিভাগের কর্মকর্তাদের আচরণ রহস্যজনক বলেও অভিযোগ ওঠেছে পরিবেশ সচেতন মহলে।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফুলছড়ি রেঞ্জের সংরক্ষিত বিশালায়তনের বনভূমি বলতে গেলে কার্যত অরক্ষিত রয়েছে। সবুজের সমারোহের পরিবর্তে এখন কোথাও কোথাও আছে শুধু ন্যাড়া পাহাড়। আবার কোনো কোনো স্থানে বনদস্যু ও ভূমিদস্যুদের করাল গ্রাস থেকে ন্যাড়া পাহাড়ও রক্ষা করা যাচেছ না। সেখানে শত শত অবৈধ বসতি স্থাপনের পাশাপাশি পাহাড় কেটে সাবাড় করে বিক্রি করা হচ্ছে মাটি।

বনবিভাগ সূত্র জানায়, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন ফুলছড়ি রেঞ্জের ৫টি বনবিটের অধীনে প্রায় লক্ষাধিক একর বনভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ও সৃজিত বৃক্ষে পরিপূর্ণ ছিল একসময়। এসব নান্দনিক বনরাজিতে পরিপূর্ণ ফুলছড়ি ছিল যেন সৌন্দয্যের অপূর্ব লীলাভূমি। বনাঞ্চলের মাদার গর্জন, চাপালিস, তেলসুর, চাম্পাফুল, জাম, গামারী, বৈলামসহ সৃজিত সেগুন প্রজাতির বৃক্ষ। এছাড়া হরেক প্রজাতির বাঁশ, বেতসহ লতা-পাতার সমারোহ। বর্তমানে বৃক্ষশূন্য পাহাড়গুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও বেশিরভাগ বনভূমি উজাড় হয়ে গেছে।

সরজমিন দেখা গেছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের দুইপাশ জুড়ে কিছু গর্জন, সেগুন ও জাম গাছ দেখা গেলেও বনের ভেতরের দৃশ্য বড়ই বেদনাদায়ক। বৃক্ষশূন্য পাহাড়গুলো দিনদিন বেদখল হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে অসংখ্য পাড়ায় পরিণত হয়েছে পাহাড়ি জনপদ। বনদস্যু ও ভূমিদস্যুরা বিনা বাধায় বিক্রি করছে ন্যাড়া হয়ে পড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বিপুল পরিমাণ জায়গা। আবার অনেকে ইচ্ছেমতো পাহাড় নিধন করে বিক্রির জন্য মাটি নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। বনবিভাগ একসময় বন রক্ষায় সচেষ্ট থাকলেও বর্তমানে সেই তৎপরতা বনকর্মীদের নেই। তবে কালে-ভাদ্রে পাহাড়ে থাকা গাছগুলো প্রভাবশালী বনদস্যুরা লুট করে নিয়ে গেলে আদালতে মামলা দায়ের করা হয় চুনোপুঁটিদের বিরুদ্ধে। মূলত বনকর্মীরা তাদের দায়িত্বের প্রতি চরম অবহেলার অংশ হিসেবে প্রভাবশালী বনদস্যুদের বাদ দিয়ে চুনোপুঁটিদের বিরুদ্ধে নামে মাত্র মামলা রুজু করা হয়।

ফুলছড়ি রেঞ্জের ফুলছড়ি বিটের অধীনে রয়েছে বন্যহাতির অভয়াশ্রম। কিন্তু এখন সেখানে দেখা মেলবে ন্যাড়া পাহাড় আর পাহাড়। এতে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বনে আজ থেকে তিন যুগ আগে শত প্রজাতির বন্যপ্রাণী থাকলেও বর্তমানে গুটি কয়েক হাতির পাল ছাড়া অন্যসব বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিশেষ করে হরিণ, বন মোরগ ও শিয়ালের চিৎকার আর শোনা যায় না।

স্থানীয় পরিবেশ সচেতন ব্যক্তিরা বলেন, সরকার বনজ সম্পদ রক্ষার জন্য যতই পদক্ষেপ গ্রহণ করুক না কেন, যদি বনবিভাগের কর্মকর্তাদের সৎ উদ্দেশ্য না থাকে তাহলে কোনো অবস্থাতেই সংরক্ষিত বনাঞ্চল রক্ষা করা যাবে না। ফুলছড়ি বিটের নিয়ন্ত্রণাধীন জুমনগর মৌজার কয়েকশত হেক্টর সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ন্যাড়া পাহাড়ে গত কয়েকবছর আগে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সামাজিক বনায়নের অধীনে বাগান সৃজনের উদ্যোগ নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উপকারভোগী নির্বাচন করে প্লট আকারে বরাদ্দ দিয়ে সামাজিক বনায়নের অধীনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে সামাজিক বনায়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেখানে রোপণ করা হয় লাখ লাখ চারা। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি, দখলবাজ-সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতার মুখে মুখ থুবড়ে পড়েছে সেই সামাজিক বনায়ন। সেখানে এখন দেখা মেলবে শত শত অবৈধ বসতি ও পরিবেশ বিধ্বংসী রাজত্ব। শুধু তাই নয়, আলোচিত জুমনগর মৌজার অন্তত অর্ধ শতাধিক পাহাড় কেটে সাবাড় করে সেই মাটি বিভিন্ন পরিবহনে করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিক্রির উদ্দেশ্যে। এসব কর্মকান্ড বনবিভাগের একেবারে নাগালের মধ্যে হলেও তারা কুম্ভকর্ণের ভূমিকায় অবতীর্ণ রয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, বনবিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের দাপটের কারণে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। আবার সব কর্মকর্তা যে একেবারে সাধু তাও বলা দুষ্কর। এতে একদিকে প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি ও বনদস্যুদের দাপটের পাশাপাশি বন কর্মকর্তাদের নীরব দর্শকের ভূমিকার কারণে ফুলছড়ির সেই চিরচেনা সবুজের সমারোহ একেবারে লোপ পাচ্ছে। পাশাপাশি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কাঠ জ্বালানি হিসেবে ইটভাটা ও তামাক চুল্লিতে ব্যবহারের কারণে দিন দিন পাহাড়ি সমতল ভূমিতে এবং ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত হচ্ছে।

তবে এসব ব্যাপারে বক্তব্য নেওয়ার জন্য ফুলছড়ি বনবিটের কর্মকর্তা এবং ফুলছড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তাঁরা এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য বা মন্তব্য করতে রাজি হননি।

অপরদিকে ফুলছড়ি রেঞ্জের মেদাকচ্ছপিয়া বনবিটের ন্যাশনাল পার্ক বলে পরিচিত শত বছরের রিজার্ভ ফরেস্ট একেবারে উজাড় হয়ে যাচ্ছে। বিট রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বন প্রহরী হাসেম চোরদের কাছ থেকে প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা উৎকোচ নিয়ে বনাঞ্চলকে বিরান ভুমিতে পরিনত করেছে। এ বিটে গুরুত্বপুর্ন বনাঞ্চলের দায়িত্বে থাকা সৈয়দ আবু জাকারিয়া নামক এক ফরেস্টারকে মাত্র ৩ মাসের ব্যবধানে ফুলছড়ি রেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব দেয়ায় কোটি কোটি টাকার মূল্যবান বনজ সম্পদ অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। বন প্রহরী হাসেম গত কয়েক বছর ধরে দায়িত্ব পালন করার সুবাধে কাঠ চোরদের কাছ থেকে উৎকোচ নিয়ে রেঞ্জারকে সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ তুলেছে স্থানীয় সচেতন মহল। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রেঞ্জার আবু জাকারিয়া মোটর সাইকেলে করে অবৈধভাবে পাচার হয়ে আসা জ¦ালানী কাঠ, গোল কাঠ, বাশ, লক ভর্তি ট্রাক, রদ্দা ও পাথর বোঝাই ট্রাক থেকে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও ফুলছড়ি সহকারী বন সংরক্ষকের নাম ভাঙ্গিয়ে স্থানীয় ভিলেজার মোহাম্মদ হোসেনের সহযোগিতায় দৈনিক হাজার হাজার টাকার চাদাঁ আদায় করছে। এভাবে দিনরাত চাদাঁবাজিতে ব্যস্ত থাকার কারণে প্রতিরাতেই খুটাখালী-মেদা কচ্চপিয়া-ফুলছড়ি বিট থেকে শতবর্ষী মাদার ট্রি (গর্জন গাছ) ও মুল্যবান সেগুন কাঠ গুলো বন প্রহরী হাসেমের সহযোগিতায় সংঘবদ্ধ কাঠ চোরেরা নিয়ে যাচ্ছে। মুল্যবান কাঠ গুলো কাঠ চোরেরা কেঠে নেয়ার পর শ্রমিক দিয়ে গাছের গোড়ালি গুলো তুলে মাটি দিয়ে ভরাট করে দেয়া হয় বলে সচেতন মহল জানিয়েছেন। মেদা কচ্ছপিয়া-খুটাখালী বন বিটের বিভিন্ন ব্লকের গাছের পরিসংখ্যান গুলো রেজিষ্ট্রর থেকে যাচাই-বাচাই করে বর্তমান পরিসংখ্যান বের করা হলে এ দু’বিট থেকে কি পরিমানের কাঠ উজাড় ও পাচার হয়েছে তা সহজেই ধরা পড়বে বলে দাবী করেছেন স্থানীয় ও পরিবেশ সচেতন জনগন।

মেদা কচ্ছপিয়া বিটের শতবর্ষী মাদারট্রি (গর্জন) ও জাম-সেগুন গাছসহ হরের প্রজাতির কোটি কোটি টাকা মুল্যের বনজ সম্পদ বিদ্যমান রয়েছে। গুরুত্বপুর্ন বনাঞ্চলের মুল্যবান বনজ সম্পদ রক্ষানাবেক্ষণ ও পাহারার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বন কর্মকর্তা আবু জাকারিয়াকে। তার বাড়াবাসা খুটাখালী বাজারে হওয়ায় স্থানীয় প্রভাবশালী নেতার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সংরক্ষিত বনের মুল্যবান কাঠ গুলো কাঠ চোরদের হাতে সপে দিয়েছে। মেদা কচ্ছপিয়া বনবিটের সংরক্ষিত বনের ভিতরে গড়ে উঠেছে নিত্য নতুন স্থাপনা। এ বিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চল দখল করে গড়ে উঠা বাড়ি-ঘর ও পাকা দালান নির্মানেও ওই অসাধু বিট কর্মকর্তাকে মোটা অংকের টাকা দিতে হয়েছে বলে স্থানীয় ও ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন।

এছাড়াও বর্তমান রেঞ্জ কর্মকর্তা রাজার হালে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাঁশ-কাঠ ভর্তি গাড়ি থেকে বন বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তাদের নামে প্রকাশ্যে চাদাঁবাজি করে গেলেও দেখার যেন কেউ নেই!

পাঠকের মতামত: