ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

গাজীপুরে ভোট স্থগিতে আ.লীগ স্বস্তিতে, নজর এখন খুলনায়

প্রথমআলো : গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের আশঙ্কায় ছিল আওয়ামী লীগ। এ জন্য আদালতের রায়ে ভোট স্থগিত হওয়ায় পরাজয়ের ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে স্বস্তিবোধ করছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা। তবে খুলনার ভোটে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে দলটি।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র বলছে, গাজীপুর ও খুলনায় ভোটের আগে একাধিক জরিপ করে আওয়ামী লীগ। দলীয় প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে গাজীপুরে জাহাঙ্গীর আলম ও খুলনায় তালুকদার আবদুল খালেক এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ বিএনপির প্রার্থীদের থেকে দুই স্থানেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পিছিয়ে ছিলেন। প্রচার শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন সংস্থা পুনরায় জরিপ করে। এতে দেখা যায়, গাজীপুরে বিএনপির প্রার্থীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ব্যবধান রয়েই গেছে। আর খুলনায় ব্যবধান কমে এসেছে। এ জন্য খুলনার বিষয়ে আশাবাদ তৈরি হলেও গাজীপুরে পরাজয়ের শঙ্কা দেখা দেয়। জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজধানীর অদূরে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে পরাজয়ের নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টি দলের নীতিনির্ধারকদের ভাবনায় ফেলে।

• গাজীপুর ও খুলনায় একাধিক জরিপ করেছে আওয়ামী লীগ 
• জরিপে গাজীপুরে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের শঙ্কা দেখা যায়। 
• খুলনার বিষয়ে আওয়ামী লীগের আশাবাদ।

প্রথমে সিদ্ধান্ত ছিল, গাজীপুর ও খুলনায় কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশি বেশি সফরে পাঠানো হবে না। অবশ্য গাজীপুরে কেন্দ্রীয় নেতাদের সফর বৃদ্ধির তাগিদ দিতে থাকেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গত শনিবার রাতেও সভাপতিমণ্ডলীর দুজন সদস্য সিটি এলাকার বাইরে গাজীপুরের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন। পরদিন রোববার আদালত ভোট স্থগিতের রায় দেন।

দলের নেতাদের একাংশ মনে করে, আইনি জটিলতায় বা আদালতের রায়ে ভোট স্থগিত হলেও এর দায় সরকারি দলের ঘাড়েই বর্তায়। এ ছাড়া গাজীপুর আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এখানকার নির্বাচনেও পরাজয়ের শঙ্কা, ভোট আটকে যাওয়া মানুষের কাছে ভুল বার্তা যায়।

সাভারের শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা এ বি এম আজহারুল ইসলামের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গাজীপুরের ভোট স্থগিত করেছেন আদালত।

এর আগে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচন এবং উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সম্প্রসারিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ভোটের দিন ধার্য করেছিল নির্বাচন কমিশন। প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর ১৭ জানুয়ারি এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের রায়ে উত্তর সিটির ভোট স্থগিত হয়। পরদিন আরেক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ সিটির কাউন্সিলরদের ভোটও স্থগিত হয়।

উত্তরের ভোট স্থগিত চেয়ে যে দুজন রিট করেছিলেন, তাঁদের একজন আওয়ামী লীগের নেতা, অন্যজন বিএনপির। তফসিল ঘোষণার পর থেকেই রাজধানীর মতো গুরুত্বপূর্ণ সিটির নির্বাচনে হারার ঝুঁকির বিষয়টি সরকারি দলের নীতিনির্ধারকদের ভাবনায় ছিল।

আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে কোন নির্বাচনে কী ফল হচ্ছে, তা জনপ্রিয়তার একটা মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০১৩ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গাজীপুরসহ পাঁচ সিটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পরাজয়ে এমন প্রচারণা পায় যে দলটির জনপ্রিয়তা বিএনপির চেয়ে কম। সিটি নির্বাচন কেমন হচ্ছে, এর প্রতিও দেশি-বিদেশি সব মহলের নজর থাকে। এই অবস্থায় দুটি সিটি করপোরেশনে হারজিত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

এ কারণে জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারি দলের নীতিনির্ধারকদের আগ্রহ কম ছিল। কিন্তু একের পর এক ভোট আটকে গেলে সরকারের ওপর দায় পড়বে-এই ভাবনায় ভেঙে ভেঙে ভোট দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। এখন খুলনার ফলাফলের ওপর রাজশাহী, সিলেট ও বরিশালের ভোট নির্ভর করছে বলে জানা গেছে।

পরাজয়ের ভয়ে আওয়ামী লীগ কারসাজি করে নির্বাচন আটকে দিয়েছে, বিএনপির এমন অভিযোগ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি সব সময় নিজেরা ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত করে। এ জন্য তারা সবকিছুতে ষড়যন্ত্র দেখে।’ তিনি বলেন, আদালতের রায়ের বিষয়ে সরকারি দলের করণীয় কিছু নেই। নির্বাচন কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেল ও দুই প্রার্থী-সবাই আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন। আদালতের রায়েই জট খুলতে পারে।

দলীয় লোকের মামলায় ভোট আটকে যাওয়ায় আওয়ামী লীগকে সন্দেহ করা হচ্ছে, এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ফারুক খান বলেন, যিনি মামলা করেছেন, তিনি তো নিজের ক্ষতির কথা উল্লেখ করে মামলা করেছেন। দলের কথা বলেননি।

আশাবাদীরা হতভম্ব
আওয়ামী লীগের একটি উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, গাজীপুরে নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম নিজে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তাঁকে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের একটা প্রভাবশালী অংশ সর্বাত্মক সহায়তা করে গেছে। জাহাঙ্গীর আলম বিপুল টাকাও খরচ করেছেন। এ জন্য জাহাঙ্গীর ও তাঁকে সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়া কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে ভোট স্থগিতের খবর আকস্মিক ধাক্বা হয়ে দেখা দেয়। কেউ কেউ কিছুটা হতভম্বও হন। কারণ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত হওয়ার আগে আলোচনা ছিল যে আইনি জটিলতায় ভোট আটকে যেতে পারে। গাজীপুরে এমন আলোচনা ছিল না। রোববার রাতেই জাহাঙ্গীর আলম দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

জানা গেছে, ভোট স্থগিতে আওয়ামী লীগ বা সরকারের যে হাত নেই, এটা প্রমাণের চেষ্টা হিসেবে জাহাঙ্গীরকে আইনি লড়াইয়ের পরামর্শ দিয়েছেন দলের কেউ কেউ।

জাহাঙ্গীর আলম গতকাল প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তিনি ১৩ বছর ধরে রাজনীতির মাঠে আছেন। বারবারই তিনি বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। ভোট স্থগিত হওয়ার কারণে তিনি নিজে এবং দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই হতাশ। দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তিনি আইনি লড়াই করবেন।

আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, গাজীপুরে জাহাঙ্গীরের বাইরে অন্য কাউকে প্রার্থী করলেও জেতার নিশ্চয়তা ছিল না। আবার জাহাঙ্গীরকে প্রার্থী করার কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগ তাঁকে মেনে নিতে পারেনি। এ জন্য তারা তাঁর পক্ষে পুরোপুরি মাঠে নামেনি। ব্যবসায়ীদের একটা অংশও জাহাঙ্গীরের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছে।

দুই সিটির নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে এমন এক প্রেক্ষাপটে, যখন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলার সাজায় কারাগারে। বিএনপি বলছে, খালেদা জিয়া ছাড়া কোনো নির্বাচন নয়। এই পরিস্থিতিতে বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করা আওয়ামী লীগের একটা লক্ষ্য ছিল বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। গাজীপুরের ভোট স্থগিত হয়ে যাওয়ার কারণে এখন খুলনায় দলীয় প্রার্থীর জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করবে আওয়ামী লীগ। বর্তমানে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একটি দল খুলনা সফর করছে।

পাঠকের মতামত: